হাদীস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
হাদীস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ৪ আগস্ট, ২০১৭

দরিদ্র জীবনযাপন, সংসারে অনাসক্তি,পার্থিব বস্তু কম অর্জনের উৎসাহ প্রদান এবং দারিদ্রতার ফযীলত-২

৪৬৩ হযরত মুস্তাওরিদ ইবন শাদ্দাদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ পরকালের তুলনায় ইহকালের দৃষ্টান্ত হলো এরুপ যে, তোমাদের কেউ তার কোনো একটি আঙ্গুল সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখে যতটুকু সাথে নিয়ে ফিরে। (আঙ্গুলের অগ্রভাগে সমুদ্রের পানির যে অংশ লেগে থাকে, সমুদ্রের তুলনায় এটা যেরুপ কিছুই নয়, তেমনি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াটা কিছুই নয়)। [মুসলিম]
৪৬৪ হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো একটি বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর দুপাশে ছিলেন সাহাবায়ে কিরাম(রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তিনি যখন একটি কানকাটা মরা ছাগল ছানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি এর কান ধরে তাঁদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের বিনিময়ে এটা কিনতে রাজি আছো? তাঁরা বললেন, আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে এটা কিনতে রাযি রাজি নয়; আর আমরা এটা দিয়ে করবই বা কি ?
তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা বিনামূল্যে এটা নিতে রাজি আছো?
তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম ! এটা যদি জীবিতও থাকতো, তবু তো এটা ত্রুটিপূর্ণ; কেননা এটার কানকাটা। তবে মৃতটাকে দিয়ে কি হবে?
অতঃপর তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম করে বলছি ! তোমাদের কাছে এ ছাগল ছানাটা যেরুপ নিকৃষ্ট দুনিয়াটা আল্লাহর কাছে এর চাইতেও বেশি নিকৃষ্ট। (মুসলিম)

৪৬৫ হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মদীনায় কালো কংকরময় প্রান্তরে হাঁটছিলাম। অতঃপর ওহুদ পাহাড় আমাদের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বললেনঃ হে আবু যার ! আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ !আমি আপনার খেদমতে হাজির আছি।
তিনি বললেনঃ এই ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও যদি আমার কাছে থেকে থাকে, তবু আমি খুশি হবো না। কেননা, তিন দিনও অতীত হবে না যে, আমার কাছে তা থেকে ঋণ আদায়ের অংশ ছাড়া এক দীনারও অবশিষ্ট থাকবে না; বরং আমি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এভাবে ওভাবে, ডানে-বাঁয়ে, এবং পেছনে খরচ করে ফেলবো। একথা বলে তিনি এগিয়ে চললেন এবং বললেনঃ বেশি সম্পদশালীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে; কিন্তু যারা সম্পদ এভাবে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে খরচ করেছে তারা নিঃস্ব হবে না। তবে এ ধরণের লোকের সংখ্যা খুবই কম।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমি একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেলো কি না?
কাজেই আমি তাঁর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু তাঁর এ আদেশ; “আমি না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না” স্মরণ হয়ে গেলো এবং তাঁর ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি স্থান ত্যাগ করলাম না।
তিনি ফিরে এলেন। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আমি তো একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার আদেশ স্মরণ হওয়াতে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন; তুমি তাহলে সে শব্দ শুনেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটা জিবরাঈলের শব্দ। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেন; তোমার উম্মতের যে কেউ আল্লাহর সাথে কিছুকে শরীক না করে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, সে যদি চুরি করে? তিনি বললেনঃ সে যদি যিনাও করে এবং চুরিও করে, তবু জান্নাতে যাবে। (বুখারি ও মুসলিম)
৪৬৬ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমার কাছে যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে তিন দিন যেতে না যেতে আমার কাছে এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আমি এতেই আনন্দিত হবো। তবে ঋণ আদায়ের জন্যে কিছু অংশ আটকে রাখতে পারি। (বুখারি, মুসলিম)
৪৬৭ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাশীলদের দিকে তাকিও না। তোমাদের উপর আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে নিকৃষ্ট মনে না করার জন্যে এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। (বুখারি ও মুসলিম) বুখারীর অপর এক বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কেউ যখন তার চাইতে ধনী ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখো, তখন সে যেনো তার চাইতে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকেও তাকায়।
৪৬৮ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; দীনার, দিরহাম, কালো চাদর ও চওড়া পেড়ে পশমী চাদরের অনুরাগী গোলাম ধ্বংস হয়েছে। কেননা, তাকে যদি দেওয়া হয়, তবে খুশী আর না দেয়া হলেই অখুশী। (বুখারি)
৪৬৯ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি তাঁদের কারো কারো চাদর ছিল না। কারো হয়তো একটি লুঙ্গি আর কারো একটি কম্বল ছিল। তারা এটাকে নিজেদের গলায় বেঁধে রাখতেন। কারোরটা হয়ত তাঁর পায়ের গোছার অংশ পর্যন্ত পৌঁছত; আর কারোরটা হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার ভয়ে তারা হাত দিয়ে এটাকে ধরে রাখতেন। (বুখারী)
৪৭০। হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়াটা হলো ঈমানদারদের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্যে জান্নাত বা উদ্যান”। (মুসলিম)
৪৭১ হযরত ইবন উমার(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বললেনঃ দুনিয়াতে তুমি মুসাফির অথবা পথচারী হয়ে থেকো। আর এ জন্যেই ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেনঃ তুমি যখন সন্ধ্যা যাপন করো তখন সকালের প্রতীক্ষা করো না। আর যখন তুমি ভোর পাও তখন সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। আর তোমার সুস্থ সুময়ে রোগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো এবং তোমার জীবনকালে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (বুখারী)
৪৭২ হযরত আবুল আব্বাস সাহল ইবন সা’দ সাঈদী(রা) থেকে বর্ণিত। তিন বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যখন আমি তা করবো, তখন আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও আমাকে ভালোবাসবে। উত্তরে তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন; আর মানুষের কাছে যা কিছু আছে, সেদিকে লোভ করো না, মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে। হাদীসটি হাসান, ইবন মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন।
৪৭৩ হযরত নু’মান ইবন বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সব লোকের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও ধন-সম্পদ অর্জিত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, সারাদিন তাঁর (নাড়িভূড়ি) পেঁচিয়ে থাকতো, অথচ ঐ পেটে দেয়ার জন্যে এমন কোনো নষ্ট পুরোনো খেজুরও মিলতো না। (মুসলিম)

