রোযা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রোযা লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭

প্রসঙ্গঃ তারাবীর সালাত

তারাবীহর সলাত


প্রশ্ন ১২৭ : তারাবীহ অর্থ কি? এ সলাতকে কেন তারাবীহ নামকরণ করা হল?
উত্তর : তারাবীহ শব্দের অর্থ বিশ্রাম করা। তারাবীহ বহু দীর্ঘায়িত একটি সলাত। প্রতি চার রাকআত শেষে যাতে একটু বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে সেজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে তারাবীহ।

প্রশ্ন ১২৮ : রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র তারাবীহর সালাত কী ধরণের বৈশিষ্ট মণ্ডিত ছিল?
উত্তর : লম্বা ও অনেক আয়াত এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি তারাবীহ পড়তেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ রাতের একাকী সকল সালাতই ছিল অতি দীর্ঘ। এমনকি কিয়াম, রুকু, সাজদা সবই ছিল খুব লম্বা ও ধীরস্থির।
আসসায়িব ইবনে ইয়াযিদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন :
كَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ بِالْمِئْيِنَ يَعْنِي بِمِئَاتِ الآيَاتِ حَتَّى كُنَّا نَعْتَمِدُ عَلَى الْعَصَى مِنْ طُوْلِ الْقِيَامِ
অর্থাৎ ইমাম (পাঠক) সাহেব তারাবীহতে শত শত আয়াত পড়তেন। ফলে সুদীর্ঘ সময় দাড়ানোর কারণে আমরা লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। (মুয়াত্তা)

প্রশ্ন ১২৯ : তারাবীহ সর্বপ্রথম কোথায় চালু হয়।
উ: আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে তারাবীহর সালাত সুন্নাত হিসেবে চালু করেন।

প্রশ্ন ১৩০ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নিয়মিত প্রত্যহ জামা‘আতের সাথে তারাবীহ পড়তেন?
উত্তর : না। সাহাবায়ে কিরাম দুই বা তিন রাত্রি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ইমামতিতে তারাবীহ পড়েছিলেন। উম্মাতের উপর এ সলাত ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে জামাআতের সাথে মসজিদে তারাবীহ পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,
وَلَمْ يَمْنَعْنِيْ مِنَ الْخُرُوْجِ إِلَيْكُمْ إِلاَّ أَنِّيْ خَشِيْتُ أَنْ تُفْتَرَضَ عَلَيْكُمْ وَذَلِكَ فِيْ رَمَضَانَ
অর্থাৎ (তারাবীহর সালাতে মসজিদে তোমরা একত্রিত হয়ে আমার জন্য যেভাবে অপেক্ষা করছিলে তা সবই আমি দেখেছি) কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল (আমি নিয়মিত এ সলাত আদায় করলে) তা তোমাদের জন্য ফরয হয়ে যেতে পারে। সে কারণে আমি (এ সালাতের জন্য) ঘর থেকে বের হইনি। আর এ ঘটনাটি ছিল রমযান মাসের ( কোন এক রাতে)। (বুখারী ও মুসলিম)

