শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২০

দেবীদ্বারে মানবতায় ‘রাজামেহার উত্তর পাড়া সমাজ কল্যাণ সংঘ'

দেবীদ্বারে মানবতায় ‘রাজামেহার উত্তর পাড়া সমাজ কল্যাণ সংঘ'কতৃক খাদ্য সামগ্রী বিতরণ
===================================

দেবীদ্বার উপজেলা রাজামেহার উত্তর পাড়ায় শনিবার সকাল ১১টায় রাজামেহার উত্তর পাড়া সমাজ জল্যাণ সংঘের উদ্যোগে মহামারি করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়েপড়া অসহায় ও হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। বিতরণকৃত খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে- চাল, তৈল ছোলা বুট, মুড়ি ও পেঁয়াজ।

রাজামেহার উত্তর পাড়া সমাজ কল্যাণ সংঘের সদস্য ও উপদেষ্টাদের আর্থিক সহযোগিতায় এই খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা হয়। অসহায় পরিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী তুলে দিতে পেরে রাজামেহার উত্তর পাড়া সমাজ কল্যান সংঘের সদস্য বৃন্দ কৃতজ্ঞতায় স্বস্থিবোধ প্রকাশ করছে।

সংগঠনের উপদেষ্টা বলেন,  আমাদের সংঘঠন বিগত দশ বছর যাবত দরিদ্র মানুষের সহযোগীতা ও সমাজের উন্নয়ন মূলক কাজে অংশগ্রহন করে আসছে। দেশে মরণঘাতি করোনা ভাইরাসের কারণে গ্রামের অসহায় গরীব শ্রেণীর মানুষজন কর্মহীন হয়ে পড়েছে এবং অনেকে লোক লজ্জায় কিছু চাইতে পারছে না। তাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কর্মহীন ও নিম্ন আয়ের হতদরিদ্র মানুষকে খাদ্য সামগ্রী উপহার দিতে পরামর্শ প্রদান করেছি। তিনি দেশের সকল বিত্তবানদের অসহায়দের পাশে এসে দাঁড়ানোরও আহবান জানান।

খাদ্যসামগ্রী বিতরণের  সময় উপস্থিত ছিলেন ওমর ফারুক, মোঃ মনিরুল ইসলাম, আশ্রাফুল আলম, সোহেল মোল্লা,জাকির হোসেন, আশিকুর রহমান, মাহবুব, শামিম,সুমন,রমজান, রিয়াজ,আলী হোসেন,রবিউল্লাহ বাগন প্রমুখ।

শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭

দরিদ্র জীবনযাপন, সংসারে অনাসক্তি,পার্থিব বস্তু কম অর্জনের উৎসাহ প্রদান এবং দারিদ্রতার ফযীলত-২

৪৬৩ হযরত মুস্তাওরিদ ইবন শাদ্দাদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ পরকালের তুলনায় ইহকালের দৃষ্টান্ত হলো এরুপ যে, তোমাদের কেউ তার কোনো একটি আঙ্গুল সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখে যতটুকু সাথে নিয়ে ফিরে। (আঙ্গুলের অগ্রভাগে সমুদ্রের পানির যে অংশ লেগে থাকে, সমুদ্রের তুলনায় এটা যেরুপ কিছুই নয়, তেমনি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াটা কিছুই নয়)। [মুসলিম]
৪৬৪ হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো একটি বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর দুপাশে ছিলেন সাহাবায়ে কিরাম(রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তিনি যখন একটি কানকাটা মরা ছাগল ছানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি এর কান ধরে তাঁদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের বিনিময়ে এটা কিনতে রাজি আছো? তাঁরা বললেন, আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে এটা কিনতে রাযি রাজি নয়; আর আমরা এটা দিয়ে করবই বা কি ?
তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা বিনামূল্যে এটা নিতে রাজি আছো?
তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম ! এটা যদি জীবিতও থাকতো, তবু তো এটা ত্রুটিপূর্ণ; কেননা এটার কানকাটা। তবে মৃতটাকে দিয়ে কি হবে?
অতঃপর তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম করে বলছি ! তোমাদের কাছে এ ছাগল ছানাটা যেরুপ নিকৃষ্ট দুনিয়াটা আল্লাহর কাছে এর চাইতেও বেশি নিকৃষ্ট। (মুসলিম)

৪৬৫ হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মদীনায় কালো কংকরময় প্রান্তরে হাঁটছিলাম। অতঃপর ওহুদ পাহাড় আমাদের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বললেনঃ হে আবু যার ! আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ !আমি আপনার খেদমতে হাজির আছি।
তিনি বললেনঃ এই ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও যদি আমার কাছে থেকে থাকে, তবু আমি খুশি হবো না। কেননা, তিন দিনও অতীত হবে না যে, আমার কাছে তা থেকে ঋণ আদায়ের অংশ ছাড়া এক দীনারও অবশিষ্ট থাকবে না; বরং আমি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এভাবে ওভাবে, ডানে-বাঁয়ে, এবং পেছনে খরচ করে ফেলবো। একথা বলে তিনি এগিয়ে চললেন এবং বললেনঃ বেশি সম্পদশালীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে; কিন্তু যারা সম্পদ এভাবে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে খরচ করেছে তারা নিঃস্ব হবে না। তবে এ ধরণের লোকের সংখ্যা খুবই কম।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমি একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেলো কি না?
কাজেই আমি তাঁর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু তাঁর এ আদেশ; “আমি না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না” স্মরণ হয়ে গেলো এবং তাঁর ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি স্থান ত্যাগ করলাম না।
তিনি ফিরে এলেন। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আমি তো একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার আদেশ স্মরণ হওয়াতে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন; তুমি তাহলে সে শব্দ শুনেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটা জিবরাঈলের শব্দ। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেন; তোমার উম্মতের যে কেউ আল্লাহর সাথে কিছুকে শরীক না করে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, সে যদি চুরি করে? তিনি বললেনঃ সে যদি যিনাও করে এবং চুরিও করে, তবু জান্নাতে যাবে। (বুখারি ও মুসলিম)
৪৬৬ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমার কাছে যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে তিন দিন যেতে না যেতে আমার কাছে এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আমি এতেই আনন্দিত হবো। তবে ঋণ আদায়ের জন্যে কিছু অংশ আটকে রাখতে পারি। (বুখারি, মুসলিম)
৪৬৭ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাশীলদের দিকে তাকিও না। তোমাদের উপর আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে নিকৃষ্ট মনে না করার জন্যে এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। (বুখারি ও মুসলিম) বুখারীর অপর এক বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কেউ যখন তার চাইতে ধনী ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখো, তখন সে যেনো তার চাইতে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকেও তাকায়।
৪৬৮ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; দীনার, দিরহাম, কালো চাদর ও চওড়া পেড়ে পশমী চাদরের অনুরাগী গোলাম ধ্বংস হয়েছে। কেননা, তাকে যদি দেওয়া হয়, তবে খুশী আর না দেয়া হলেই অখুশী। (বুখারি)
৪৬৯ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি তাঁদের কারো কারো চাদর ছিল না। কারো হয়তো একটি লুঙ্গি আর কারো একটি কম্বল ছিল। তারা এটাকে নিজেদের গলায় বেঁধে রাখতেন। কারোরটা হয়ত তাঁর পায়ের গোছার অংশ পর্যন্ত পৌঁছত; আর কারোরটা হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার ভয়ে তারা হাত দিয়ে এটাকে ধরে রাখতেন। (বুখারী)
৪৭০। হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়াটা হলো ঈমানদারদের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্যে জান্নাত বা উদ্যান”। (মুসলিম)
৪৭১ হযরত ইবন উমার(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বললেনঃ দুনিয়াতে তুমি মুসাফির অথবা পথচারী হয়ে থেকো। আর এ জন্যেই ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেনঃ তুমি যখন সন্ধ্যা যাপন করো তখন সকালের প্রতীক্ষা করো না। আর যখন তুমি ভোর পাও তখন সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। আর তোমার সুস্থ সুময়ে রোগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো এবং তোমার জীবনকালে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (বুখারী)
৪৭২ হযরত আবুল আব্বাস সাহল ইবন সা’দ সাঈদী(রা) থেকে বর্ণিত। তিন বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যখন আমি তা করবো, তখন আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও আমাকে ভালোবাসবে। উত্তরে তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন; আর মানুষের কাছে যা কিছু আছে, সেদিকে লোভ করো না, মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে। হাদীসটি হাসান, ইবন মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন।
৪৭৩ হযরত নু’মান ইবন বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সব লোকের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও ধন-সম্পদ অর্জিত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, সারাদিন তাঁর (নাড়িভূড়ি) পেঁচিয়ে থাকতো, অথচ ঐ পেটে দেয়ার জন্যে এমন কোনো নষ্ট পুরোনো খেজুরও মিলতো না। (মুসলিম)

আল্লাহর যিকির


কুরবানিঃ কিছু ভুল ও সঠিক ধারণা,কুরবানি কার উপর ওয়াজিব





মুসলিম বিশ্বের দুটি খুশির দিনের একটি হচ্ছে ঈদুল আযহার দিন। এই দিনের অন্যতম বড় ইবাদত হচ্ছে কুরবানি করা। একমাত্র আল্লাহর খুশির জন্য নিজের পছন্দের বা ক্রয়কৃত পশু কুরবানি করা হয়ে থাকে এই দিনে। কুরবানি যেহেতু বছরে একবার আসে তাই এর বিভিন্ন বিধি-বিধান ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। এই লেখায় কুরবানি সংক্রান্ত সহিহ কিছু তথ্য থাকবে। একই সাথে থাকবে বেশ কিছু ভুল ধারণা ও বর্জনীয় কাজের বর্ণনা।