আল্লাহর যিকির


শুক্রবার, ১৭ মার্চ, ২০১৭

মহান আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা ও তাঁকে ভালোবাসা-২

[রিয়াদুস সালেহীন, দ্বিতীয় খণ্ড, হাদীস নং ৪৫২-৪৫৬]
৪৫২ হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর একদা হযরত আবু বকর(রা) হযরত উমর (রা) কে বললেন, চলো, আমরা উম্মে আয়মানকে দেখে আসি, যেমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দেখতে যেতেন। অতঃপর তাঁরা যখন তাঁর কাছে পৌছলেন, তিনি কেঁদে ফেললেন।তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি জানেন না যে, মহান আল্লাহর কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত মঙ্গলময় পরিবেশে ও কুশলেই আছেন? তিনি বললেন, আমি কাঁদছি এ জন্য যে, আসমান থেকে ওহী আসা যে বন্ধ হয়ে গেলো! এ কথায় তাদের অন্তর প্রভাবিত হলো এবং তাঁর সাথে তাঁরাও কাঁদতে শুরু করে দিলেন। (মুসলিম)
৪৫৩ হযরত ইবন উমার(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথাজনিত রোগ যখন তীব্র আকার ধারণ করলো, সে সময় একদা তাঁকে নামাযে আহ্বান করা হলে তিনি বললেন; আবু বকরকে আদেশ করো, সে যেন সাহাবাদের সাথে নামায পড়ে(অর্থাৎ ইমাম হয়ে নামায পড়ায়) হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ, যখন তিনি কুরআন তিলাওয়াত করবেন, তখন ক্রন্দন তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। অতঃপর আবার তিনি বললেন; তাকে আদেশ কর সে যেন নামায পড়ায়।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (আয়েশা) বলেন, আমি বললাম, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন আপনার জায়গায় দাঁড়াবেন কান্নার কারণে মুসল্লিদের (কুরআন) শুনতে পারবেন না। (বুখারি ও মুসলিম)
৪৫৪ হযরত ইবরাহীম ইবন আবদুর রহমন ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। একদা আবদুর রহমান ইবন আউফের সামনে খাবার পেশ করা হলো, তখন তিনি ছিলেন রোযাদার। তিনি বললেন, মুস’আব ইবন উমায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে গেছেন। আর তিনি আমার চাইতে উত্তম লোক ছিলেন। তাঁকে কাফন দেয়ার মতো কাপড়ের ব্যবস্থাই ছিল না। তবে একটি চাদর ছিল, এ দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকতে চাইলে তাঁর পা দুটি অনাবৃত হয়ে যেত, আর পা ঢাকতে চাইলে মাথা অনাবৃত হয়ে যেতো। অতঃপর আমাদের পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ দেয়া হলো। ভয় হচ্ছে, আমাদের সৎকাজের বিনিময়ে ইহকালের কখনো দস্তরখানে (খানার স্থানে) বসে খাদ্য গ্রহণ করেননি, আর কখনো চাপাতি রুটিও খাননি। (বুখারী)
৪৫৫ হযরত আবু উমাম সুদাই ইবন আজলান আল-বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে দুটি বিন্দু (ফোঁটা) দুটি নিদর্শনের চাইতে প্রিয় বস্তু আর কিছু নেই। তার একটি হলো আল্লাহর ভয়ে নির্গত অশ্রুবিন্দু এবং অপরটি হলো; আল্লাহর পথে প্রবাহিত রক্তবিন্দু। আর নিদর্শন দুটি হলো, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং আল্লাহর ফরযসমূহের মধ্য থেকে কোন ফরয আদায় করা। (তিরমিযী)
৪৫৬ হযরত ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে এমন এক উপদেশপূর্ণ খুতবা দেন যাতে আমাদের অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। (আবু দাউদ ও তিরমিযি)

মহান আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা ও তাঁকে ভালোবাসা -১

রিয়াদুস সালেহীন, দ্বিতীয় খন্ড






মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী ; “আর যারা কাঁদতে কাঁদতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়, আর (কুরআন) তাদের ভয় ভীতি ও নম্রতাকে আরো বৃদ্ধি করে দেয়”। (সূরা বনী ইসরাঈলঃ১০৯)
“তবে কি তোমরা এই কথায় বিস্মিত হচ্ছো আর হাসছো কিন্তু কাঁদছো না” (সূরা নাজমঃ ৫৯-৬০)
৪৪৬। হযরত ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেনঃ আমার সামনে কুরআন তিলাওয়াত করো। আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমি আপনার সামনে পড়বো, অথচ আপনার কাছেই তা নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন ; আমি অপরের তিলাওয়াত শুনতে ভালোবাসি। সুতরাং আমি তার সামনে সূরা নিসা পড়ে শুনালাম। পড়ার সময় যখন আমি এই আয়াতে এসেছি “তখন কি অবস্থা হবে যখন আমি প্রত্যেকে উম্মত থেকে একজন করে সাক্ষী উপস্থাপিত করবো এবং আপনাকে তাদের উপর সাক্ষীরুপে উপস্থিত করবো?”(সুরা নিসাঃ ৪১)। তিনি বললেন, বেশ যথেষ্ট হয়েছে, থামো। এ সময় আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর মুবারক দু’চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে। [বুখারি মুসলিম]
৪৪৭। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন এক (নসীহতপূর্ণ) ভাষণ দিলেন, যে ধরণের ভাষণ আমি আর কখনো শুনিনি। তিনি বলেন ; আমি যা জানি, তোমরা যদি তা জানতে পারতে,তাহলে হাসতে খুবই কম; কিন্তু কাঁদতে খুবই বেশী। তিনি (রাবী) বলেন, একথা শুনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবাগণ কাপড়ে মুখ ঢাকলেন এবং ডুকরে কাঁদতে লাগলেন।[ বুখারি ও মুসলিম]
৪৪৮। হযরত আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করেছে সে দোযখে প্রবেশ করবে না যে পর্যন্ত দুধ স্তনে ফিরে না আসে। আর আল্লাহর পথে জিহাদের ধুলোবালি এবং দোযখের ধোঁয়া কখনো একত্রিত হবে না। (বুখারি ও মুসলিম )
৪৪৯। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :৭ শ্রেণীর লোকদের মহান আল্লাহ সেদিন তাঁর সুশীতল ছায়াতলে স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছাড়া অন্য কোন ছায়াই থাকবে না। তাঁরা হলেন
• ন্যায়বিচারক শাসক বা নেতা
• মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল যুবক
• মসজিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি
• যে দুজন লোক একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পর বন্ধুত্ব করে এবং এ জন্যেই আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়
• এরুপ ব্যক্তি যাকে কোনো অভিজাত পরিবারের সুন্দরী নারী খারাপ কাজে আহবান করেছে, কিন্তু সে বলে দিল, আমি আল্লাহকে ভয় করি
• যে ব্যক্তি এতো গোপনভাবে দান-খয়রাত করে যে, তার ডান হাত কি দান করলো, বাঁ হাতেও তা জানতে পারলো না
• এরুপ ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহর যিকির করে এবং দু’চোখের পানি ফেলে (কাঁদে)। [বুখারি ও মুসলিম]

৪৫০। হযরত আব্দুল্লাহ ইবন শিখরীর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে দেখি তিনি নামায পড়ছেন এবং আল্লাহর ভয়ে কাঁদার দরুণ তাঁর পেট থেকে হাঁড়ির মতো আওয়াজ বেরুচ্ছে। [আবু দাউদ]
৪৫১। হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম উবাই ইবন কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু কে বললেন; মহামহিম আল্লাহ আমাকে তোমার সামনে সূরা (বাইয়্যিনাহ) পড়তে আদেশ করেছেন। তিনি (উবাই) জিজ্ঞেস করলেন, তিনি (আল্লাহ) কি আমার নাম উল্লেখ করেছেন? তিনি (নবী) বললেন; হ্যাঁ। অতঃপর উবাই(রা) কেঁদে উঠলেন। [বুখারি ও মুসলিম ]

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আদর্শিক নির্বাসিতদের জন্য শুভ সংবাদ

نْ أبِيْ هُرَيْرَةَ -رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ – صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سِلَّمَ- بَدَأَ الِإسْلَامُ غَرِيْبًا، وَ سَيَعُوْدُ كَمَا بَدَأَ
غَرِيْبًا، فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءَ. رواه مسلم



আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেছেন,


ইসলামের সূচনা হয়েছে অপরিচিত নির্বাসিতের মত। পুনরায় একদিন তা নির্বাসিতে পরিণত হবে। নির্বাসিতদের জন্য সু-সংবাদ। (মুসলিম-১৪৬)

আভিধানিক আলোচনা :