প্রশ্ন ১৩১ : তারাবীহর সলাত কত রাক‘আত?
উত্তর : এটি একটি ইখতিলাফী অর্থাৎ মতবিরোধ পূর্ণ মাস্আলা। কেউ কেউ বলেছেন বিতরসহ তারাবীহ ৪১ রাক‘আত। অর্থাৎ বিতর ৩ রাকআত হলে তারাবীহ হবে ৩৮ রাক‘আত। অথবা বিতর ১ রাকআত ও তারাবীহ ৪০ রাকআত। এভাবে তারাবীহ ও বিতর মিলে :
কেউ বলেছেন ৩৯ রাকআত (তারাবীহ ৩৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ২৯ রাকআত (তারাবীহ ২৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ২৩ রাকআত (তারাবীহ ২০ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১৯ রাকআত (তারাবীহ ১৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১৩ রাকআত (তারাবীহ ১১ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১১ রাকআত (তারাবীহ ৮ + বিতর ৩)
(ক) বিতর ছাড়া ২০ রাক‘আত তারাবীহ সলাতের পক্ষে দলীল হল মুসান্নাতে আঃ রায্যাক হতে বর্ণিত ৭৭৩০ নং হাদীস, যেখানে বর্ণিত হয়েছে :
أَنَّ عُمَرَ جَمَعَ النَّاسَ فِي رَمَضَانَ عَلَى أُبَي بنِ كَعَبٍ وَعَلَى تَمِيْمِ الدَّارِيْ عَلَى إِحْد‘ى وَعِشْرِيْنَ مِنْ رَكْعَةِ يَقْرَؤُنَ بِالْمَئِيين
উমার (রাযি.) রমযানে উবাই ইবনে কাব ও তামীম আদদারীকে ইমামতিতে লোকদেরকে একুশ রাকআত সলাতের প্রতি জামাআতবদ্ধ করেছিলেন। (অর্থাৎ তারাবীহ ২০ ও বিতর ১ রাকআত)
(খ) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন যে,
كَانَتْ صَلاَةُ النَّبِيِّ -صلى الله عليه وسلم- ثَلاَثَ عَشَرَةَ رَكْعَةً يَعْنِيْ مِنَ اللَّيْلِ
“নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রাতের সালাত ছিল ১৩ রাক‘আত।” (বুখারী ও মুসলিম)
(গ) মা আয়িশাহ  বলেন,
مَا كَانَ يَزِيْدُ فِيْ رَمَضَانَ وَلاَ غَيْرِهِ عَلَى إِحْد‘ى عَشَرَةَ رَكْعَةً
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ও অন্য সময়ে (রাতে) ১১ রাকআতের অধিক সলাত আদায় করতেন না। (বুখারী ও মুসলিম)
(ঘ) ইবনে ইয়াযিদ রাদিআল্লাহু আনহু বলেন,
أَمَرَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أُبَيْ بْنِ كَعَبٍ وَتَمِيْمَا الدَّارِيِّ أَن يَّقُوْمَ لِلنَّاسِ بِإحْد‘ى عَشَرَةَ رَكْعَةٍ
‘উমার ইবনু খাত্তাব রাদিআল্লাহু আনহু (তার দুই সঙ্গী সাহাবী) উবাই ইবনে কাব তামীম আদদারীকে এ মর্মে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন লোকদেরকে নিয়ে (রমযানের রাতে) ১১ রাকআত কিয়ামুল্লাইল (অর্থাৎ তারাবীহর সলাত) আদায় করে। (মুয়াত্তা মালেক)
উল্লেখ্য যে, সৌদী আরবের মসজিদগুলোতে তারাবীহ ও বিতর মিলে ১১ বা ১৩ রাকআত পড়লেও মাক্কার হারামে ও মাদীনার মসজিদে নববীতে তারাবীহ ২০ এবং বিতর ৩ মিলিয়ে মোট ২৩ রাকআত পড়ে থাকে।

প্রশ্ন ১৩২ : তারাবীহর সংখ্যার মতবিরোধের মধ্যে কোনটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য?
উত্তর : মালেকী মাযহাবের ইমাম মালেক (রহঃ) বলেছেন, একশ বছরেরও বেশী সময় ধরে লোকেরা ৩৬ রাকআত তারাবীহ পড়েছে। শাফেঈ মাযহাবের ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন যে, তিনি তারাবীহ মদীনায় ৩৬ এবং মাক্কায় ২০ রাকআত পড়তে দেখেছেন। সৌদী আরবের গ্র্যান্ড মুফতী সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রহ.) ১০ ও আট রাকআতের মাসআলাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
এজাতীয় মত পার্থক্যের সমাধানকল্পে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহ.) বলেছেন, অধিক সংখ্যক রাকআত পড়াই উত্তম। আর যদি কেউ কম সংখ্যক রাকআত পড়তে চায় তাহলে তার উচিত হবে তিলাওয়াত, কিয়াম, রুকু ও সিজদা দীর্ঘ করা। তিনি আরো বলেছেন যে, তারাবীহকে রাকআত সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সময় ব্যয়ের পরিমাণ দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিত। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ১১ রাকআতের মধ্যে ৫ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করেছেন। সালাতের কিয়ামে এত দীর্ঘ সময় কেটে যেত যার কারণে সাহাবীগণ লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
সবশেষে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহঃ) আরেকটি মত ব্যক্ত করে বলেছেন যে, সার্বিক বিশ্লেষণে তারাবীহ ২০ রাকআত পড়াই উত্তম। কারণ এটা ১০ ও ৪০ রাকআতের মাঝামাঝি এবং বেশির ভাগ মুসলমানের আমলও এরই উপর।
তবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, আমাদের দেশে তারাবীহ যেভাবে তাড়াহুড়া করে পড়া হয় তা পরিহার করে বিশুদ্ধ ও ধীরস্থির তিলাওয়াত, রুকু থেকে উঠার পর এবং দু’ সিজদার মাঝে আরো একটু সময়ক্ষেপণ করা, সুন্নাত মোতাবিক ও ধীরস্থিরভাবে রুকু-সিজদাহ ইত্যাদি সুন্দর করে তারাবীহ আদায় করা অত্যাবশ্যক। যে পদ্ধতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সলাত আদায় করতেন আমাদেরও উচিত সে তরীকামত আদায় করা।