কুরবানি কার উপর ওয়াজিব

কুরবানি ঈদের প্রথম দিন, অর্থাৎ জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে জিলহজ্জ মাসের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের মধ্যে কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারি হয় তাহলে তার উপর কুরবানি ওয়াজিব। নিসাবের পরিমাণ সম্পদের হিসাব হচ্ছে প্রয়োজনীয় অর্থ সম্পদের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদের মূল্যমান ৫২ থেকে ৫৫ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া। টাকার এই পরিমাণটা উল্লেখ করেছি দেশের বর্তমান সময়ে সাড়ে ৫২ ভরি রূপার মূল্যের সাথে মিলিয়ে।

এক কথায় বলা যায়, যদি জিলহজ্জের ১০ তারিখ সূর্যোদয় থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের মধ্যের এই সময়ে আমার কাছে খাওয়া-দাওয়া, পোষাক-পরিচ্ছদ, প্রয়োজনীয় বাড়ি-ঘর ইত্যাদির বাইরে উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিমাণ ৫২-৫৫ হাজার টাকার মত হয় তাহলে আমার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে। উল্লেখ্য যে, যাকাতের মত কুরবানি ওয়াজিব হবার জন্য এই অতিরিক্ত সম্পদটা আমার হাতে ১ বছর গচ্ছিত থাকা শর্ত নয়। উক্ত ৩ দিনের যে কোন সময় অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হলেই তার উপর কুরবানি ওয়াজিব হবে।
যার উপর কুরবানি ওয়াজিব না তিনিও চাইলে কুরবানি দিতে পারবেন। কিন্তু যার উপর কুরবানি ওয়াজিব তিনি কুরবানি না আদায় করলে ওয়াজিব ভঙ্গ করার গুনাহ হবে।

কুরবানি ও ঈদুল আযহার দিনে করণীয় কিছু কাজ

  • কুরবানির পশু নিজে জবাই করা। জবাই করা সম্ভব না হলে সামনে উপস্থিত থাকা। নবী (সাঃ) হজরত ফাতেমাকে (রাঃ) বলেছিলেন কুরবানির সময় উপস্থিত থাকতে।
  • পশু কুরবানির সময় যারাই ছুড়িতে হাত রাখবেন প্রত্যেককেই বিসমিল্লাহ বলতে হবে। ছুড়িটি হতে হবে ধারালো।
  • কুরবানি দাতা নিজে জবাই না করে অন্য কাউকে দিয়ে জবাই করালে ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি তাকে পারিশ্রমিক দেয়া উচিত। কারণ তিনি ছুড়ি ধার করা, ঝুকি নিয়ে পশু জবাইয়ের কাজটা করেন। এতে যেই পরিশ্রমটা হয় এর মূল্যায়ন আমাদের করা উচিত। মাদরাসার ছাত্ররা পশু জবাই করে দিবে যেন আমরা তাদেরকে চামড়া দেই এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। পশুর চামড়া পুরোটাও তাকে দিলেও সেটা কিন্তু তার সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছে না। সেটা যাচ্ছে মাদরাসার ফান্ডে। তাই আমাদের উচিত পশু জবাই বাবদ তাদেরকে সম্মানী দেয়া। তবে কোন ক্রমেই এই সম্মানী চামড়া বা পশুর গোশতের দ্বারা দেয়া যাবে না। একই ভাবে কসাইদেরকেও কুরবানির চামড়া বা গোশতের দ্বারা পারিশ্রমিক দেয়া যাবে না। মেহমান হিসেবে তাদেরকে খাওয়াতে বা উপহার হিসেবে দিলে সেটা ঠিক আছে। কিন্তু পারিশ্রমিক হিসেবে পশুর দড়িটাও তাদেরকে দেয়া যাবে না।
  • কুরবানির পশুর গোশত দিয়ে ঐ দিনের খাওয়া শুরু করা উত্তম।
  • জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা গেলে শরীরের কোন চুল, পশম বা নখ না কাটা উত্তম। বরং কুরবানির দিন কুরবানি করার পরে এগুলো কাটা সুন্নাহ। সে হিসেবে এ বছর ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যার পর থেকে ঈদের আগ পর্যন্ত চুল, নখ কাটা থেকে বিরত থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর ঈদের দিন এগুলো কাটা উত্তম বা সুন্নাহ এর অংশ হবে। ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে জিলহজ্জ মাসের শুরু হবে। তাই প্রয়োজন হলে শনিবার সন্ধ্যার আগেই এই কাজগুলোর সেরে ফেলা উচিত।
  • কারো যদি কুরবানি করার সামর্থ না থাকে তাহলে সে জিলহজ্জ মাসের চাঁদ দেখা গেলে শরীরের চুল, লোম বা নখ কাটা থেকে বিরত থাকবে। এবং কুরবানির দিন এগুলো কেটে পরিচ্ছন্ন হবে। এটাই তার জন্য কুরবানি হিসেবে গণ্য হবে। (আবু দাউদ, নাসায়ী)
  • ৯ জিলহজ্জ  ফজরের নামাজের পর থেকে ১৩ জিলহজ্জ আসরের নামাজ পর্যন্ত সকল প্রাপ্ত বয়ষ্ক নারী-পুরুষের উপর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা ওয়াজিব। এই ২৩ ওয়াক্ত ফরজ নামাজের পর অন্তত একবার তাকবিরে তাশরিক পড়তে হবে। পুরুষেরা উচ্চ স্বরে আর নারীরা নিচু স্বরে পড়া উত্তম। জামাত ছুটে গেলে বা এই ২৩ ওয়াক্তের মধ্যে কোন ওয়াক্ত কাযা হলে সেই কাযা নামাজ পড়ার পর তাকবির পাঠ করতে হবে। কোন নামাজের পরে তাকবিরে তাশরিক পড়তে ভুলে গেলে মনে হবার সাথে সাথে তা পড়ে নিতে হবে। তাকবিরে তাশরিক হচ্ছেঃ الله أكبر .. الله أكبر .. لا إله إلا الله ، الله أكبر .. الله أكبر .. ولله الحمد উচ্চারণঃ “আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, ওয়ালিল্লাহিল হামদ”। অর্থ: আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান; আল্লাহ মহান, আল্লাহ ব্যতিত কোনো উপাস্য নেই; সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আল্লাহ মহান।
  • কুরবানির গোশতের ৩ ভাগের এক ভাগ নিজের জন্য রাখা। বাকি দুই ভাগের ১ ভাগ গরিবদের আর আরেক ভাগ প্রতিবেশি ও আত্মীয়দের মাঝে বণ্টন করা উত্তম। অমুসলিমদেরকেও কুরবানির গোশত খেতে দেয়া যাবে। আমাদের গ্রামে প্রতিটা পশুর ৩ ভাগের এক ভাগ একত্রে জমা করা হয়। এরপর গ্রামে যারা কুরবানি দেয় নি তাদের পরিবারের সদস্যদের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পরিমাণে গোশত বিতরণ করা হয়। ঈদের ঐ ২-৩ দিন আমাদের গ্রামের প্রতিটা ঘরেই গোশত রান্না হয়। গ্রামের অসংখ্য কুৎসিত জিনিসের মাঝে এই জিনিসটা সবচেয়ে ভাল একটা কাজের উদাহরণ।
  • কুরবানির পশুর রক্ত ও অন্যান্য আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা বা মাটি চাপা দেয়া। কোন ক্রমেই যেন পরিবেশ দুর্গন্ধময় না হয়।

যে সব কারণে কুরবানি শুদ্ধ হবে না / ঈদুল আযহার বর্জনীয় কাজ

  • গোশত খাওয়ার নিয়তে কুরবানি করলে
  • হারাম উপার্জনের টাকায় কুরবানির পশু ক্রয় করা হলে
  • ‘আল্লাহ খুশি হবেন, আবার গোশতও খাওয়া হবে’ এমন চিন্তা করে কুরবানি করলে
  • কুরবানির পশুর ভাগিদারদের মধ্যে কোন একজন ভাগিদারের নিয়তে ঘাপলা থাকলে বাকিদের কুরবানিও শুদ্ধ হবে না
  • ভাগিদারদের মধ্যে কোন একজনেরও যদি পশু কেনার টাকা হারাম উপার্জনের হয়ে থাকে তাহলেও কারো কুরবানি শুদ্ধ হবে না
  • জিলহজ্জের ১০ তারিখ ফজরের আগে ও ১২ তারিখ মাগরিবের পরে কুরবানি করলে কুরবানি আদায় হবে না
  • ‘বড় গরু কুরবানি না দিলে কি ইজ্জত থাকে?’ এমন লোক দেখানো মনোভাবের কারণেও কুরবানি শুদ্ধ হবে না
  • ‘গরুটা কিন্যা জিতছি” বা “গরুটা কিন্যা ঠগা হইছে” এই রকম মন্তব্য করা বা মনে আনাও অনুচিত। কারণ কুরবানি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। যা লাভ-ক্ষতির ঊর্ধ্বে
  • “গরুর দাম এত টাকা। মোট গোশত হইছে এত কেজি। তার মানে প্রতি কেজির দাম পড়ছে এত টাকা” এই ধরণের হিসাব-নিকাশ করতেও ওলামাগণ নিষেধ করে থাকেন। কুরবানির গোশতের দাম বের করা, বাজারের গোশতের দামের সাথে তুলনা করে লাভ-লোকসানের চিন্তা করাটা সম্ভবত দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক
  • “এইবারের গরুর গোশতটা জানি ক্যামন? খুব একটা খাইতে পারি নাই” বা “গোশত যা খাওয়া খাইছি!!!” অথবা “ভাই গোশত খাইলেন ক্যামন?” এই ধরণের কথাগুলোও সম্ভবত কুরবানির দর্শনের পরিপন্থি
  • বাড়িতে জ্বীন বা শয়তান প্রবেশ করবে না এই উদ্দেশ্যে কুরবানির পশুর রক্ত বাড়ির চারিদিকে ছিটানো একটি মনগড়া কাজ। বা গাছে কুরবানির পশুর মাথার হাড় বা শিং ঝুলিয়ে রাখা। এগুলোর কোনটিই ইসলামের সহিহ দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়।