غَرِيْبً :নির্বাসন দু প্রকার : একটি হচ্ছে বাহ্যিক বা অনুভবনীয়—যেমন নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে একাকী জীবন-যাপন। অপরটি হচ্ছে আদর্শিক। আদর্শের দিক দিয়ে সে যেন নির্বাসিত, অপরিচিত, সমাজে তার আদর্শ তেমন গ্রহণযোগ্য নয়। আলোচ্য হাদিসে দ্বিতীয়টিই উদ্দেশ্য। অর্থ হচ্ছে—কোন মানুষ তার অবস্থান, এবাদত-বন্দেগি, ধর্ম পরায়ণতা, পাপাচার হতে মুক্ত থাকার দরুন আদর্শিকভাবে সমাজ হতে বিচ্ছিন্ন ও নির্বাসিত হয়ে পড়া।

এ নির্বাসন ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা খুবই আপেক্ষিক ব্যাপার : সময় ও অবস্থান-ভেদে নির্বাসনের অনুভূতি মানুষের মাঝে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

بَدَأَ الِإسْلَامُ غَرِيْبًا : প্রাথমিকভাবে ইসলাম বীজ আকারে ছড়িয়ে ছিল ব্যক্তিদের মাঝে। অত:পর ধীরে ধীরে তা নৈর্ব্যক্তিক ও সামাজিক রূপ লাভ করে। কিন্তু ক্রমে তাকে আক্রান্ত করে বিভিন্ন অপভ্রংশ, ফলে সূচনাকালের মত আজ তা কেবল ব্যক্তিক রূপে ফিরে এসেছে, হারিয়েছে তার সামাজিক যাবতীয় মূল্য।

فَطُوْبَى لِلْغُرَبَاءَ : অতএব নির্বাসিতদের জন্য শুভ সংবাদ। এ বাক্যটির অর্থ নির্ধারণে আলেমদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, তূবা-এর অর্থ আনন্দ, দৃষ্টির শীতলতা। কেউ বলেন, বাক্যটির অর্থ হচ্ছে—তাদের কী সৌভাগ্য ! কিংবা—তাদের কী ঈর্ষণীয় সাফল্য ! কারো মত এই যে, এর অর্থ—কল্যাণ ও মহানুভবতা তাদেরই। কেউ বলেন, তূবা অর্থ জান্নাত, অথবা জান্নাতের একটি বৃক্ষ। উল্লেখিত হাদিসে এর যে কোন একটি অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে।



আহকাম ও ফায়দা :


  • সাহাবিদের মহত্ত্ব ও মহানুভবতার প্রমাণ বহন করে হাদিসটি। কারণ, নবুয়্যতি জ্ঞান ধারার সূচনাকালেই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন—এর ফলে, পুরোপুরি বৈরী একটি সমাজ ব্যবস্থার সাথে তাদেরকে প্রাথমিকভাবে লড়াই করে টিকিয়ে রাখতে হয়েছিল তাদের আকিদা ও বিশ্বাস। আক্ষরিক অর্থে নয়, তাদের এ নির্বাসন ও বিচ্ছিন্নতা ছিল মানসিক ও আদর্শিক। শিরক ও বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে তারা অবতীর্ণ হয়েছিলেন স্বজাতির বিরোধিতায়।
  • আল্লাহর দ্বীনকে আকড়ে থাকা, তাতে দৃঢ় ও অটল থাকা, সর্বান্তঃকরণে নবী মোহাম্মদ সা.-এর অনুসরণে আত্মনিয়োগ করা—এগুলো হচ্ছে সেই প্রকৃত মোমিনের চারিত্রিক ভূষণ ও বৈশিষ্ট্য, যারা আদর্শিক নির্বাসনের পুন্যলাভে প্রয়াসী—যদিও সমাজের বৃহৎ একটি শ্রেণি তার বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। অধিকাংশ মানুষ কি মতামত পোষণ করছে—তাকে ভিত্তি করে নয় ; মূলত: ফলাফল নিরূপিত হবে সত্যকে দৃঢ়ভাবে আকড়ে থাকার বিবেচনায়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

আর আপনি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। (আনআম : ১১৬)
হাদিসটি আদর্শিক ও সামাজিক নির্বাসিতদের মহান প্রাপ্তি ও তাদের উচ্চ মর্যাদার ঘোষণা দিচ্ছে। নির্বাসিত দ্বারা এখানে ধর্মের কারণে নির্বাসিত হওয়া উদ্দেশ্য। যারা জাগতিক কারণে স্বদেশ হতে নির্বাসিত, তারা কোনভাবেই উদ্দেশ্য নয়।
  • কয়েকটি হাদিসে উক্ত নির্বাসিতদের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—


যারা মানুষের বিশৃঙ্খলার মাঝে শৃঙ্খল থাকে। (তিরমিজি)
কিংবা—


যারা মানুষের বিশৃঙ্খলতাকে শৃঙ্খলা দান করে। বা কলুষিত সমাজকে যারা সংস্কার করে। (আহমদ)
এ উক্তিগুলো প্রমাণ করে যে, কেবল ব্যক্তি-শুদ্ধি একজন প্রকৃত মোমিনের জন্য যথেষ্ট নয় ; বরং প্রজ্ঞা, বিনয়-বিনম্র আচরণের মাধ্যমে যারা বিপথে চালিত, তাদের সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবেই একজন মোমিন উক্ত হাদিসে বর্ণিত নির্বাসিতের গুণ অর্জনে সক্ষম হবে।

মহান আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা ও তাঁকে ভালোবাসা-২

[রিয়াদুস সালেহীন, দ্বিতীয় খণ্ড, হাদীস নং ৪৫২-৪৫৬]
৪৫২ হযরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তিকালের পর একদা হযরত আবু বকর(রা) হযরত উমর (রা) কে বললেন, চলো, আমরা উম্মে আয়মানকে দেখে আসি, যেমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে দেখতে যেতেন। অতঃপর তাঁরা যখন তাঁর কাছে পৌছলেন, তিনি কেঁদে ফেললেন।তাঁরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি জানেন না যে, মহান আল্লাহর কাছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত মঙ্গলময় পরিবেশে ও কুশলেই আছেন? তিনি বললেন, আমি কাঁদছি এ জন্য যে, আসমান থেকে ওহী আসা যে বন্ধ হয়ে গেলো! এ কথায় তাদের অন্তর প্রভাবিত হলো এবং তাঁর সাথে তাঁরাও কাঁদতে শুরু করে দিলেন। (মুসলিম)
৪৫৩ হযরত ইবন উমার(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যথাজনিত রোগ যখন তীব্র আকার ধারণ করলো, সে সময় একদা তাঁকে নামাযে আহ্বান করা হলে তিনি বললেন; আবু বকরকে আদেশ করো, সে যেন সাহাবাদের সাথে নামায পড়ে(অর্থাৎ ইমাম হয়ে নামায পড়ায়) হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তো অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ, যখন তিনি কুরআন তিলাওয়াত করবেন, তখন ক্রন্দন তার উপর প্রভাব বিস্তার করে। অতঃপর আবার তিনি বললেন; তাকে আদেশ কর সে যেন নামায পড়ায়।
হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা অপর এক বর্ণনায় আছে, তিনি (আয়েশা) বলেন, আমি বললাম, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন আপনার জায়গায় দাঁড়াবেন কান্নার কারণে মুসল্লিদের (কুরআন) শুনতে পারবেন না। (বুখারি ও মুসলিম)
৪৫৪ হযরত ইবরাহীম ইবন আবদুর রহমন ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। একদা আবদুর রহমান ইবন আউফের সামনে খাবার পেশ করা হলো, তখন তিনি ছিলেন রোযাদার। তিনি বললেন, মুস’আব ইবন উমায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে গেছেন। আর তিনি আমার চাইতে উত্তম লোক ছিলেন। তাঁকে কাফন দেয়ার মতো কাপড়ের ব্যবস্থাই ছিল না। তবে একটি চাদর ছিল, এ দ্বারা তাঁর মাথা ঢাকতে চাইলে তাঁর পা দুটি অনাবৃত হয়ে যেত, আর পা ঢাকতে চাইলে মাথা অনাবৃত হয়ে যেতো। অতঃপর আমাদের পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দ দেয়া হলো। ভয় হচ্ছে, আমাদের সৎকাজের বিনিময়ে ইহকালের কখনো দস্তরখানে (খানার স্থানে) বসে খাদ্য গ্রহণ করেননি, আর কখনো চাপাতি রুটিও খাননি। (বুখারী)
৪৫৫ হযরত আবু উমাম সুদাই ইবন আজলান আল-বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহর কাছে দুটি বিন্দু (ফোঁটা) দুটি নিদর্শনের চাইতে প্রিয় বস্তু আর কিছু নেই। তার একটি হলো আল্লাহর ভয়ে নির্গত অশ্রুবিন্দু এবং অপরটি হলো; আল্লাহর পথে প্রবাহিত রক্তবিন্দু। আর নিদর্শন দুটি হলো, আল্লাহর পথে জিহাদ করা এবং আল্লাহর ফরযসমূহের মধ্য থেকে কোন ফরয আদায় করা। (তিরমিযী)
৪৫৬ হযরত ইরবাদ ইবন সারিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে এমন এক উপদেশপূর্ণ খুতবা দেন যাতে আমাদের অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং চোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে। (আবু দাউদ ও তিরমিযি)