প্রশ্ন ১৩২ : তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের ফযীলত জানতে চাই।
উত্তর : (ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاِحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَاتَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় সাওয়াবের আশায় রাতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আদায় করবে, আল্লাহ তাঁর পূর্ববতী (সগীরা) গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। (বুখারী ও মুসলিম)
إِيْمَانًا ঈমান অবস্থায় অর্থ হল, এমন বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তাকে এ কাজের বদলা দিবেন এবং اِحْتِسَابًا অর্থ হল, এমনভাবে সাওয়াব আশা করবে যে, রাতের এ সালাত আদায় কোন মানুষকে দেখাবার বা শুনাবার জন্য নয় বরং শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য এবং তা শুধুমাত্র আল্লাহরই কাছ থেকে পুরস্কার লাভের আশায়।
(খ) অন্য হাদীসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
أََفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ
ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত)। (মুসলিম)

প্রশ্ন ১৩৩ : তারাবীহ সলাতের জামাআতে নারীদের শরীক হওয়া কি জায়েয?
উত্তর : ফিতনা-ফ্যাসাদের আশঙ্কা না থাকলে মাসজিদে তারাবীহর জামা‘আতে হাজির হওয়া মেয়েদের জন্য জায়েয আছে।
আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ تَمْنَعُوْا إِمَاءَ اللهِ مَسَاجِدَ اللهِ
“তোমরা আল্লাহর বান্দা নারীদেরকে মাসজিদে যেতে নিষেধ করো না।”


প্রশ্ন ১৩৪ : নারীরা মাসজিদে গেলে তাদের চালচলন ও পোষাক আশাক কী ধরনের হওয়া উচিত?
উত্তর : সম্পূর্ণ শরীয়াতসম্মত পর্দা করে মসজিদে যাবে। বাহারী ও রঙ বেরঙের বোরকা ও টাইট-ফিট পোষাক পরবে না। গল্পগুজব ও আওয়াজ করে কথা বলবে না। মেয়েদের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে সালাত আদায় করবে। ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পরপরই মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাবে।


প্রশ্ন ১৩৫ : জামাআতে সালাত আদায় করলে নারীদের কোথায় দাঁড়ানো উত্তম?
উত্তর : নারীরা পিছনে দাঁড়াবে। এটাই সুন্নাত। তারা যত পিছনে দাঁড়াবে ততই উত্তম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
خَيْرُ صُفُوْفِ الرِّجَالِ أَوَّلُهَا وَشَرُّهَا آخِرُهَا وَخَيْرُ صُفُوْفِ النِّسَاءِ آخِرُهَا وَشَرُّهَا أَوَّلُهَا
পুরুষদের উত্তম কাতার হলো প্রথম কাতার আর নিকৃষ্ট হলো শেষ কাতার। পক্ষান্তরে মহিলাদের জন্য উত্তম হলো শেষ কাতার আর নিকৃষ্ট হলো প্রথমকাতার। (মুসলিম)