কুরবানির পর শরীকদের নাম উচ্চারণ করে পাঠ করা একটি অহেতুক কাজ

গরু কুরবানির ক্ষেত্রে একটা miss concept আছে অনেকের মধ্যে যে ভাগ হতে হবে বিজোড় সংখ্যায়। ১, ৩ বা ৭ এরকম। পুরোটাই বোগাস একটা চিন্তা। একটা গরু ১ জনের নামে কুরবানি করা যেতে পারে, ২ জন, ৩ জন, ৪ জন, ৫ জন, ৬ জন বা ৭ জনের নামেও কুরবানি করা যাবে। জোড়-বিজোরের কোন মাহাত্ম এই ক্ষেত্রে নাই। কোন একটা গরুর ৭ ভাগের মধ্যে কারো যদি আক্বিকার ভাগ থাকে তাহলেও কুরবানি-আক্বিকা উভয়ই শুদ্ধ হবে।
পশু জবাইয়ের পর হুজুররা কুরবানি দাতাদের পীড়াপিড়িতে একটা কাজ করতে বাধ্য হন। তা হচ্ছে ৭ শরীকের সবার নাম, বাবার নাম পড়া। কুরবানি নিয়ে যতটা না সবাই চিন্তিত হয় তার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয় নামটা ঠিকঠাক পড়া হল কিনা। ব্যাপারটা এমন যে, হুজুরের মুখে কুরবানি দাতার নাম উচ্চারণ না করলে যেন আল্লাহ কুরবানি দাতার ব্যাপারে জানবেনই না (নাউযুবিল্লাহ)। শুধু শরীকের নাম বললেই হবে না, তার বাবার নাম বলতে হবে। বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে আবার সিসটেম আলাদা। স্বামীর নাম বলতে হবে!!! stupidity at it’s best!!!
কুরবানির জন্য সেরেফ মনে মনে নিয়ত করাই যথেষ্ট। হুজুরকে দিয়ে কুরবানি দাতার নাম ও কুষ্ঠি পাঠ করানোর মধ্যে নূন্যতম কোন extra good things নাই। আল্লাহ আমাদের সকলের মনের খবর জানেন। হুজুর জবাইয়ের পরে আপনার নামের জায়গায় ভুলে আমার নাম বললেও কুরবানি কিন্তু আপনারটাই আদায় হবে। আমারটা আদায় হবে না। তাহলে কেন এই নাম পড়ার আয়োজন করা হয়? আসুন এবারই এই অহেতুক কাজটা এড়িয়ে যাই।

কুরবানির দিন মুরগি জবাই নিয়ে গ্রাম্য একটা ভুল ধারণা

আমাদের গ্রামে কুরবানির দিন কোন বাড়িতে হাস-মুরগি জবাই করা কঠিন ভাবে নিষেধ। গ্রামের মুরুব্বিরা তাদের মুরুব্বিদের থেকে শুনে আসা ভ্রান্ত ধারণার লালন করেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। এখন থেকে ৮-১০ বছর আগে গ্রামে গিয়ে শুনি “কুরবানির দিন দো পায়া জানোয়ার জবাই করা নিষেধ”। কারণ হিসেবে তারা মনে করেন ইসমাঈল (আঃ) এর মানুষ ছিলেন আর মানুষ হিসেবে তাঁর ছিল দুই পা। তাই হাস-মুরগি জবাই করলে তা ইসমাঈল (আঃ) এর দিকেই ধাবিত হয়। এই ফালতু কথা আমাদের গ্রামের লোকজন কোথা থেকে পেল জানি না। আমি মাদরাসায় পড়ার সুবাদে আমার টিচারদের সাথেও তাদেরকে কথা বলিয়ে দিলাম। তারা সেইসব কথা মানতে নারাজ। তাদের মতের বাইরের কোন তথ্য সামনে আসলেই তারা নবীর (সাঃ) যুগের ইসলাম বিরোধীদের মত বলে ওঠে “বাপ-দাদা, ময়-মুরুব্বিরা যেগুলা কইরা গেছে তারা কি ভুল আছিল? তোরা দুই লাইন সিপারা পইড়াই বিরাট তালেবর সাজোস!!! কত নতুন নতুন হাদীস শুনাবি আর???” আমাদের মানিকগঞ্জ জেলায় এইরকম বেশ কিছু কুসংস্কারের লালন-পালন হয়ে আসছে বহুদিন থেকে। অন্যান্য জেলাতে এই ধারণা আছে কিনা আমার জানা নাই। পাঠকের কাছে অনুরোধ থাকলো আপনার জেলার এরকম মনগড়া ব্যাপারগুলো শেয়ার করার জন্য।
কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে আরেকটা ভয়ংকর রেওয়াজ। যারা গরিব বা কুরবানির সামর্থ নাই তারা কুরবানির নিয়তে মোরগ জবাই দিয়ে থাকে। এটাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কুরবানির নিয়তে গরু, ছাগল, উট, দুম্বা, ভেড়া, মহিষ ব্যাতিত অন্য কোন পশু কুরবানি জায়েজ নাই। ঈদের দিন সকলেই ভাল খাবার খেতে চায়। সে হিসেবে হাস-মুরগি জবাই করে খাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু মনের মধ্যে এই নিয়ত রাখা যাবে না যে “আমি যেহেতু কুরবানি দিতে পারছি না, তাই মুরগি জবাই করি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য”।

কুরবানির চামড়া নিয়ে এলাকার প্রভাবশালীদের নির্লজ্জ ব্যবসা

কুরবানির পশুর চামড়া কেউ যদি চায় শুকিয়ে প্রকৃয়াজাত করে নিজে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সেটা বিক্রি করতে পারবে না বা বিক্রি করলেও সেই অর্থ নিজে ব্যবহার করতে পারবে না, বরং গরিবদেরকে দান করে দিতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে কেউ সাধারণত নিজে চামড়া প্রকৃয়াজাত করে ব্যবহার করে না তাই সাধারণত এটা বিক্রি করে এর মূল্য দান করা হয় গরিব-মিসকিনদেরকে। চামড়ার মূল্য দান করার খাত যাকাতের অর্থ দান করার খাতের অনুরূপ। অর্থাৎ যারা যাকাতের অর্থ খাওয়ার অধিকার রাখে তারাই কুরবানির পশুর চামড়ার মূল্য পাওয়ার অধিকার রাখে। বেশির ভাগ সময় সবাই চেষ্টা করে কুরবানির পশুর চামড়া কোন মাদরাসায় দান করে দিতে। কেননা মাদরাসায় অনেক এতিম ও দরিদ্র শিক্ষার্থী থাকে যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব মাদরাসাগুলো নিয়ে থাকে।
কিন্তু অত্যন্ত লজ্জা আর জঘন্য একটা ব্যাপার চোখে পড়ে এই ঈদের দিন। এলাকায় সরকার-দলীয় নেতাকর্মীরা টাকার বান্ডিল হাতে নিয়ে দল বেধে ঘুরে বেড়ায়। যেখানে একটা গরুর চামড়ার দাম ২০০০ টাকা তারা সেই চামড়ার দাম বলে ৫০০ টাকা। ঢাকায় আমার কলোনি, আমার পাশের কলোনিতে দেখেছি কিভাবে জিম্মি করে জোর করে তারা এই চামড়া কিনে থাকে। একবার দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল এলাকার নেতারা মাদরাসার ছাত্রদের থেকে চামড়া রেখে দিচ্ছিল। মানুষজন চাইলেও মাদরাসার ছাত্রদেরকে চামড়া দান করতে পারে না। তাদের গুন্ডা বাহিনি এলাকায় কখনো কখনো সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিয়ে থাকে। যেন একটা চামড়াও অন্য কোন পার্টি বা মাদরাসার ছেলেপেলে নিতে না পারে। কুরবানি দাতার কাছে এসে তারা আবদারের সুরে বলে “কাকা, বৎসরে একটা দিনই তো! দিয়া দেন…”। এর মানে কি? বছরের এই একটা দিন আপনারা মিসকিন হয়ে গেছেন? এতিম-মিসকিনের হকটা তাই এই দিনেই মেরে খেতে হবে?
আপনার গরুর চামড়াটা যদি মাদরাসায় দান করে দেন তাহলে হয়ত এটা ২০০০ টাকায় বিক্রি করতে পারবে। পুরো টাকাটা সঠিক খাতে ব্যয় হবে। আপনি যদি মাদরাসার ছাত্রদের কাছে চামড়াটা ১০০০ টাকায় বিক্রি করেন তাহলে তারা এটা ২০০০ টাকায় বিক্রি করবে। ১০০০ টাকা তারা লাভ করতে পারবে। আর আপনি চামড়া বিক্রির ১০০০ টাকা আপনার পরিচিত কোন গরিব মানুষকে দিতে পারলেন। তাহলেও এই টাকার সঠিক ব্যবহার হল। কিন্তু, যদি ভদ্রবেশী এই নির্লজ্জ নেতা-ফেতাদের কাছে ৫০০ টাকায় বিক্রি করেন তাহলে আসল হকদার পাবে ৫০০ টাকা। বাকি ১৫০০ টাকা ঢুকবে এই সন্ত্রাসীদের পকেটে। সন্ত্রাসী বললাম এই কারণে যে তারা ত্রাস সৃষ্টি করেই আপনার থেকে কুরবানির চামড়া আদায় করবে। চামড়া নিয়ে গুলাগুলো-কোপাকোপির ঘটনা খুবই সাধারণ ব্যাপার। গত বছর আমাদের সরকারি কলোনিতে আমার আব্বু সহ আরো কয়েকজনকে মুখের সামনে গালাগালি করে গেল এলাকার নেতারা। আমাদের অপরাধ ছিল গরুর চামড়াটা মাদরাসায় দান করে দিয়েছিলাম।
এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা কখনো কখনো দেখা যায় মাদরাসার ছাত্রদের চেয়ে চামড়ার দাম কিছুটা বেশি বলে। হয়ত কয়েকশ টাকা বেশি। আপনি তাদের কাছে বিক্রি করলেও প্রকৃত হকদারেরা কিছুটা হলেও বঞ্চিত হল।
তাই সকলের প্রতি অনুরোধ, এলাকার ছিচকে সিজনাল চামড়া ব্যবসায়ীদের কাছে আপনার পশুর মূল্যবান চামড়া বিক্রি করবেন না। ভাল হয় যদি কোন মাদরাসায় পুরোটা দান করে দিতে পারেন। অথবা মাদরাসার কাছে নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করেন। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত যেন দরিদ্রদের এই হকটা তারাই যেন পায়।
আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার  মরন বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। (সূরা আন’আম – ১৬২)
আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরবানি করার তৌফিক দিন। আমাদের সকলের কুরবানি কবুল করুন। আমীন।
[বিঃ দ্রঃ এটা আমার কোন মৌলিক লেখা নয়। কিছু তথ্যের সন্নিবেশ করেছি মাত্র। কোথাও কোন তথ্যগত ভুল চোখে পড়লে অনুগ্রহ করে জানাবেন। জিলহজ্জ মাসের প্রথম ১০ দিন অনেক বরকতময়। 

সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭

শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ,করণীয়-বর্জনীয়

শবে মিরাজ’ বা ‘লাইলাতুল মিরাজ’- ফারসি
শব্দ। যার অর্থ হলো রাত, রাত্রি বা রজনী। আবার ‘লাইলাতুন’
আরবি শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে রাত বা রজনী। আর ‘মিরাজ’ আরবি
শব্দ। এর অর্থ উর্ধ্বগমন বা উর্ধ্ব গমনের বড় মাধ্যম। ‘শবে মিরাজ’
শব্দ দুটির সম্মিলিত শাব্দিক অর্থ হলো- উর্ধ্বগমনের রাত বা
রজনী। ইসলামী পরিভাষায় রাসূল (সা.) যে রাতে আল্লাহ
রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছায় তার ডাকে সাড়া দিয়ে উর্ধ্ব
আকাশে গমন করেছিলেন সেই রাত ও সেই শুভ ও পবিত্র
যাত্রাকে ‘শবে মিরাজ’ বা ‘লাইলাতুল মিরাজ’ বলা হয়। [আল-
মুয়জামুল ওসিত]

কখন হয়েছিল শবে মিরাজ: মিরাজের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি
কোন তারিখে সংঘটিত হয়েছে এ ব্যাপারে বিভিন্ন
মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকদের মতে,
রাসূলের (সা.) নবুয়তের ৫ম বছর এই ঘটনাটি সংঘঠিত হয়েছে।
আবার কারো কারো মতে, নবুয়তের ৬ষ্ঠ বর্ষে। এভাবে দ্বাদশ
বর্ষে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে মতামত পাওয়া যায়। তবে
হাদিসের নির্ভরযোগ্য বর্ণনা ও অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের
প্রসিদ্ধ মতামত হলো- পবিত্র এই ঘটনা রাসূলের (সা.) নবুয়তের
৫ম বছর ২৭ রজব রাতে সংঘঠিত হয়েছে।
মিরাজ সংঘঠিত হয়েছিল কেন: মিরাজের ঘটনা রাসূলের (সা.)
জীবনের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বিষয়। রাসূলের (সা.)
আগে অন্য কোনো নবী-রাসূলের জীবনে এমন ঘটনা ঘটেনি।
আল্লাহ মহান এই রাতে তার সংস্পর্শ শুভ্রতার উপহার হিসেবে
উম্মতে মুহাম্মাদীকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান দান
করেছেন। তাই রাসূল (সা.) নামাজের ব্যাপারে বলেছেন,
‘নামাজ হলো মুমিনের মিরাজ।’
শবে মিরাজ ও নফল নামাজ: আবার অনেক মুসলিম ভাই ও বোনরা
শবে মিরাজ উপলক্ষে কেউ ১২ রাকাত, কেউ ২০ রাকাত নামাজ
আদায় করে থাকেন। ইসলামী শরীয়তেও শবে মিরাজের নামাজ
বলে কিছু নেই। নফল নামাজ পড়া সাওয়াবের কাজ কিন্তু শবে
মিরাজ উপলক্ষে নফল নামাজ আদায় করার কোনো ভিত্তি ও
প্রমাণ ইসলামে নেই। কাজেই শবে মিরাজের নামে নফল নামাজ
আদায় করা এবং এর ব্যবস্থা প্রণয়ন করা মানে ইসলামী শরীয়তে
নিজের পক্ষ থেকে কিছু সংযোজন করা। আর এ ব্যাপারে রাসূল
(সা.) বলেছেন, যে আমাদের ধর্মে এমন কিছু সংযুক্ত বা উদ্ভাবন
করবে, যা তার (শরীয়তের) অংশ নয়- তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
[বোখারী, ১/৩৭১]

শবে মিরাজ ও নফল রোজা: আমাদের অনেক মুসলিম ভাই ও
বোনেরা- শবে বরাত ও শবে কদরের সাথে মিলিয়ে শবে
মিরাজেও নফল রোজা রেখে থাকেন। একটি কথা বিশেষভাবে
উল্লেখ্যযোগ্য- নফল রোজা যখন ইচ্ছা তখন রাখা যায় কিন্তু
কোনো উপলক্ষে নফল রোজা রাখতে হলে অবশ্যই আগে জেনে
নিতে হবে যে আমি বা আমরা যে উপলক্ষে নফল রোজা রাখছি
শরীয়ত সেটাকে অনুমতি দিয়েছে কিনা। শবে মিরাজ উপলক্ষে
নফল রোজা রাখার কোনো বর্ণনা কোরআন-হাদিসের কোথাও
বর্ণিত নেই। আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তার অনুসারীরা এই দিনে
বিশেষভাবে কোনো রোজা রেখেছেন এমনে কোনো বর্ণনা
ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই দিনে শবে মিরাজ
উপলক্ষে রোজা রাখা কোনো ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না।
করণীয়-বর্জনীয়: রজব মাসের শেষ দিকে শবে মিরাজ রয়েছে।
রজব মাসের ব্যাপারে বলা হয়ছে এই মাসে রমজানের প্রস্তুতি
নেওয়া এবং বেশি বেশি এই দোআ করা- ‘হে আল্লাহ আমাদের
রজব ও শাবান মাসে বরকত দাও এবং আমাদের হায়াত রমজান
পর্যন্ত দীর্ঘায়িত করো।’ এই মাসে শবে মিরাজকে উপলক্ষ না
করে নফল রোজা রাখা। রজবের ২৯ ও ৩০ তারিখে শাবানের চাঁদ
দেখার চেষ্টা করা। এছাড়া ইসলামী শরীয়ত পরিপন্থী যে
কোনো ধরনের আমল-ইবাদত ও বিদআত থেকে বিরত থাকা। এই
রাতকে কেন্দ্র করে প্রচলিত সব ধরনের প্রথা ও বিদআত বর্জন
করা। শবে মিরাজের নামাজ বলে কোনো নফল নামাজ আদায়
না করা এবং শবে মিরাজের রোজা নামে কোনো নফল রোজা
না রাখা। মসজিদ আলোকসজ্জা, তবারক বিতরণ ও মিলাদ-
কিয়াম না করা।

পরিশিষ্ট: কোনো কোনো এলাকায় খুব ধুমধামের সাথে শবে
মিরাজ পালন করা হয়। শবে মিরাজকে শবে বরাত ও শবে কদরের
মতো বরকতময় রাত মনে করা হয় এবং এই রাতে বিশেষভাবে শবে
মিরাজের নামাজ আদায় করা হয় আর পরেরদিন শবে মিরাজের
রোজা রাখা হয়। ইসলামী শরীয়তে এসব আমলের কোনো ভিত্তি
নেই। কোরআন-হাদিসে এর কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না।
সুতরাং শবে মিরাজকে শবে বরাত বা শবে কদরের মতো মনে
করা এবং উদযাপন করা সম্পূর্ণ বিদআত।

[মুফতি তাকি উসমানী ও মুফতি মুহাম্মাদ আলী রচিত
‘ফজিলতের রাত: ফাজায়েল ও মাসায়েল’ অনুবাদ: মুফতি আব্দুল
মালেক]

সোমবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৭

সহীহ হাদীসের আলোকে নামাযের কিছু জরুরী মাসয়ালা

১. নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় দুই পায়ের মাঝখানে ফাঁকা
রাখা