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

রামাদানের উপহার – হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম রজনী ‘লায়লাতুল কাদর’

ইমাম আবূ মুহাম্মদ ইবনে আবী হাতিম (র) এই সূরার তাফসীর প্রসঙ্গে একটি বিস্ময়কর রিওয়াইয়াত আনয়ন করেছেন। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, সপ্তম আকাশের শেষ সীমায় জান্নাতের সাথে সংযুক্ত রয়েছে সিদরাতুল মুনতাহা, যা দুনিয়া ও আখিরাতের দূরত্বের উপর অবস্থিত। এর উচ্চতা জান্নাতে এবং এর শিকড় ও শাখা প্রশাখাগুলো কুরসীর নিচে প্রসারিত। তাতে এতো ফেরেশতা অবস্থান করেন যে, তাদের সংখ্যা নির্ণয় করা আল্লাহ পাক ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়। এমন কি চুল পরিমাণও জায়গা নেই যেখানে ফেরেশতা নেই। ঐ বৃক্ষের মধ্যভাগে হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম অবস্থান করেন।
আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত জিবরাঈল আলাইহি সালামকে ডাক দিয়ে বলা হয়, “হে জিবরাঈল (আ) কদরের রাত্রিতে সমস্ত ফেরেশতাকে নিয়ে পৃথিবীতে চলে যাও।” এই ফেরেশতাদের সবারই অন্তর স্নেহ ও দয়ায় ভরপুর। প্রত্যকে মুমিনের জন্যে তাঁদের মনে অনুগ্রহের প্রেরণা রয়েছে। সূর্যাস্তের সাথে সাথেই কদরের রাত্রিতে এসব ফেরেশতা হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর সাথে নেমে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েন এবং সব জায়গায় সিজদায় পড়ে যান। তাঁরা সকল ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য দুয়া করেন। কিন্তু তাঁরা গীর্জায় মন্দিরে, অগ্নিপূজার জায়গায়, মূর্তিপূজার জায়গায়, আবর্জনা ফেলার জায়গায়, নেশা খোরের অবস্থান স্থলে, নেশাজাত দ্রব্যাদি রাখার জায়গায়, মূর্তি রাখার জায়গায়, গান বাজনার সাজ সরঞ্জাম রাখার জায়গায় এবং প্রস্রাব পায়খানার জায়গায় গমন করেন না। বাকি সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা ঈমানদার নারী পুরুষের জন্যে দুয়া করে থাকেন। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সকল ঈমানদারের সাথে করমর্দন করেন। তাঁর করমর্দনের সময় মুমিন ব্যক্তির শরীরের লোমকূপ খাড়া হয়ে যায়, মন নরম হয় এবং অশ্রুধারা নেমে আসে। এসব নিদর্শন দেখা দিলে বুঝতে হবে তার হাত হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর হাতের মধ্যে রয়েছে।

হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন যে, ঐ রাত্রে যে ব্যক্তি তিনবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে, তার প্রথমবারের পাঠের সাথে সাথেই সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়, দ্বিতীয়বার পড়ার সাথে সাথেই আগুন থেকে মুক্তি পেয়ে যায় এবং তৃতীয়বারের পাঠের সাথে সাথেই জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত হয়ে যায়। বর্ণনাকারী বলেন; হে আবু ইসহাক (র) ! যে ব্যক্তি সত্য বিশ্বাসের সাথে এ কালেমা উচ্চারণ করে তার কি হয়? জবাবে তিনি বলেন; সত্য বিশ্বাসীর মুখ হতেই তো এ কালেমা উচ্চারিত হবে। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ ! লায়লাতুল কাদর কাফির ও মুনাফিকদের উপর এতো ভারী বোধ হয় যে, যেন তাদের পিঠে পাহাড় পতিত হয়েছে। ফজর পর্যন্ত ফেরেশতারা এভাবে রাত্রি কাটিয়ে দেন।
তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম উপরের দিকে উঠে যান এবং অনেক উপরে উঠে স্বীয় পালক ছড়িয়ে দেন। অতঃপর তিনি সেই বিশেষ দুটি সবুজ পালক প্রসারিত করেন যা অন্য কোন সময় প্রসারিত করেন না। এর ফলে সূর্যের কিরণ মলিম ও স্তিমিত হয়ে যায়। তারপর তিনি সমস্ত ফেরেশতাকে ডাক দিয়ে নিয়ে যান। সব ফেরেশতা উপরে উঠে গেলে তাদের নূর এবং হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম এর পালকের নূর মিলিত হয়ে সূর্যের কিরণকে নিষ্প্রভ করে দেয়। ঐ দিন সূর্য অবাক হয়ে যায়। সমস্ত ফেরেশতা সেদিন আকাশ ও জমীনের মধ্যবর্তী স্থানের ঈমানদার নারী পুরুষের জন্য রহমত কামনা করে তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁরা ঐ সকল লোকের জন্যেও দুয়া করেন যারা সৎ নিয়তে রোযা রাখে এবং সুযোগ পেলে পরবর্তী রমযান মাসেও আল্লাহর ইবাদত করার মনোভাব পোষণ করে।
সন্ধ্যায় সবাই প্রথম আসমানে পৌঁছে যান। সেখানে অবস্থানকারী ফেরেশতারা এসে তখন পৃথিবীতে অবস্থানকারী ঈমানদারদের অমুকের পুত্র অমুক, অমুকের কন্যা অমুক, বলে বলে খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ফেরেশতারা বলেন; তাকে আমরা গত বছর ইবাদতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। আবার অমুককে গত বছর বিদআতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু এবার তাকে ইবাদতে লিপ্ত দেখে এসেছি।
প্রশ্নকারী ফেরেশতা তখন শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত, রহমতের দুয়া করেন। ফেরেশতারা প্রশ্নকারী ফেরেশতাদেরকে আরো জানান যে, তাঁরা অমুক অমুককে আল্লাহর যিকর করতে দেখেছেন, অমুক অমুককে রুকূতে, অমুক অমুককে সিজদায় পেয়েছেন। এবং অমুক অমুককে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছেন। একরাত একদিন প্রথম আসমানে কাটিয়ে তাঁরা দ্বিতীয় আসমানে গমন করেন। সেখানেই একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমনি করে তাঁরা নিজেদের জায়গা সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌঁছেন। সিদরাতুল মুনতাহা তাঁদেরকে বলেঃ আমাতে অবস্থানকারী হিসেবে তোমাদের প্রতি আমাদের দাবী রয়েছে। আল্লাহকে যারা ভালোবাসে আমিও তাদেরকে ভালবাসি। আমাকে তাদের অবস্থার কথা একটু শোনাও, তাদের নাম শোনাও।
হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন; ফেরেশতারা তখন আল্লাহর পূণ্যবান বান্দাদের নাম ও পিতার নাম জানাতে শুরু করেন। তারপর জান্নাত সিদরাতুল মুনতাহাকে সম্বোধন করে বলে; তোমাতে অবস্থানকারীরা তোমাকে যে সব খবর শুনিয়েছে সেসব আমাকেও একটু শোনাও। তখন সিদরাতুল মুনতাহা জান্নাতকে সব কথা শুনিয়ে দেয়। শোনার পর জান্নাত বলে ; অমুক পুরুষ ও নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ ! অতি শীঘ্রই তাদেরকে আমার সাথে মিলিত করুন।
হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম সর্বপ্রথম নিজের জায়গায় পৌঁছে যান। তাঁর উপর তখন ইলহাম হয় এবং তিনি বলেন; হে আল্লাহ ! আমি আপনার অমুক অমুক বান্দাকে সিজদারত অবস্থায় দেখেছি। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তায়ালা তখন বলেনঃ আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন আরশ বহনকারী ফেরেশতাদরকে এ কথা শুনিয়ে দেন। তখন ফেরেশতারা পরস্পর বলাবলি করেন যে, অমুক অমুক নারী পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত হয়েছে। তারপর হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম বলেন; হে আল্লাহ ! গত বছর আমি অমুক অমুক ব্যক্তিতে সুন্নাতের উপর আমলকারী এবং আপনার ইবাদতকারী হিসেবে দেখেছি কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে এবং আপনার বিধি বিধানের অবাধ্যতা করেছে। তখন আল্লাহ তাবারাক ওয়া তা’য়ালা বলেনঃ হে জিবরাঈল (আ) ! সে যদি মৃত্যুর তিন মিনিট পূর্বেও তাওবা করে নেয় তাহলে আমি তাকে মাফ করে দেবো। হযরত জিরবাঈল আলাইহি সালাম তখন হঠাৎ করে বলেনঃ হে আল্লাহ ! আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা। আপনি সমস্ত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। হে আমার প্রতিপালক ! আপনি আপনার সৃষ্ট জীবের উপর সবচেয়ে বড় মেহেরবান। বান্দা তার নিজের উপর যেরূপ মেহেরবানী করে থাকে আপনার মেহেরবানী তাদের প্রতি তার চেয়েও অধিক। ঐ সময় আরশ এবং ওর চারপাশের পর্দাসমূহ এবং আকাশ ও র মধ্যস্থিত সবকিছুই কেঁপে ওঠে বলেঃ“করুণাময় আল্লাহর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা”। হযরত কা’ব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ যে ব্যক্তি রমযানের রোযা পূর্ণ করে রমযানের পরেও পাপমুক্ত জীবন যাপনের মনোভাব পোষণ করে সে বিনা প্রশ্নে ও বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
_______________________________________________________________
মুসনাদে আহমাদে হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত আছে যে, রমযান মাস এসে গেলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন; “(হে জনমণ্ডলী) তোমাদের উপর রমযান মাস এসে পড়েছে। এ মাস খুবই বরকতপূর্ণ বা কল্যাণময়। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর এ মাসের রোযা ফরয করেছেন। এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানদেরকে বন্দী করে রাখা হয়। এ মাসে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসে কল্যাণ হতে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হয় সে প্রকৃতই হতভাগ্য।” (আহমাদ, নাসায়ী)
আবূ দাউদ তায়ালাসী (র) বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; “লায়লাতুল কাদর পরিষ্কার, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ এবং শীত গরম হতে মুক্ত রাত্রি। এ রাত্রি শেষে সূর্য স্নিগ্ধ আলোকআভায় রক্তিম বর্ণে উদিত হয়।”
হযরত আবূ আসিম নুবায়েল (র) স্বীয় সনদে হযরত জাবির (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার বলেছিলেন; “আমাকে লায়লাতুল কাদর দেখানো হয়েছে। তারপর ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। রমযান মাসের শেষ দশ রাত্রির মধ্যে এটা রয়েছে। এ রাত্রি খুবই শান্তিপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ, স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। এ রাত্রে শীতও বেশি থাকে না এবং গরমও বেশি থাকে না। এ রাত্রি এতো বেশি রওশন ও উজ্জ্বল থাকে যে, মনে হয় যেন চাঁদ হাসছে। রৌদ্রের তাপ ছড়িয়ে পড়ার আগে সূর্যের সাথে শয়তান আত্মপ্রকাশ করে না।”
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন;“যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত্রিতে ইবাদত করে, তার পূর্বাপর সমস্ত গুনাহ মার্জনা করে দেয়া হয়।” (বুখারী, মুসলিম)
___________________________________________________________
সূরা কাদর
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
১ নিশ্চয়ই আমি এটা অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রজনীতে;
২ তুমি কি জান সেই মহিমান্বিত রজনীটি কি ?
৩ মহিমান্বিত রজনী সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম।
৪ ঐ রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও (তাদের সর্দার) ‘রুহ’ অবতীর্ণ হর প্রত্যেক কাজে তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে।
৫ শান্তিই শান্তি, সেই রজনী ঊষার অভ্যুদয় পর্যন্ত।
___________________________________________________________
source: তাফসীর ইবনে কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ)
অষ্টাদশ খণ্ড (সূরা কাদর এর তাফসীরের অংশবিশেষ)
[রামাদ্বান মুসলিম জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসের আমল গুলো পূর্ণ ভাবে করতে চাই সঠিক সুন্নাহ ভিত্তিক জ্ঞান। আপনাদের কাছে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবার লক্ষ্যে রামাদ্বান সম্পর্কিত আর্টিকেল,ফতোয়া, বই, অডিও লেকচার দিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের রামাদ্বানের পাথেয় সেকশনটি, এখানে রমযান সম্পর্কিত আপনার জিজ্ঞাসার উত্তর গুলো পেয়ে যাবেন আশা করছি। নিজে পড়ুন, শুনুন এবং আপনাদের পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। এই রামাদ্বান কে পরিনত করুন আপনার জীবনের শ্রেষ্ঠ রমযানে, এই রামাদ্বান মাস কে পরিণত করুন আপনার জীবনের সেরা সময়ে ইনশাআল্লাহ্‌।]
Advertisements

দরিদ্র জীবনযাপন, সংসারে অনাসক্তি,পার্থিব বস্তু কম অর্জনের উৎসাহ প্রদান এবং দারিদ্রতার ফযীলত-২

রিয়াদুস সালেহীন
২য় খণ্ড

 ৪৬৩ হযরত মুস্তাওরিদ ইবন শাদ্দাদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ পরকালের তুলনায় ইহকালের দৃষ্টান্ত হলো এরুপ যে, তোমাদের কেউ তার কোনো একটি আঙ্গুল সমুদ্রে ডুবিয়ে রেখে যতটুকু সাথে নিয়ে ফিরে। (আঙ্গুলের অগ্রভাগে সমুদ্রের পানির যে অংশ লেগে থাকে, সমুদ্রের তুলনায় এটা যেরুপ কিছুই নয়, তেমনি আখিরাতের তুলনায় দুনিয়াটা কিছুই নয়)। [মুসলিম]
৪৬৪ হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো একটি বাজারের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন, আর তাঁর দুপাশে ছিলেন সাহাবায়ে কিরাম(রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তিনি যখন একটি কানকাটা মরা ছাগল ছানার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তিনি এর কান ধরে তাঁদের জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমাদের কেউ কি এক দিরহামের বিনিময়ে এটা কিনতে রাজি আছো? তাঁরা বললেন, আমরা কোনো কিছুর বিনিময়ে এটা কিনতে রাযি রাজি নয়; আর আমরা এটা দিয়ে করবই বা কি ?
তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমরা বিনামূল্যে এটা নিতে রাজি আছো?
তাঁরা বললেন, আল্লাহর কসম ! এটা যদি জীবিতও থাকতো, তবু তো এটা ত্রুটিপূর্ণ; কেননা এটার কানকাটা। তবে মৃতটাকে দিয়ে কি হবে?