____________________________________________________
[রামাদ্বান মুসলিম জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসের আমল গুলো পূর্ণ ভাবে করতে চাই সঠিক সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান। আপনাদের কাছে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে রামাদ্বান সম্পর্কিত আর্টিকেল,ফতোয়া, বই, অডিও লেকচার দিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের রামাদ্বানের পাথেয় সেকশনটি, এখানে রমযান সম্পর্কিত আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর গুলো পেয়ে যাবেন আশা করছি। নিজে পড়ুন, শুনুন এবং আপনাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এই রামাদ্বান কে পরিনত করুন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমযানে, এই রামাদ্বান মাস কে পরিণত করুন আপনার জীবনের সেরা সময়ে ইনশাআল্লাহ্‌।]
____________________________________________________
উৎস:
প্রশ্নোত্তরে
সিয়াম

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রামাদানের উপহার – হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী ‘লায়লাতুল কাদর’

ইমাম আবূ মুহাম্মদ ইবনে আবী হাতিম (র) এই সূরার তাফসীর প্রসঙ্গে একটি বিস্ময়কর রিওয়াইয়াত আনয়ন করেছেন। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, সপ্তম আকাশের শেষ সীমায় জান্নাতের সাথে সংযুক্ত রয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা, যা দুনিয়া ও আখিরাতের দূরত্বের উপর অবস্থিত। এর উচ্চতা জান্নাতে এবং এর শিকড় ও শাখা প্রশাখাগুলো কুরসীর নিচে প্রসারিত। তাতে এতো ফেরেশতা অবস্থান করেন যে, তাদের সংখ্যা নির্ণয় করা আল্লাহ পাক ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমন কি চুল পরিমাণও জায়গা নেই যেখানে ফেরেশতা নেই। ঐ বৃক্ষের মধ্যভাগে হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম অবস্থান করেন।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত জিবরাঈল আলাইহি সালামকে ডাক দিয়ে বলা হয়, “হে জিবরাঈল (আ) কদরের রাত্রিতে সমস্ত ফেরেশতাকে নিয়ে পৃথিবীতে চলে যাও।” এই ফেরেশতাদের সবারই অন্তর স্নেহ ও দয়ায় ভরপুর। প্রত্যকে মুমিনের জন্যে তাঁদের মনে অনুগ্রহের প্রেরণা রয়েছে। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই কদরের রাত্রিতে এসব ফেরেশতা হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর সাথে নেমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন এবং সব জায়গায় সিজদায় পড়ে যান। তাঁরা সকল ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য দুয়া করেন। কিন্তু তাঁরা গীর্জায় মন্দিরে, অগ্নিপূজার জায়গায়, মূর্তিপূজার জায়গায়, আবর্জনা ফেলার জায়গায়, নেশা খোরের অবস্থান স্থলে, নেশাজাত দ্রব্যাদি রাখার জায়গায়, মূর্তি রাখার জায়গায়, গান বাজনার সাজ সরঞ্জাম রাখার জায়গায় এবং প্রস্রাব পায়খানার জায়গায় গমন করেন না। বাকি সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা ঈমানদার নারী পুরুষের জন্যে দুয়া করে থাকেন। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সকল ঈমানদারের সাথে করমর্দন করেন। তাঁর করমর্দনের সময় মুমিন ব্যক্তির শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়, মন নরম হয় এবং অশ্রুধারা নেমে আসে। এসব নিদর্শন দেখা দিলে বুঝতে হবে তার হাত হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর হাতের মধ্যে রয়েছে।

হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, ঐ রাত্রে যে ব্যক্তি তিনবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে, তার প্রথমবারের পাঠের সাথে সাথেই সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়, দ্বিতীয়বার পড়ার সাথে সাথেই আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে যায় এবং তৃতীয়বারের পাঠের সাথে সাথেই জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন; হে আবু ইসহাক (র) ! যে ব্যক্তি সত্য বিশ্বাসের সাথে এ কালেমা উচ্চারণ করে তার কি হয়? জবাবে তিনি বলেন; সত্য বিশ্বাসীর মুখ হতেই তো এ কালেমা উচ্চারিত হবে। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ ! লায়লাতুল কাদর কাফির ও মুনাফিকদের উপর এতো ভারী বোধ হয় যে, যেন তাদের পিঠে পাহাড় পতিত হয়েছে। ফজর পর্যন্ত ফেরেশতারা এভাবে রাত্রি কাটিয়ে দেন।
তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম উপরের দিকে উঠে যান এবং অনেক উপরে উঠে স্বীয় পালক ছড়িয়ে দেন। অতঃপর তিনি সেই বিশেষ দুটি সবুজ পালক প্রসারিত করেন যা অন্য কোন সময় প্রসারিত করেন না। এর ফলে সূর্যের কিরণ মলিম ও স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর তিনি সমস্ত ফেরেশতাকে ডাক দিয়ে নিয়ে যান। সব ফেরেশতা উপরে উঠে গেলে তাদের নূর এবং হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর পালকের নূর মিলিত হয়ে সূর্যের কিরণকে নিষ্প্রভ করে দেয়। ঐ দিন সূর্য অবাক হয়ে যায়। সমস্ত ফেরেশতা সেদিন আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থানের ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য রহমত কামনা করে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁরা ঐ সকল লোকের জন্যেও দুয়া করেন যারা সৎ নিয়তে রোযা রাখে এবং সুযোগ পেলে পরবর্তী রমযান মাসেও আল্লাহর ইবাদত করার মনোভাব পোষণ করে।
সন্ধ্যায় সবাই প্রথম আসমানে পৌঁছে যান। সেখানে অবস্থানকারী ফেরেশতারা এসে তখন পৃথিবীতে অবস্থানকারী ঈমানদারদের অমুকের পুত্র অমুক, অমুকের কন্যা অমুক, বলে বলে খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ফেরেশতারা বলেন; তাকে আমরা গত বছর ইবাদতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আবার অমুককে গত বছর বিদআতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার তাকে ইবাদতে লিপ্ত দেখে এসেছি।
প্রশ্নকারী ফেরেশতা তখন শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত, রহমতের দুয়া করেন। ফেরেশতারা প্রশ্নকারী ফেরেশতাদেরকে আরো জানান যে, তাঁরা অমুক অমুককে আল্লাহর যিকর করতে দেখেছেন, অমুক অমুককে রুকূতে, অমুক অমুককে সিজদায় পেয়েছেন। এবং অমুক অমুককে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছেন। একরাত একদিন প্রথম আসমানে কাটিয়ে তাঁরা দ্বিতীয় আসমানে গমন করেন। সেখানেই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমনি করে তাঁরা নিজেদের জায়গা সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছেন। সিদরাতুল মুনতাহা তাঁদেরকে বলেঃ আমাতে অবস্থানকারী হিসেবে তোমাদের প্রতি আমাদের দাবী রয়েছে। আল্লাহকে যারা ভালোবাসে আমিও তাদেরকে ভালবাসি। আমাকে তাদের অবস্থার কথা একটু শোনাও, তাদের নাম শোনাও।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন; ফেরেশতারা তখন আল্লাহর পূণ্যবান বান্দাদের নাম ও পিতার নাম জানাতে শুরু করেন। তারপর জান্নাত সিদরাতুল মুনতাহাকে সম্বোধন করে বলে; তোমাতে অবস্থানকারীরা তোমাকে যে সব খবর শুনিয়েছে সেসব আমাকেও একটু শোনাও। তখন সিদরাতুল মুনতাহা জান্নাতকে সব কথা শুনিয়ে দেয়। শোনার পর জান্নাত বলে ; অমুক পুরুষ ও নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ ! অতি শীঘ্রই তাদেরকে আমার সাথে মিলিত করুন।
হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সর্বপ্রথম নিজের জায়গায় পৌঁছে যান। তাঁর উপর তখন ইলহাম হয় এবং তিনি বলেন; হে আল্লাহ ! আমি আপনার অমুক অমুক বান্দাকে সিজদারত অবস্থায় দেখেছি। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তায়ালা তখন বলেনঃ আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন আরশ বহনকারী ফেরেশতাদরকে এ কথা শুনিয়ে দেন। তখন ফেরেশতারা পরস্পর বলাবলি করেন যে, অমুক অমুক নারী পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত হয়েছে। তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম বলেন; হে আল্লাহ ! গত বছর আমি অমুক অমুক ব্যক্তিতে সুন্নাতের উপর আমলকারী এবং আপনার ইবাদতকারী হিসেবে দেখেছি কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং আপনার বিধি বিধানের অবাধ্যতা করেছে। তখন আল্লাহ তাবারাক ওয়া তা’য়ালা বলেনঃ হে জিবরাঈল (আ) ! সে যদি মৃত্যুর তিন মিনিট পূর্বেও তাওবা করে নেয় তাহলে আমি তাকে মাফ করে দেবো। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন হঠাৎ করে বলেনঃ হে আল্লাহ ! আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা। আপনি সমস্ত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। হে আমার প্রতিপালক ! আপনি আপনার সৃষ্ট জীবের উপর সবচেয়ে বড় মেহেরবান। বান্দা তার নিজের উপর যেরূপ মেহেরবানী করে থাকে আপনার মেহেরবানী তাদের প্রতি তার চেয়েও অধিক। ঐ সময় আরশ এবং ওর চারপাশের পর্দাসমূহ এবং আকাশ ও র মধ্যস্থিত সবকিছুই কেঁপে ওঠে বলেঃ“করুণাময় আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা”। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পূর্ণ করে রমযানের পরেও পাপমুক্ত জীবন যাপনের মনোভাব পোষণ করে সে বিনা প্রশ্নে ও বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
_______________________________________________________________
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত আছে যে, রমযান মাস এসে গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন; “(হে জনমণ্ডলী) তোমাদের উপর রমযান মাস এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকতপূর্ণ বা কল্যাণময়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে কল্যাণ হতে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হয় সে প্রকৃতই হতভাগ্য।” (আহমাদ, নাসায়ী)
আবূ দাউদ তায়ালাসী (র) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “লায়লাতুল কাদর পরিষ্কার, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং শীত গরম হতে মুক্ত রাত্রি। এ রাত্রি শেষে সূর্য স্নিগ্ধ আলোকআভায় রক্তিম বর্ণে উদিত হয়।”
হযরত আবূ আসিম নুবায়েল (র) স্বীয় সনদে হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছিলেন; “আমাকে লায়লাতুল কাদর দেখানো হয়েছে। তারপর ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। রমযান মাসের শেষ দশ রাত্রির মধ্যে এটা রয়েছে। এ রাত্রি খুবই শান্তিপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এ রাত্রে শীতও বেশি থাকে না এবং গরমও বেশি থাকে না। এ রাত্রি এতো বেশি রওশন ও উজ্জ্বল থাকে যে, মনে হয় যেন চাঁদ হাসছে। রৌদ্রের তাপ ছড়িয়ে পড়ার আগে সূর্যের সাথে শয়তান আত্মপ্রকাশ করে না।”
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন;“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রিতে ইবাদত করে, তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মার্জনা করে দেয়া হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
___________________________________________________________
সূরা কাদর
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
১ নিশ্চয়ই আমি এটা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে;
২ তুমি কি জান সেই মহিমান্বিত রজনীটি কি ?
৩ মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম।
৪ ঐ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও (তাদের সর্দার) ‘রুহ’ অবতীর্ণ হর প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
৫ শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার অভ্যুদয় পর্যন্ত।
___________________________________________________________
source: তাফসীর ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ)
অষ্টাদশ খণ্ড (সূরা কাদর এর তাফসীরের অংশবিশেষ)
[রামাদ্বান মুসলিম জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসের আমল গুলো পূর্ণ ভাবে করতে চাই সঠিক সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান। আপনাদের কাছে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে রামাদ্বান সম্পর্কিত আর্টিকেল,ফতোয়া, বই, অডিও লেকচার দিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের রামাদ্বানের পাথেয় সেকশনটি, এখানে রমযান সম্পর্কিত আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর গুলো পেয়ে যাবেন আশা করছি। নিজে পড়ুন, শুনুন এবং আপনাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এই রামাদ্বান কে পরিনত করুন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমযানে, এই রামাদ্বান মাস কে পরিণত করুন আপনার জীবনের সেরা সময়ে ইনশাআল্লাহ্‌।]
Advertisements