ইমাম, মুক্তাদী কিংবা একা নামায আদায়কারী প্রত্যেকেই
নিজ নিজ শরীরের গঠন অনুযায়ী দুই পায়ের মাঝখানে এতটুকু
ফাা রেখে দাঁড়াবে যেন পায়ের আঙ্গুলগুলো কেবলামুখী হয়ে
থাকে এবং দাঁড়ানো, রুকু ও সেজদার সময় ব্যবধান বৃদ্ধি করার
বা সংকোচ করার কোনো প্রয়োজন না হয়। উভয় পায়ের
আঙ্গুলসমূহ কিবলামুখী করে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াবে।
হযরত আবূ হুরায়রা রাসূল (সা.) বলেন, যখন তোমারা নামাযে
দাঁড়াবে (ইচ্ছা করবে) তখন ভালোভাবে অযু করবে। অতঃপর
পরিপূর্ণরূপে কেবলামুখী হবে এবং তাকবীর বলবে। (বুখারী
শরীফ ২/৯২৪, হা.৬২৫১, তিরমিযী শরীফ ১/৬৬ ত্বা. ৩০৪ সহীহ)
বিজ্ঞ ইমামগণের গবেষণা মতে পুরুষের উভয় পায়ের মাঝে
নিম্নে চার আঙ্গুল ঊর্ধ্বে এক বিঘত পরিমাণ ফাকা রাখা হবে
স্বাভাবিক পরিমাণ।
আর মহিলাগণ উভয় পায়ের গোড়ালি মিলিয়ে রাখবে। হযরত
আব্দুল্লহ্ ইবনে আব্বাস (রা) কে মহিলাদের নামায সম্পর্কে
জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন : সংকোচিত ও (শরীরের অঙ্গ)
মিলিয়ে নামায পড়বে। (মুসান্নাফে আবী শায়বা : ১/২৭০, হা.
২৭৯৪ সহীহ)

২. তাকবীরে তাহরীমার সময় কান পর্যন্ত হাত উঠানো

তাকবীরে তাহরীমার সময় উভয় হাত কান পর্য উঠানো সুন্নত।
অর্থাৎ উভয় হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির মাথা কানের লতি পর্যন্ত
উঠানো। (মুসলিম শরীফ ১/১৬৮ ত্বা ৩৯১)
হযরত মালেক ইবনে হুয়াইরিস (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা)
যখন তাকবীর বলতেন তখন দুই কান পর্যন্ত হাত উঠাতেন। (মুসলিম)
মহিলাগণ তাদের হাত বুক বা কাধ পর্যন্ত উঠাবে এবং কাপড়ের
ভেতর থেকে হাত বাহিরে রাখবে না। (তিরমিযী ১/২২২ ত্বা
১১৭৩ সহীহ)

৩. নামাযে কব্জির উপর হাত বাঁধা এবং নাভীর নিচে রাখা

সুন্নাত
নামাযে বাম হাতের কব্জির উপর ডান হাত রাখা এবং দুই
আঙ্গুল দ্বারা চেপে ধরা সুন্নাত। একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা
এ আমল প্রমাণিত। চার মাযহাবের ইমাম এবং জমহুর আলেমগণ
এটাকেই সুন্নাত পদ্ধতি আখ্যা দিয়েছেন।
প্রমাণ :
১. হযরত সাহল ইবনে সা‘দ (রা) বলেন, মানুষকে এই আদেশ দেয়া
হয়েছে যে, তারা যেন নামাযে ডান হাত বাম হাতের বাহুর উপর
রাখে। (বুখারী শরীফ হাদীস নং ৭৪০)
এই হাদীসটি সম্পর্কে বুখারী শরীফের বিখ্যাত ভাষ্যকার
হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (র) বলেন, বাহুর কোনো
জায়গায় রাখতেন সেটা এই হাদীসে অস্পষ্ট।
আবূ দাঊদ ও নাসাঈ বর্ণিত ওয়াইল (রা)-এর হাদীসে বলা হয়েছে,
অতঃপর তিনি তার ডান হাত বাম হাতের তালুর পিঠ, কব্জি ও
বাহুর উপর রাখলেন। ইবনে খুযায়মা (র) প্রমুখ এটিকে সহীহ
বলেছেন। (ফাতহুল বারী : খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৭৫)
আর আল্লামা শাওকানী রহ. নায়লুল আওতার গ্রন্থে বলেছেন :
হাদীস শরীফে যে বলা হয়েছে, ‘বাম হাতের বাহুর উপর” বাহুর
কোন্ জায়গা তা এখানে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে।
মুসনাদে আহমাদ ও আবূ দাঊদ শরীফে বর্ণিত হাদীসে তার
ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে আর তা হলো তিনি তার ডান হাত বাম
হাতের পিঠ কব্জি ও বাহুর উপরে রেখেছেন। তাবারানী রহ. এর
বর্ণনায় এসেছে, তিনি নামাযে তার ডান হাত বাম হাতের
পিঠের উপর কব্জির কাছে রেখেছেন। (খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৮৭)
২. হযরত হুলব আততাঈ (রা) বলেন, রাসূল (সা) আমাদের ইমাম
হতেন। তিনি ডান হাত দ্বারা বাম হাত চেপে ধরতেন।
(তিরমিযী শরীফ : হাদীস নং ২৫২)
এ বিষয়ে আরো যত সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে সবগুলোর মধ্যে
সমন্বয় করে চার মাযহাবের আলেমগণ সেই পদ্ধতিকেই অবলম্বন
করেছেন, যেভাবে হানাফী মাযহাবের অনুসারীগণ আমল করে
থাকেন। একেই বলে হাদীসের অনুসরণ। এরাই প্রকৃত হাদীস
অনুসারী। আর যারা একটি হাদীস নিয়ে সবগুলো উপেক্ষা করে
তারা মূলত নামের আহলে হাদীস। প্রকৃত হাদীস অনুসারী নয়।
* নাভীর নিচে হাত রাখা সুন্নাত

উল্লিখিত পদ্ধতি অনুযায়ী হাত বাধার পর নাভীর নিচে হাত
রাখা সুন্নাত। তবে ইমাম শাফয়ী রহ. বুকের নিচে রাখার কথা
বলেছেন। কিন্তু বুকের উপর হাত বাধার সুন্নত হওয়ার কথা কেউ
বলেননি। বুকের উপর হাত বাঁধার ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস
নেই।
প্রমাণ :
১. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা) বলেন, আমি রাসূল (সা) কে
নামাযে ডান হাত বাম হাতের উপর রেখে নাভীর নিচে রাখতে
দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৩৯৫৯)
২. হযরত আলী (রা) বলেন, নামাযের সময় সুন্নত হলো হাত তালুর
উপর রেখে নাভীর নিচে রাখা। (আবূ দাঊদ শরীফ, হাদীস নং
৭৫৬)
৩. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, হাতের তালু অপর তালুর উপর
রেখে নাভীর নিচে রাখতে হবে। (আবূ দাঊদ শরীফ, হাদীস নং
৭৫৮)
৪. সানা পড়া
তাকবীরে তাহরীমার পর সানা পড়া সুন্নাত। (আবূ দাঊদ শরীফ :
১/১১১ ত্বা. ৭৬৪)
সানা হলো : সুবহানাকা ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﺍﻟﻠﻬُﻢَّ ﻭَﺑِﺤَﻤْﺪِﻙَ، ﺗَﺒَﺎﺭَﻙَ ﺍﺳْﻤُﻚَ، ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ ﺟَﺪُّﻙَ، ﻭَﻟَﺎ
ﺇِﻟَﻪَ ﻏَﻴْﺮُﻙَ হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেছেন, রাসূল (স) নামায শুরু
করার সময় বলতেন সুবহানাকা ﺳُﺒْﺤَﺎﻧَﻚَ ﺍﻟﻠﻬُﻢَّ ﻭَﺑِﺤَﻤْﺪِﻙَ، ﺗَﺒَﺎﺭَﻙَ ﺍﺳْﻤُﻚَ، ﻭَﺗَﻌَﺎﻟَﻰ
ﺟَﺪُّﻙَ، ﻭَﻟَﺎ ﺇِﻟَﻪَ ﻏَﻴْﺮُﻙَ নাসায়ী শরীফ হাদীস নং ৮৯৯

৫. ইমামের পেছনে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা পড়বে না

অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেঈনের মতে ইমামের পেছনে
মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে না। ইমাম আবূ হানীফা,
ইমাম মালেক ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) তিনজনই এ
ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। শুধুমাত্র ইমাম শাফেয়ী (র)
বলেন কেবল জোহর ও আসরের নামাযে মুক্তাদী সূরা ফাতিহা
পড়বে। সুতরাং সূর ফাতিহা ছাড়া মুক্তাদীর নামায হবেই না,
ঢালাওভাবে একথা বলা বিভ্রান্তিমূলক।
প্রমাণ :
১. মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ১৭৪ নং পৃষ্ঠায় হযরত আবূ মূসা
আশআরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসূল (সা)
ওয়াজ করেন। তখন আমাদেরকে সুন্নত শিক্ষা দেন। এবং
নামাযের পদ্ধতি বর্ণনা করে বলেন, যখন তোমরা নামাযে
দাঁড়াবে তখন কাতার ঠিক করে নিবে। এরপর তোমাদের একজন
ইমাম হবে। আর সে (্ইমাম) যখন তাকবীর বলবে তখন তোমরা
তাকবীর বলবে। তবে সে যখন কেরাত পড়বে তখন তোমরা নীরব
থাকবে।
২. হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) বলেন যে
ব্যক্তি ইমাম রয়েছে, (অর্থাৎ যে ইমামের পেছনে নামায
পড়ছে) তার ইমামের কেরাতই তার কেরাতের জন্য যথেষ্ট হবে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ :পৃ. ৬১ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা খ. ১,
পৃ ৩৭৬)
৩. তাবেয়ী হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (র) বলেন যে, তিনি
ইমামের সঙ্গে কেরাত পড়া সম্পর্কে যায়েদ ইবনে ছাবিত (রা)-
কে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি জবাব দিলেন যে, কোনো
নামাযেই ইমামের সঙ্গে কোনো কিছু পড়বে না। (মুসলিম শরীফ,
হাদীস নং ৫৭৭)
সূরা ফাতিহা না পড়েই যদি আগন্তুক মুক্তাদী ইমামের সাথে
রুকুতে শরীক হতে পারে তাহলে সে রাকাত পেল বলে গণ্য করা
হয়। সুতরাং বিবেকবান সবার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে,
মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পড়া লাগবে না।