অতঃপর তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম করে বলছি ! তোমাদের কাছে এ ছাগল ছানাটা যেরুপ নিকৃষ্ট দুনিয়াটা আল্লাহর কাছে এর চাইতেও বেশি নিকৃষ্ট। (মুসলিম)

৪৬৫ হযরত আবু যার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মদীনায় কালো কংকরময় প্রান্তরে হাঁটছিলাম। অতঃপর ওহুদ পাহাড় আমাদের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি বললেনঃ হে আবু যার ! আমি বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ !আমি আপনার খেদমতে হাজির আছি।
তিনি বললেনঃ এই ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও যদি আমার কাছে থেকে থাকে, তবু আমি খুশি হবো না। কেননা, তিন দিনও অতীত হবে না যে, আমার কাছে তা থেকে ঋণ আদায়ের অংশ ছাড়া এক দীনারও অবশিষ্ট থাকবে না; বরং আমি আল্লাহর বান্দাদের মাঝে এভাবে ওভাবে, ডানে-বাঁয়ে, এবং পেছনে খরচ করে ফেলবো। একথা বলে তিনি এগিয়ে চললেন এবং বললেনঃ বেশি সম্পদশালীরাই কিয়ামতের দিন নিঃস্ব হবে; কিন্তু যারা সম্পদ এভাবে ডানে-বাঁয়ে ও পেছনে খরচ করেছে তারা নিঃস্ব হবে না। তবে এ ধরণের লোকের সংখ্যা খুবই কম।
অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না। অতঃপর তিনি রাতের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমি একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গেলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটে গেলো কি না?
কাজেই আমি তাঁর কাছে যাওয়ার ইচ্ছা করলাম। কিন্তু তাঁর এ আদেশ; “আমি না আসা পর্যন্ত নিজের স্থান থেকে নড়ো না” স্মরণ হয়ে গেলো এবং তাঁর ফিরে আসার পূর্ব পর্যন্ত আমি স্থান ত্যাগ করলাম না।
তিনি ফিরে এলেন। অতঃপর আমি তাঁকে বললাম, আমি তো একটা বিকট শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনার আদেশ স্মরণ হওয়াতে এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন; তুমি তাহলে সে শব্দ শুনেছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটা জিবরাঈলের শব্দ। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বলে গেলেন; তোমার উম্মতের যে কেউ আল্লাহর সাথে কিছুকে শরীক না করে মারা যাবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, সে যদি চুরি করে? তিনি বললেনঃ সে যদি যিনাও করে এবং চুরিও করে, তবু জান্নাতে যাবে। (বুখারি ও মুসলিম)

৪৬৬ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ আমার কাছে যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, তাহলে তিন দিন যেতে না যেতে আমার কাছে এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, আমি এতেই আনন্দিত হবো। তবে ঋণ আদায়ের জন্যে কিছু অংশ আটকে রাখতে পারি। (বুখারি, মুসলিম)
৪৬৭ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের চাইতে নিম্ন মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে তাকাও এবং তোমাদের চাইতে উচ্চ মর্যাদাশীলদের দিকে তাকিও না। তোমাদের উপর আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহকে নিকৃষ্ট মনে না করার জন্যে এটাই উৎকৃষ্ট পন্থা। (বুখারি ও মুসলিম) বুখারীর অপর এক বর্ণনায় আছে, “তোমাদের কেউ যখন তার চাইতে ধনী ও সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনো ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে দেখো, তখন সে যেনো তার চাইতে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকেও তাকায়।
৪৬৮ হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন; দীনার, দিরহাম, কালো চাদর ও চওড়া পেড়ে পশমী চাদরের অনুরাগী গোলাম ধ্বংস হয়েছে। কেননা, তাকে যদি দেওয়া হয়, তবে খুশী আর না দেয়া হলেই অখুশী। (বুখারি)
৪৬৯ হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্তরজন আসহাবে সুফফাকে দেখেছি তাঁদের কারো কারো চাদর ছিল না। কারো হয়তো একটি লুঙ্গি আর কারো একটি কম্বল ছিল। তারা এটাকে নিজেদের গলায় বেঁধে রাখতেন। কারোরটা হয়ত তাঁর পায়ের গোছার অংশ পর্যন্ত পৌঁছত; আর কারোরটা হাঁটু পর্যন্ত। লজ্জাস্থান দেখা যাওয়ার ভয়ে তারা হাত দিয়ে এটাকে ধরে রাখতেন। (বুখারী)
৪৭০। হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ “দুনিয়াটা হলো ঈমানদারদের জন্য কারাগার এবং কাফিরের জন্যে জান্নাত বা উদ্যান”। (মুসলিম)
৪৭১ হযরত ইবন উমার(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বললেনঃ দুনিয়াতে তুমি মুসাফির অথবা পথচারী হয়ে থেকো। আর এ জন্যেই ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলতেনঃ তুমি যখন সন্ধ্যা যাপন করো তখন সকালের প্রতীক্ষা করো না। আর যখন তুমি ভোর পাও তখন সন্ধ্যার অপেক্ষা করো না। আর তোমার সুস্থ সুময়ে রোগের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করো এবং তোমার জীবনকালে মৃত্যুর প্রস্তুতি গ্রহণ করো। (বুখারী)
৪৭২ হযরত আবুল আব্বাস সাহল ইবন সা’দ সাঈদী(রা) থেকে বর্ণিত। তিন বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বললো, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমাকে এমন কোনো আমলের কথা বলে দিন, যখন আমি তা করবো, তখন আল্লাহ আমাকে ভালোবাসবেন এবং মানুষও আমাকে ভালোবাসবে। উত্তরে তিনি বললেন, দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত হও, আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন; আর মানুষের কাছে যা কিছু আছে, সেদিকে লোভ করো না, মানুষও তোমাকে ভালোবাসবে। হাদীসটি হাসান, ইবন মাজাহ এটি বর্ণনা করেছেন।
৪৭৩ হযরত নু’মান ইবন বাশীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যে সব লোকের পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও ধন-সম্পদ অর্জিত হয়েছে, তাদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখেছি, সারাদিন তাঁর (নাড়িভূড়ি) পেঁচিয়ে থাকতো, অথচ ঐ পেটে দেয়ার জন্যে এমন কোনো নষ্ট পুরোনো খেজুরও মিলতো না। (মুসলিম)