৬. নামাযে একান্তে অনুচ্চস্বরে আমীন বলা সুন্নত

ইমাম যখন সূরা ফাতিহা শেষ করবে তখন সকলে আমীন বলা
সুন্নত। তবে এ ক্ষেত্রে আস্তে ও অনুচ্চস্বরে আমীন বলবে।
কেননা অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল দ্বারা তা
প্রমাণিত। সুতরাং যারা বলেন আস্তে বলা সুন্নত পরিপন্থী
তাদের কথা সঠিক নয়।
প্রমাণ :
১. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
আমাদেরকে নিয়ে রাসূল (স) নামায পড়লেন। তিনি যখন ﻏَﻴْﺮِ
ﺍﻟْﻤَﻐْﻀُﻮﺏِ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢْ ﻭَﻻَ ﺍﻟﻀَّﺎﻟِّﻴﻦَ পড়লেন তখন ﺁﻣِﻴﻦَআমীন বললেন। এবং আমীন
বলার সময় তার আওয়াজকে নিম্ন (আস্তে) করলেন। (তিরমিযী
শরীফ : ২৪৯)।ইমাম হাকেম রহ. যাহাবী রহ. এবং ইবনে জারীর
তাবারী রহ. হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।
২. ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (র) তার তাহযীবুল আছার গ্রন্থে
বলেছেন, সঠিক কথা হলো আমীন আস্তে বলা ও জোরে বলার
উভয় হাদীস সহীহ। এবং দুটি পন্থা অনুযায়ী এক এক জামাত
আলেম আমলও করেছেন। যদিও আমি আস্তে আমীন বলাই
অবলম্বন করেছি। কেননা অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ী এ
অনুযায়ীই আমল করতেন। Ñ(আল জাওহারুল নাকী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা
৫৮)
অধিকন্তু আমরা বলব যে, মদীনা শরীফে ইমাম মালেক (র) এর
নিবাস ছিল। তার মূলনীতি ছিল, কোনো বিষয় সহীহ হাদীসে
পাওয়া গেলেও মদীনাবাসীর আমল কি ছিল সেদিকে লক্ষ্য
রাখতেন। তিনিও ফতুয়া দিয়েছেন যে, মুক্তাদী আস্তে আমীন
বলবেন। (আল মুদাওয়ানা, খন্ড ১, পৃষ্ঠা ৭১)
৩. হযরত উমর (রা) এর ফতুয়া: হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আবী
লায়লা (রা.) বলেন, হযরত ওমর (রা) বলেছেন যে, ইমাম চারটি
বিষয় আস্তে পড়বে, আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, আমীন ও
রাব্বানা লাকাল হামদ। Ñ(আল মুহাল্লা, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ২৮০)

৭. শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত তোলা সুন্নাত

নামায শুরু করার সময় যখন প্রথম তাকবীর বলবে তখনই শুধু কান
পর্যন্ত হাত তোলা সুন্নাত। রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু থেকে
উঠার সময় হাত উঠানো হবে না। একাধিক সহীহ হাদীস,
অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল দ্বারা তা প্রমাণিত।
দলীল :
১. হযরত আলকামা রহ. বলেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ
(রা) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে নিয়ে রাসূল (স) এর
নামাযের মতো নামায পড়ব না? একথা বলে তিনি নামায
পড়লেন এবং তাতে শুধু প্রথম বারই হাত তুলেছিলেন। (আবূ দাঊদ
শরীফ, হাদীস নং ৭৪৮, তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৫৭,
নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ১০৫৮)
২. হযরত আসওয়াদ রহ. বলেছেন, আমি হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব
(রা) কে দেখেছি, তিনি প্রথম তাকবীরের সময় হাত তুলতেন,
পরে আর তুলতেন না। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং
২৪৬৯)
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা) বলেন, আমি রাসূল (স)-এর
পেছনে আবূ বকর ও ওমর (রা)-এর পেছনে নামায পড়েছি। তারা
কেবল তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠাতেন। (সুনানে
বায়হাকী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৭৯)

৮. সেজদায় যাওয়ার সময় আগে হাঁটু, পরে হাত, তারপর নাক

এরপর কপাল রাখা সুন্নাত
দাঁড়ানো অবস্থা থেকে সেজদায় যাওয়ার সময় আগে হাটু
জমিনে রাখবে, এরপর মাটিতে হাত রাখবে। এরপর নাক, এরপর
কপাল, এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সুন্নত।
দলীল :
হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা) বলেন, আমি রাসূল (স)-কে দেখেছি
তিনি যখন সেজদায় যেতেন তখন হাত রাখার আগে হাটু
রাখতেন। আর যখন সেজদা থেকে উঠতেন তখন হাঁটুর পূর্বে হাত
উঠাতেন। (আবূ দাঊদ শরীফ, হাদীস নং ৮৩৮, তিরমিযী শরীফ,
হাদীস নং ৩৬৮, নাসায়ী শরীফ, হাদীস নং ১০৮৯)
ইমাম তিরমিযী রহ. এই হাদীস উল্লেখ করে বলেন, এই হাদীস
অনুসারে অধিকাংশ আলেমের আমল। তারা মনে করেন, হাত
রাখার পূর্বে হাঁটু রাখবে। এবং হাঁটুর পূর্বে হাত উঠাবে না।

৯. প্রথম রাকাত শেষ করে সোজা উঠে দাঁড়ানো সুন্নাত

প্রথম রাকাতের সেজদা শেষ করে সরাসরি দাঁড়িয়ে যাওয়া
এবং না বসা সুন্নাত।
দলীল :
১. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, নবী করীম (স) নামাযে
ভুলকারী অনেক ব্যক্তিকে বলেছেন, তুমি যখন নামায পড়তে
ইচ্ছা কর তখন ভালোভাবে অযু করে নাও। অতঃপর কিবলামুখী
হও। আল্লাহু আকবার বলো এবং কুরআনের যতটুকু তোমার জন্য
সহজ হয় পাঠ কর। অতঃপর রুকু কর এবং স্থিরভাবে রুকু করে এরপর
মাথা তোল এবং স্থির হয়ে দাঁড়াও। এরপর সেজদা কর এবং
সেজদায় স্থির হয়ে থাক। অতঃপর ওঠ এবং স্থির ও শান্ত হয়ে
বসে পড়। এরপর আবার সেজদা কর এবং সেজদায় স্থির হয়ে
থাক। অতঃপর সোজা দাঁড়িয়ে যাও। পুরো নামাযে এভাবেই সব
কাজ কর। (বুখারী শরীফ, হাদীস নং ৬৬৫৭)
২. হযরত ইকরিমা রহ. বলেন, আমি মক্কা শরীফে এক শায়খের
পেছনে নামায পড়লাম। তিনি নামাযে ২২বার আল্লাহু আকবার
বললেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রা) কে বললাম লোকটি
আহমক। তিনি বললেন, (তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক)
এটা তো আবুল কাসেম (রাসূল) সা-এর সুন্নাত। (বুখারী শরীফ,
হাদীস নং ৭৮৮)
এ হাদীস থেকে বোঝা যায় প্রথম ও তৃতীয় রাকাতের পরে না
বসেই উঠে পড়বে। অন্যথায় বসাই যদি সুন্নাত হতো তাহলে
তাকবীর ২৪ বার হওয়া উচিত ছিল। কেননা একথা স্বীকৃত এবং
হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূল (সা) প্রত্যেক উঠাবসায়
তাকবীর বলতেন।
১০. নামাযে বৈঠকের মাসনূন পদ্ধতি
নামাযে প্রথম ও শেষ বৈঠকে বাম পা বিছিয়ে তার ওপর বসা ও
ডান পা খাড়া রাখা সুন্নাত।
দলীল :
১. হযরত আয়েশা (রা) বলেন, তিনি (রাসূল সা) প্রত্যেক দুই
রাকাতে আত্তাহিয়্যাতু পড়তেন। এবং বাম পা বিছিয়ে দিতেন
ও ডান পা খাড়া রাখতেন। (মুসলিম শরীফ, হাদীস নং ৪৯৮)
২. হযরত ওয়াইল ইবনে হুজর (রা) বলেন, আমি মদীনা শরীফে
আসলাম, আর (মনে মনে) বললাম আমি অবশ্যই রাসূল (সা)-এর
নামায দেখবো। (তিনি বলেন) যখন তিনি বৈঠক করলেন অর্থাৎ
তাশাহহুদের জন্য তখন তার বাম পা বিছিয়ে দিলেন আর ডান পা
খাড়া রাখলেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস নং ২৯২)

১১. বিতর নামায তিন রাকাত

রাসূল (সা) এর কর্ম আমল ও নির্দেশনা এবং তার একনিষ্ঠ
অনুসারী খুলাফায়ে রাশেদীন অধিকাংশ সাহাবা-
তাবেয়ীনের বর্ণনাও আমল থেকে প্রমাণিত যে, বিতর নামায
তিন রাকাত। দ্বিতীয় রাকাত শেষে প্রথম বৈঠকে তাশাহহুদ
পড়ে তৃতীয় রাকাতের জন্য উঠে যাবে। তৃতীয় রাকাতে সূরা
মিলানোর পর তাকবীর বলে দোয়ায়ে কুনুত পড়বে।
দলীল :
১. হযরত আবূ সালামা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আয়েশা
(রা) কে জিজ্ঞেস করলেন যে, রাসূল (স)-এর নামায কেমন
হতো? তিনি উত্তরে বললেন, রাসূল (সা) রমযানে এবং রমযানের
বাইরে এগারো রাকাতের বেশি পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত
পড়তেন যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না।
এরপর আরো চার রাকাত পড়তেন, যার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা
সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। এরপর আরও চার রাকাত পড়তেন, যার
সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে প্রশ্ন করো না। এরপর তিন রাকাত
(বিতর) পড়তেন। (সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নং ১১৪৭)
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী কাইস বলেন আমি হযরত আয়েশা
(রা)-এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম যে, নবীজী (সা) বিতরে কত
রাকাত পড়তেন? উত্তরে বলেনÑ চার ও তিন, ছয় ও তিন, আট ও
তিন বরং দশ ও তিন। তিনি বিতরে সাত রাকাতের কম এবং তের
রাকাতের অধিক পড়তেন না। (সুনানে আবূ দাঊদ, হাদীস নং
১৩৫৭)
৩. সহীহ মুসলিম শরীফের বর্ণনায় আছে যে, অতঃপর রাসূল (সা)
এভাবে তিন বার ছয় রাকাত নামায আদায় করলেন। প্রতি বারই
মিসওয়াক ও অযু করেছেন। এবং উপরোক্ত আয়াতগুলো পড়েছেন।
সবশেষে তিন রাকাত বিতর পড়েছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং
৭৬৩)
৪. হযরত উবাই ইবনে কা‘ব (রা) বলেন, রাসূল (সা) তিন রাকাত
বিতর পড়তেন, প্রথম রাকাতে সূরা আলা। দ্বিতীয় রাকাতে সূরা
কাফেরুন তৃতীয় রাকাতে সূরা ইখলাস পড়তেন। এবং রুকুর পূর্বে
দোয়া কুনুত পড়তেন। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ১৬৯৯)
৫. হযরত যাযান র. বলেন যে, হযরত আলী (রা) তিন রাকাত বিতর
পড়তেন। (ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ৬৯১৪)
৬. হযরত ছাইব ইবনে ইয়াযীদ রহ. বলেন, হযরত উবাই ইবনে কা‘ব
(রা) তিন রাকাতে বিতর পড়তেন। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,
হাদীস নং ৪৬৬১)
৭. হযরত মাকহুল রহ. বলেন, হযরত ওমর (রা) তিন রাকাত বিতর
পড়েছেন। এবং দ্বিতীয় রাকাতে সালাম ফেরাননি।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস নং ৬৯০১)
৮. হযরত আবুয যিনাদ রহ. বলেন, আমি মদীনায় সাত ফকীহ অর্থাৎ
ইবনুল মুসায়্যিব, কাসিম ইবনে মুহাম্মদ, উরওয়া ইবনে যুবাইর, আবু
বকর ইবনে আব্দুর রহমান, খারিজা ইবনে যায়েদ, উবাইদুল্লাহ
ইবনে আব্দুল্লাহ ও সুলায়মান ইবনে ইয়াসার এর যুগ পেয়েছি।
যাঁরা ইলম ও তাকওয়ায় অনন্য ছিলেন। কখনো তাদের মধ্যে
মতভেদ হলেও তাদের অধিকাংশের মত অনুযায়ী কিংবা
জ্ঞানের বিচারে যিনি অগ্রগামী তাঁর সিদ্ধান্ত অনুসরণ করা
হতো। এই মূলনীতি অনুসারে তাঁদের যেসব সিদ্ধান্ত আমি ধারণ
করছি তন্মধ্যে একটি হচ্ছেÑ তাঁরা সকলেই এ ব্যাপারে একমত
যে, বিতর নামায তিন রাকাত। আর শেষ রাকাতেই কেবল
সালাম ফিরাবে। (তাহাবী : ২/২০৭)
উল্লিখিত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, সাহাবা
তাবেয়ীগণ ও নবীজীর (সা)-এর মতোই তিন রাকাত বিতর
পড়তেন। নবীজী (সা) এক রাকাত বিতর পড়েছেন এমন একটি
সহীহ হাদীসও পাওয়া যাবে না।

১২. তারাবীহ নামায বিশরাকাত

রাসূল সা., সাহাবায়ে কেরাম রা., তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীগণ
এবং মুজতাহিদ ইমামগণের আমল দ্বারা ঐতিহাসিকভাবে
প্রমাণিত যে, তারাবী নামায বিশ রাকাত।
কিন্তু ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরাবাদ থেকে সর্বপ্রথম এক
লা-মাযহাবী মৌলভী সাহেব আট রাকাত তারাবীর ফাতওয়া
প্রদান করেন। এরপর ১২৮৫ হিজরীতে পাঞ্জাব সীমান্তে
মাওলানা মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী আট রাকাত তারাবী নামায
পড়া সুন্নত হওয়ার দাবি করেন।
কিন্তু কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে তৎকালীন প্রাজ্ঞ হক্কানী
উলামায়ে কেরাম উক্ত আট রাকাত তারাবীর ফাতওয়াকে ভুল
হিসেবে প্রমাণিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৩৭৭ হিজরীতে আরবে শায়েখ নসীব রেফায়ী ও শায়েখ
নাসীরুদ্দীন আলবানী রহ. সর্বপ্রথম আট রাকাত তারাবীর মত
প্রকাশ করেন। তখন শায়েখ আতিয়্যা সালিমসহ আরবের জমহুর
উলামায়ে কেরাম তাদের উক্ত রায়কে প্রত্যাখ্যান করেন এবং
সাহাবায়ে কেরাম রা. এর যুগ থেকে চলে আসা হারামাইন
শরীফাইন তথা বাইতুল্লাহ শরীফ ও মসজিদে নববীতে বিশ
রাকাত তারাবীর আমলকে অব্যহত রাখেন। যা আজো অব্যাহত
রয়েছে।
সুতরাং আট রাকাত তারাবী পড়ার মতকে অনুসরণের অর্থ হল,
সাহাবা ও তাবেয়ীগণের অনুসৃত আমলকে প্রত্যাখ্যান করে নব্য
সৃষ্ট বিদআতি দলের অনুসরণ করা।
হাদীসে বিশ রাকাত তারাবী
১.হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রা. ইরশাদ করেন, একদা রমজান
মাসে রাসূল সা. তাশরীফ নিয়ে আসলেন, লোকদের নিয়ে চব্বিশ
রাকাত তথা চার রাকাত ফরজ ও বিশ রাকাত তারাবীহ এবং
তিন রাকাত বিতির পড়েছেন। {হাফেজ হামযা বিন ইউসুফ
সাহমীকৃত তারীখে জুরজান-১৪৬}
২.হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. ইরশাদ করেন, রমজান মাসে
রাসূল সা. বিশ রাকাত নামায [তারাবীহ] এবং বিতির পড়াতেন।
{মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা-২/২৮৬, আলমুজামুল কাবীর
লিততাবরানী-৫/৪৩৩}
৩.হযরত সায়েব বিন ইয়াযিদ রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ
লোকেরা হযরত উমর রা. এর জমানায় বিশ রাকাত [তারাবীহ
নামায] পাবন্দির সাথে পড়তেন। তিনি বলেন, এমনকি কুরআনে
কারীমের দুইশত আয়াত তিলাওয়াত করা হতো। আর হযরত উসমান
রা. এর আমলে লোকেরা দাঁড়ানোর [দীর্ঘতার কারণে] নিজের
লাঠির উপর ভর করে দাঁড়াতেন। {সুনানে কুবরা বায়হাকী-২/৪৯৬}
৪.হযরত হাসান রহ. বলেন, হযরত উমর রা. রমজান মাসে তারাবীহ
পড়ানোর জন্য হযরত উবাই বিন কাব রা. এর ইমামতীতে সকলকে
একত্র করেন। তখন হযরত উবাই বিন কাব রা. লোকদের বিশ
রাকাত [তারাবীহ নামায] পড়ান। {সুনানে আবু দাউদ-১/১৪২,
সিয়ারু আলামিন নুবালা-৩/১৭৬}
৫.হযররত আবুল হাসনা ইরশাদ করেন, হযরত আলী রা. এক
ব্যক্তিকে আদেশ দিলেন, সে যেন রমজান মাসে লোকদের বিশ
রাকাত [তারাবীহ নামায] পড়ায়। {মুসন্নাফ ইবনে আবী
শাইবা-২/২৮৫}
৬.হযরত জায়েদ বিন ওহাব রহ. বলেন, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ
রা. রমজান মাসে আমাদের নামায [তারাবীহ] পড়াতেন।
অতঃপর ঘরে যখন ফিরে যেতেন তখনও রাত বাকি থাকতো।
তিনি আমাদের বিশ রাকাত [তারাবীহ] এবং তিন রাকাত
বিতির পড়াতেন। {কিয়ামুল লাইল লিলমারওয়াজী-১৫৭}
যারা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
খোলাফায়ে রাশেদীনসহ সকল সাহাবীগণ।
ইমাম আবু হানীফা রহ.।
 ইমাম শাফেয়ী রহ.।
 ইমাম মালিক রহ.।
 ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ.।