গুহাতে আশ্রয়গ্রহণকারী তিন ব্যক্তির ঘটনা

আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা.-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমাদের পূর্বের যুগে তিন ব্যক্তির একটি দল কোথাও যাত্রা করেছিল, যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহাতে তারা আগমন করে এবং তাতে প্রবেশ করে। অকস্মাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে এবং বন্ধ করে দেয় তাদের উপর গুহামুখ। এমন অসহায় অবস্থায় তারা বলাবলি করছিল, তোমাদেরকে এ পাথর হতে মুক্ত করতে পারে এমন কিছুই হয়ত নেই। তবে যদি তোমরা নিজ নিজ নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নিকট দোয়া কর তবে নাজাত পেতে পার।
তাদের একজন বলল : হে আল্লাহ ! আমার বয়োবৃদ্ধ পিতা-মাতা ছিলেন, আমি তাদেরকে দেওয়ার পূর্বে আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্য স্ত্রী-সন্তান ও গোলাম-পরিচারকদের কাউকে রাতের খাবার দুগ্ধ্তপেশ করতাম না। একদিনের ঘটনা : ঘাসাচ্ছাদিত চারণভূমির অনুসন্ধানে বের হয়ে বহু দূরে চলে গেলাম। আমার ফেরার পূর্বেই তারা ঘুমিয়ে পরেছিলেন। আমি তাদের জন্য রাতের খাবার দুগ্ধ দোহন করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম তারা ঘুমাচ্ছেন। তাদের আগে পরিবারের কাউকে- স্ত্রী-সন্তান বা মালিকানাধীন গোলাম-পরিচারকদের দুধ দেয়াকে অপছন্দ করলাম। আমি পেয়ালা হাতে তাদের জাগ্রত হওয়ার অপেক্ষা করছিলাম, এতেই সকাল হয়ে গেল। অতঃপর তারা জাগ্রত হলেন এবং তাদের রাতের খাবার দুধ পান করলেন। হে আল্লাহ ! আমি এ খেদমত যদি আপনার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে এ পাথরের মুসিবত হতে আমাদের মুক্তি দিন। তার এই দোয়ার ফলে পাথর সামান্য সরে গেল, কিন্তু তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না।






নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন্তঅপর ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহ ! আমার একজন চাচাতো বোন ছিল, সে ছিল আমার নিকট সমস্ত মানুষের চেয়ে প্রিয়। আমি তাকে পাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম। সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এবং আমার থেকে দূরে সরে থাকল। পরে কোন এক সময় দুর্ভিক্ষ তাড়িত, অভাবগ্রস্ত হয়ে আমার কাছে ঋণের জন্য আসে, আমি তাকে একশত বিশ দিরহাম দেই, এ শর্তে য্তেআমার এবং তার মাঝখানের বাধা দূর করে দেবে। সে তাতেও রাজি হল। আমি যখন তার উপর সক্ষম হলাম, সে বলল : অবৈধ ভাবে সতীচ্ছেদ করার অনুমতি দিচ্ছি না্ততবে বৈধভাবে হলে ভিন্ন কথা। আমি তার কাছ থেকে ফিরে আসলাম। অথচ তখনও সে আমার নিকট সবার চেয়ে প্রিয় ছিল। যে স্বর্ণ-মুদ্রা আমি তাকে দিয়েছিলাম, তা পরিত্যাগ করলাম। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি, তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল তবে এখনও তাদের বের হওয়ার জন্য তা যথেষ্ট হল না।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন্ততৃতীয় ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহ ! আমি কয়েকজন মজুর নিয়োগ করেছিলাম, অতঃপর তাদের পাওনা তাদের দিয়ে দেই। তবে এক ব্যক্তি ব্যতীত্তসে নিজের মজুরি পরিত্যাগ করে চলে যায়। আমি তার মজুরি বার বার ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি। যার ফলে সম্পদ অনেক বৃদ্ধি পায়। অনেক দিন পরে সে আমার কাছে এসে বলে, হে আব্দুল্লাহ, আমার মজুরি পরিশোধ কর। আমি তাকে বললাম, তুমি যা কিছু দেখছ্তউট-গরু-বকরি-গোলাম্তসব তোমার মজুরি। সে বলল : হে আব্দুল্লাহ ! তুমি আমার সাথে উপহাস করো না। আমি বললাম, উপহাস করছি না। অতঃপর সে সবগুলো গ্রহণ করল এবং তা হাঁকিয়ে নিয়ে গেল। কিছুই রেখে যায়নি। হে আল্লাহ ! আমি যদি এ কাজ তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করে থাকি, তাহলে আমরা যে মুসিবতে আছি তা হতে মুক্তি দাও। পাথর সরে গেল। তারা সকলে নিরাপদে হেঁটে বের হয়ে আসল। ঘটনাটি ইমাম বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। [বুখারি:২১১১]
হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবি্তবিশিষ্ট সাহাবি আবু আব্দুর রহমান, আব্দুল্লাহ বিন উমর ইবনুল খাত্তাব বিন নোফাইল আল-কোরাইশী আল ‘আদাওয়ী আল-মাক্কী আল-মাদানী। তিনি ছিলেন বরণীয়, অনুসরণীয় একজন পথিকৃৎ ইমাম। শৈশবে ইসলাম গ্রহণ করেন। পিতার সাথে হিজরত করেন্ততখনও তিনি সাবালক হননি। বয়স কম থাকার কারণে ওহুদের যুদ্ধে তাকে অংশ নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়নি। তার প্রথম যুদ্ধ খন্দক। আল-কোরআনে বর্ণিত গাছের নীচে যারা বায়আত গ্রহণ করেছিলেন, তিনি তাদের একজন। রাসূল সা. এবং খোলাফায়ে রাশেদীন হতে অনেক হাদিস বর্ণনা করেন তিনি। ৭৩ হি. সনে ইন্তেকাল করেন।
হাদিসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
অত্র হাদিসটি অনেক উপদেশ এবং বহু তাৎপর্যপূর্ণ। নিম্নে কতিপয় উল্লেখ করা হল :





১. পূর্ববর্তী লোকদের ঘটনায় অনেক উপদেশ ও শিক্ষা রয়েছে। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এ সমস্ত ঘটনা গভীরভাবে চিন্তা করা এবং দৈনন্দিন জীবনে এ থেকে উপকৃত হওয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদের কাছে পূর্ববর্তী রাসূল সা. ও অন্যান্য লোকের অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। উদ্দেশ্যে একটাই যাতে পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদের থেকে উপকৃত হয়। উপদেশ গ্রহণ করে ও শিক্ষা অর্জন করে। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তাদের কাহিনীতে বুদ্ধিমানদের জন্য রয়েছে শিক্ষণীয় বিষয়, এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন।'(সূরা ইউসুফ ১১১)

২. ঘটনা মূলক বর্ণনা পদ্ধতি মূল বিষয় বস্তু আত্মস্থ করতে শ্রোতা ও পাঠকগণকে খুব দ্রুত আকৃষ্ট করে। ফলে সহজেই গ্রহণ করে এবং তার উপর আমল করে। এ জন্য রাসূল সা. অনেক সময় সাহাবায়ে কেরামদের জন্য ঘটনা মূলক উদাহরণ পেশ করতেন। খতিব বা বক্তাগণ যখন মানুষের সামনে খুতবা পেশ করেন, তাদের উচিত সুযোগ মত এ পদ্ধতি অবলম্বন করা। কারণ, মানুষের বিচার-বুদ্ধি, প্রকৃতি ও স্বভাবের উপর এর সফল প্রভাব পরে।
৩. খাঁটি বিশ্বাস ও খালেস তওহিদ সবচেয়ে বড় আমল যা মানুষকে ইহকালীন মুসিবত ও পরকালীন শাস্তি হতে নাজাত প্রদান করে। ঘটনায় বর্ণিত তিন জন লোক স্বীয় দৃষ্টিতে পূর্ণ আন্তরিকতা (এখলাছ) সহ সম্পাদনকৃত সর্বোত্তম আমল-এর ওসিলা দিয়ে দোয়া করার ব্যাপারে একমত হয়েছে। যার দ্রুত ফল তারা দুনিয়াতেই পেয়ে গেছে।