১৩ জুমআর আগের ও পরের সুন্নাত

জুমআর নামাযের আগে ও পরে চার রাকাত করে আট রাকাত
নামায সুন্নাত। যারা বলেন জুমার আগে ও পরে সুন্নাত নেই
তারা মৌলিকভাবে নবীজী (সা) এর হাদীস সাহাবা ও
তাবেয়ীনদের আমল সম্পর্কে বেখবর।
দলীল :
১. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেছেন, রাসূল (সা) বলেছেন,
তোমাদের কেউ যখন জুমআ (ফরজ) পড়ে সে যেন বা’দাল জুমা
চার রাকাত পড়ে নেয়। (মুসলিম শরীফ : হাদীস নং ৮৮১)
২. হযরত জাবাল ইবনে সুহায়ম (সা) হযরত ইবনে ওমর (রা) সম্পর্কে
বলেছেন, তিনি কাবলাল জুমা (জুমার পূর্বে) চার রাকাত
পড়তেন। মাঝখানে সালাম ফিরাতেন না। জুমার ফরজের পর
তিনি প্রথমে দুই রাকাত, পরে চার রাকাত পড়তেন। (তাহাবী
শরীফ, এর সনদ সহীহ)
৩. হযরত আব্দুর রহমান সুলামী রহ. বলেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে
মাসঊদ (রা) আমাদেরকে কাবলাল জুমা চার রাকাত, বাদাল
জুমা চার রাকাত পড়ার নির্দেশ দিতেন। অবশেষে হযরত আলী
(রা) যখন আমাদের এখানে (কূফায়) আসলেন, তখন তিনি
আমাদেরকে বা‘দাল জুমা দুই রাকাত তারপর চার রাকাত (মোট
ছয় রাকাত) পড়ার আদেশ দিয়েছেন। (মুসান্নাফে আব্দুর
রাযযাক, হাদীস নং ৫৫২৫, এর সনদ সহীহ)
৪. হযরত ইবরাহীম নাখয়ী রহ. বলেন, সাহাবায়ে কেরাম কাবলাল
জুমআ চার রাকাত বা‘দাল জুমা চার রাকাত পড়তেন।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ৫৪০৪, ৫৪২২)

১৪. ঈদের নামাযে অতিরিক্ত ছয় তাকবীর

ঈদের দুই রাকাত নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ও রুকু সেজদার
তাকবীর ছাড়া আরো ছয়টি তাকবীর বলা সুন্নাত।
একাধিক সহীহ হাদীস এবং বহু সাহাবী ও তাবেয়ী এর ফতোয়া
ও আমল দ্বারা তা প্রমাণিত।
দলীল :
১. কাসেম আবূ আব্দুর রহমান রহ. বলেন আমাকে নবী (সা.)
আমাদেরকে নিয়ে ঈদের দিন নামায পড়লেন এবং চারটি করে
তাকবীর দিলেন। নামায শেষ করে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে
বললেন, ভুলে যেয়োনা, জানাযার তাকবীরের মতো, এই বলে
তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি গুটিয়ে বাকী চার আঙ্গুল দিয়ে ইশারা
করলেন। (তাহাবী শরীফ : খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০০)
২. হযরত সাঈদ ইবনে আদী, হযরত ইবনে মাসঊদ (রা) জিজ্ঞেস
করলে তিনি বলেন, চার তাকবীর দেবে, অতঃপর কেরাত পড়বে।
অতঃপর তাকবীর বলে রুকু করবে। এরপর দ্বিতীয় রাকাতের জন্য
দাঁড়াবে পরে কেরাত পড়বে। কেরাতের পরে চার তাকবীর
দেবে। (মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৯৩ – ২৯৪)
৩. ছয়জন সাহাবী থেকে সহীহ সনদে ঈদের নামাযে অতিরিক্ত
ছয় তাকবীরের কথা উল্লেখ রয়েছে। সেই ছয় সাহাবী হলেন,
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে
আব্বাস (রা), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা), হযরত আনাস
(রা), হযরত জাবের (রা), হযরত মুগীরা ইবনে শো‘বা (রা)।আর
তিনজন মাসঊদ (রা) ইবনে মাসঊদের মতকে সমর্থন করেছেন।
সুতরাং বলা চলে নয়জন সাহাবী থেকে সহীহ হাদীসে ছয়
তাকবীরের কথা বর্ণিত হয়েছে।
উল্লেখ্য যেখানে নয় তাকবীর বলার কথা উল্লেখ আছে,
সেখানে প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরীমা ও রুকুর তাকবীর সহ
পাঁচ তাকবীর গন্য করা হয়েছে। আর দ্বিতীয় রাকাতে চার
তাকবীর। আর যে হাদীসে চার বলা হয়েছে, সেখানে প্রথম
রাকাতের রুকুর তাকবীর ও দ্বিতীয় রাকাতে রাকাত শুরুর
তাকবীরসহ চার ধরা হয়েছে।

১৫. জানাযার নামায পদ্ধতি

হযরত ইমাম আবূ হানীফা রহ. -এর থেকে জানাযার নামাযে সূরা
ফাতেহা পড়া সুন্নাত নয়। বরং প্রথম তাকবীর বলে সানা পড়বে,
দ্বিতীয় তাকবীর বলে দুরূদ শরীফ পড়বে, তৃতীয় তাকবীর বলে
দোয়া পড়বে এবং চতুর্থ তাকবীর বলে সালাম ফিরাবে। হ্যাঁ
সানা হিসেবে (অর্থাৎ সানার পরিবর্তে) সূরা ফাতেহাও
পড়তে পারবে। কেরাত হিসেবে নয়। রাসূল (সা)-এর হাদীস,
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের আমল দ্বারাই একথা
প্রমাণিত।
দলীল :
১. হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বলেন, আমি রাসূল (সা) কে বলতে
শুনেছি, যখন তোমরা জানাযার নামায পড়বে, তখন তার জন্য
একনিষ্ঠভাবে দোয়া কর। (আবূ দাঊদ শরীফ, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৫৬)
২. হযরত নাফে রহ. থেকে বর্ণিত যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর
(রা) জানাযার নামাযে কেরাত পড়তেন না। (মুসান্নাফে ইবনে
আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২)
৩. আবুল মিনহাল রহ. বলেন, আমি আবুল আলিয়াকে জানাযার
নামাযে সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি
বললেন, আমি মনে করি সূরা ফাতিহা শুধু সে নামাযেই পড়া
যাবে সেখানে রুকু ও সেজদা রয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী
শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৪)

১৬. মহিলাদের নামায

১. দাড়ানো অবস্থায় যথা সম্ভব দু’নো পা মিলিয়ে রাখবে।
দলীল: হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: কে মহিলাদের নাময
সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, সংকোচিত ও (শরীরের
অঙ্গ) মিলিয়ে নামায পড়বে। (মুসান্নাফে আবী শায়বা:১/২৭০,
হা.২৭৯৮
২. তাকবীরে তাহরীমার সময় বুক বরাবর হাত উঠাবে।
দলীল: আমি রাসূল সা: এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি
আমাকে (অনেক কথার সাথে এ কথাও) বলেছিলেন: হে ওয়াইল
ইবনে হুজর। যখন তুমি নামায শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত
উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর । (আলমুজামুল কাবীর,
তাবরানী ১২০/২২ এই হাদিসটি হাসান)
মহিলারা বুকের উপর হাত বাঁধবে:
মহিলাগন ডান হাতের তুলূ বাম হাতের পিঠের উপর রেখে বুকের
উপর হাত বাঁধবে। পুরুষের মত নাভীর নীচে তাহ বাঁধবে না।
মহিলাদের জন্য শরীয়তের মূলনীতি হলো তারা তাদের শরীরকে
এক অঙ্গকে আরেক অঙ্গের সাথে মিলিয়ে রাখবে, তাই হযরত
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে,
মহিলা কীভাবে নামায আদায় করবে? তিনি বললেন খুব জড়সড়
হয়ে তাদের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা ১/৩০২)।
তাই আল্লামা আব্দুল হাই লখনভী রহ: বলেন যে, মহিলাদের
ব্যপারে সবাই ঐকমত্য পোষন করেছেন যে, তাদের জন্র সুন্নত হল
বুকে হাত রাখা। এটাই তাদের জন্য বেশী সতরোপযোগী।
সেআয়াহ ২য় খন্ড,১৫৬ পৃ:)
মহিলাদের সেজদার পদ্ধতি:
মহিলাগন সেজদার সময় পেট রানের সাথে এবং বাহুও
প¦ার্শদেশের সাথে মিলিয়ে রাখবে। এমনিভাবে তারা তাদের
পাকে ডান দিক দিয়ে বের করে মাটিতে বিছিয়ে দিবে। খাড়া
রাখবে না।
দলীল: রাসুল সা: নামায আদায়কারী দুই মহিলাকে অতিক্রম
করেন। তখন তিনি (তাদের উদ্দেশ্যে) বলেন, যখন তোমরা
সিজদা আদায় করবে তখন দেহের কিছু অংশ মাটির সাথে
মিশিয়ে দিবে ( অর্থাৎ শরীরকে সংকুচিত করে রাখবে) ।কারন
এ ক্ষেত্রে মেয়েরা পুরুষদের মত নয়।
(আবু দাউদ ১ম / ১১৮ পৃ:)

মহিলাদের বৈঠক পদ্ধতি:

মহিলাগন দুই সেজদার মাঝখানে এবং উভয় বৈঠকের সময় বাম
পার্শ্বের নিতম্বের উপর বসবে এবং উভয় পা ডানদিকে বের
করে দিবে। হযরত খালেদ ইবনে লাজলাজ, রহ. বলেন,
মহিলাদেরকে আদেশ করা হত তারা যেন নামাযে দুই পা ডান
দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের উপর বসে। পুরুষদের মত না বসে।
আবরন যোগ্য কোন কিছু প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার আশংকায়
মহিলাদেরকে এমনটি করতে হয়। মুসান্নাফে ইবনে আবী
শায়বা-১/৩০৩।