৪. আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে সম্পাদিত নেক আমলের বরাত দিয়ে দোয়া করার বৈধতা প্রমাণিত হয়। তাছাড়া অন্য কোন জিনিস যেমন্তগাছ, কবর, মাজার ও পীর-আউলিয়াদের ওসিলা কিংবা বরাত দিয়ে দোয়া করা বা তাদের আহ্বান করা, শিরকে আকবর্তযা দ্বীন থেকে বের করে দেয়। যার প্রমাণ আল্লাহ তাআলার বাণী : ‘আল্লাহ তাআলাকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে ডাক, তারা সবাই তোমাদের মতই বান্দা।’ (আল-আরাফ ১৯৪)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন : ‘বলুন, তোমরা তাদেরকে আহ্বান কর, যাদের উপাস্য মনে করতে আল্লাহ তাআলা ব্যতীত। তারা নভোমণ্ডল ও ভূ-মণ্ডলের অণুপরিমাণ কোন কিছুর মালিক নয়, এতে তাদের কোন অংশও নেই এবং তাদের কেউ আল্লাহ তাআলার সহায়কও নয়। যার জন্য অনুমতি দেয়া হয়, তার জন্য ব্যতীত আল্লাহ তাআলার কাছে কারও সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে না।’ (সাবা ২২-২৩)


৫. দোয়া সর্বোত্তম এবাদত। মোমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম মাধ্যম। কারণ দোয়াতে বান্দা আল্লাহ তালার প্রতি সর্বাঙ্গে ধাবিত হয়। এতে নিজের দারিদ্র্য, হীনতা, অপারগতা ও সামর্থহীনতাকে প্রকট ভাবে উপলব্ধি করে। উপরোক্ত তিন জন লোক্তসব কিছু হতে বিচ্ছিন্ন হয়্তেদোয়ার মাধ্যমে এবং নেক আমলের ওসিলা দিয়ে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার শরণাপন্ন হয়েছ্তেযাতে তিনি তাদেরকে আক্রান্ত মুসিবত হতে মুক্ত করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। যারা আমার এবাদতে অহংকার করে তারা সত্বরই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’ (আল গাফের ৬০)
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেন : ‘আর আমার বান্দারা যখন তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে আমার ব্যাপারে বস্তুত আমি রয়েছি সনি্নকটে। যারা প্রার্থনা করে, তাদের প্রার্থনা কবুল করে নিই, যখন আমার কাছে প্রার্থনা করে। কাজেই আমার হুকুম মান্য করা এবং আমার প্রতি নিঃসংশয়ে বিশ্বাস রাখা তাদের কর্তব্য। যাতে তারা সৎপথে আসতে পারে।’ (আল বাকারাহ ১৮৬)
৬. অত্র হাদিস দ্বারা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার, আনুগত্য, তাদের অধিকারের প্রতি যত্নবান হওয়া, তাদের খেদমত আঞ্জাম দেয়া এবং তাদের জন্য পরিশ্রম ও কষ্ট করার ফজিলত প্রমাণিত হয়।
পিতা-মাতার কতিপয় উল্লেখযোগ্য অধিকার
ক. তাদের নির্দেশ পালন করা, যদি তাতে আল্লাহ তাআলার নাফরমানি না হয়। বৈষয়িক বিষয়গুলো পূর্ণ করা। শক্তি ও অর্থের মাধ্যমে সাহায্য করা। নরম ভাষায় সম্বোধন করা। বিরুদ্ধাচরণ না করা। তাদের জন্য দোয়া করা।
খ. তাদের জন্য বেশী করে দোয়া করা। তাদের পক্ষ হতে সদকা করা। তারা যে ওসিয়ত করেছেন, তা পূর্ণ করা। তাদের সাথে সম্পর্কিত আত্মীয় স্বজনদের সাথে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখা। বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা। আল্লাহ তাআলা বলেন:  ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহু’ শব্দটিও বলো না, এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। তাদের সামনে ভালোবাসার সাথে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বল : হে পালনকর্তা ! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন।'(আল ইসরা ২২-২৩)

৭. পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার দুনিয়ার সমস্যার সমাধান এবং আখেরাতের শাস্তি হতে নাজাতের ওসিলা। পিতা-মাতার আজ্ঞাবহ আলোচিত ব্যক্তির সদ্ব্যবহার তাদের সকলের উপর থেকে পাথর হটে যাওয়ার একটি কারণ ছিল। আবু দারদাহ রা. বর্ণনা করেন রাসূল সা. বলেছেন : ‘পিতা জান্নাতের মধ্যবর্তী দরজা, তোমার ইচ্ছা্তএ দরজাকে সংরক্ষণ কর অথবা নষ্ট কর।’ (তিরিমিযি ১৯০০, আহমাদ ৬/৪৪৫)
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার যেমন জান্নাত লাভের ওসিলা ; তদ্রুপ তাদের সাথে দুর্ব্যবহার ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের জন্য শাস্তি যোগ্য অপরাধ। রাসূল সা. বলেন: ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না্তপিতা-মাতার বিরুদ্ধাচরণকারী; অসতী স্ত্রীর স্বামী; পুরুষের আকৃতি ধারণকারী নারী।’ (নাসায়ি ২৫১৫)
৮. ইসলাম বাহ্যিক পবিত্রতা, অভ্যন্তরীণ পরিচ্ছন্নতার প্রতি যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে। এর উপর ভিত্তি করে দুনিয়া ও আখেরাতে অনেক উত্তম প্রতিদানের হিসাব কষেছে। আমরা লক্ষ্য করি মেয়েটি যখন আলোচ্য লোকটিকে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, লোকটি সাথে সাথে অশ্লীলতা হতে বিরত থাকে। যার কারণে তারা পাথর হতে মুক্তি পেয়েছে। এটা তাদের নগদ প্রতিদান। এছাড়া আল্লাহ তাআলার নিকট যা রক্ষিত আছে তা আরো উত্তম ও চিরস্থায়ী।
৯. প্রকৃত মোমিন অশ্লীলতা ও গর্হিত বিষয় হতে দূরে থাকে। গুনাহ ও পাপ-পঙ্কিলতার নিকটবর্তী হয় না। সে এ নিষ্পাপ অবস্থাতেই আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করতে চেষ্টা করে।
১০. আমানত এক গুরুত্বপূর্ণ মহান দায়িত্ব। এর মর্যাদা আল্লাহ তাআলা এবং মানুষের কাছে অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা আসমান, জমিন ও পাহাড়ের উপর আমানত পেশ করে ছিলেন, তারা তা বহন করতে অপারগতা প্রকাশ করেছে, শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু দুর্বল মানুষ তা গ্রহণ করেছে। এখন সে এ আমানত যথাযথ আদায় করলে দুনিয়া-আখেরাতে এর প্রতিদান পাবে। অন্যথায় তার শাস্তির কারণ হবে।
বিশেষ কয়েকটি আমানত :
ক. আল্লাহ তাআলার তওহিদকে আঁকড়ে ধরা।
খ.সব ধরনের নেক কাজ সম্পাদন করা।
গ.ব্যাপকভাবে সকলের অধিকার বাস্তবায়ন করা। বিশেষ করে গচ্ছিত সম্পদ, জামানত ও অর্থনৈতিক লেনদেন পরিশোধ করা।
১১.সব ধরনের নেক আমল দ্বারা দুনিয়া ও আখেরাতের অনেক জটিল ও কঠিন সংকটের উত্তরণ সম্ভব। আল্লাহ তাআলা বলেন :  ‘আর যে আল্লাহ তাআলাকে ভয় করে, আল্লাহ তাআলা তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিজিক দেবেন।’ (সূরা তালাক ২-৩)

____
  • অনুবাদ  সানাউল্লাহ নজির আহমদ
  • সম্পাদনা আব্দুল্লাহ শহীদ আবদুর রহমান
  • ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়া, রিয়াদ