তাওহীদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
তাওহীদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

যাদু – কিতাবুত তাওহীদ

কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ২৩
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
 
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর তারা অবশ্যই অবগত আছে, যে ব্যক্তি যাদু অবলম্বন করে তার জন্যে পরকালে সামান্যতমও কোন অংশ নেই’। (*১) (সূরা বাকারাহঃ১০২)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন, “তারা জিবত ও তাগুতের প্রতি বিশ্বাস করে”।(*২) (সূরা নিসাঃ৫১)
হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘জিবত’ হচ্ছে যাদু, আর ‘তাগুত’ হচ্ছে শয়তান। (ত্বাবারানী,৫৮৩৪)
হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তাগুত’ হচ্ছে গণক। তাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো। আর সাধারণত প্রত্যেক গোত্রের জন্যই একজন করে গণক নির্ধারিত ছিল।(*৩) (ইবনে আবী হাতিম, ২/২২; সহীহ বুখারী, ৮/৩১৭)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি?’ তিন জবাবে বললেন, ‘১ আল্লাহর সাথে শিরক করা ২যাদু করা ৩অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ তায়ালা হারাম করে দিয়েছেন ৪সুদ খাওয়া ৫এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা ৬যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা ৭ সতী সাধ্বী মু’মিন মহিলাকে অপবাদ দেয়া’।(*৪) (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৬৬,৫৭৬৪; সহীহ মুসলিম,হাদীস নং ৮৯)
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া(মৃত্যুদণ্ড)”।(*৫) (জামে’ তিরমিযী, হাদীস নং ১৪৬)
সহীহ বুখারিতে বাজালা বিন আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশ নামায় লিখেছিলেন, “তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা কর”। বাজালা বলেন, ‘এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকরকে হত্যা করেছি’। (*৬)(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৫৬, সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩০৪৩, মুসনাদ আহমাদ, ১/১৯০,১৯১)
হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে আছে, ‘তিনি তাঁর অধীনস্থ একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাঁকে যাদু করেছিল। অতঃপর উক্ত নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদীস নং৪৬; একই রকম হাদীস জুনদুব থেকে বর্ণিত রয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহি) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিনজন সাহাবী থেকে একথা সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে।) (*৭)
এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়,
১ সূরা বাকারাহর ১০২ নং আয়াতের তাফসীর
২ সূরা নিসার ৫১ নং আয়াতের তাফসীর
৩ ‘জিবত’ ও ‘তাগুত’ এর তাফসীর এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য
৪ ‘তাগুত’ কখনো জ্বিন আবার কখনো মানুষ হতে পারে
৫ ধ্বংসাত্মক এমন সাতটি বিশেষ বিষয়ের জ্ঞান যে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে
৬ যাদুকরকে কাফের ঘোষণা দিতে হবে
৭ তাওবার সুযোগ ছাড়াই যাদুকরকে হত্যা করতে হবে
৮ যদি ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালার যুগে যাদুবিদ্যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর পরবর্তী যুগের অবস্থা কি দাঁড়াবে [অর্থাৎ তাঁর পরবর্তী যুগে যাদুবিদ্যার প্রচলন অবশ্যই আছে]

ব্যাখ্যা– যাদু শিরকে আকবার তথা বড় শিরকের অন্যতম এবং তা তাওহীদের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যাদুর বাস্তবতা হচ্ছে তা কার্যকর এবং ক্রিয়াশীল করতে হলে শয়তানকে ব্যবহার এবং নৈকট্য লাভ করতেই হয়। আর শুধুমাত্র তার নৈকট্য লাভের মাধ্যমেই জিন-শয়তান যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরে যাদুর ক্রিয়া শুরু করে। শয়তানের নৈকট্য লাভ ছাড়া কোন যাদুকরের পক্ষেই যাদুকর হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমরা বলব যে, যাদু শিরক এর পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ পাক বলেন, ‘(বলুন যে আমি পরিত্রাণ কামনা করছি) গিরা তথা বন্ধনে অধিক ফুঁ দান কারিনীদের অনিষ্ট হতে’।نفاثات শব্দটি نفاثةএর বহুবচন। نفاثة /نفتথেকে মুবালাগা তথা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করার অর্থ বহন করে এবং তা দ্বারা  নিসন্দেহে যাদুকারিনী বুঝানো হয়েছে এবং সরাসরি যাদুকারিনী না বলে অতিমাত্রায় ফুঁ দানকারিনী বলা হয়েছে । কেননা তারা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করত এবং ঝাড় ফুঁক ও বিভিন্ন রকমের তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা ফুঁ দিত এবং সে ফুঁ এর মাধ্যমে জ্বিন সেই গিরা বন্ধনে কাজ করত যাতে যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরের কিছু একটা থাকত অথবা এমন কিছু থাকত যার সাথে যাদুকৃত ব্যক্তির সম্পর্ক রয়েছে । এভাবে যাদু ক্রিয়াশীল হয়ে যেত।
(*১)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আর তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে যে, যে ব্যক্তি যাদু ক্রয়(অবলম্বন) করল’ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে যাদুকর ব্যক্তি যাদু ক্রিয়া করল এবং বিনিময়ে তাওহীদ প্রদান করল, ফলে মূল্য হচ্ছে তাওহীদ আর পণ্য হচ্ছে যাদু’ । যাদুকর ব্যক্তির পরকালে কোন অংশ থাকবে না , ঠিক এইরুপ অবস্থা মুশরিকদেরও হবে। পরকালে তাদের ভাগ্যেও কিছুই জুটবে না।
(*২)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তারা জিবত ও তাগুতে বিশ্বাস করে’। উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলেন, জিবত হচ্ছে যাদু। উল্লেখিত আয়াতে আহলে কিতাবদের দোষারোপ ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। কেননা তারা যাদুতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর এটা সাধারণত ইহুদীদের ক্ষেত্রে অধিক দেখা যায়। এ কথা সুস্পষ্ট বলা যায় যে, যাদুবিদ্যা চর্চা ও তা অবলম্বনের কারণে আল্লাহ তাদের দুর্নাম করেছেন ও তাদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন এবং তাদের প্রতি ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, সুনিশ্চিত এটা হারাম ও কবীরা গুনাহ। আর যদি তাতে শিরকী কথা থাকে তবে অবশ্যই সেটা শিরক বলেই গণ্য হবে। এভাবেই তার সমস্ত প্রকারের এক নির্দেশ।
তাগুত হচ্ছে শয়তান এবং জিবত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ হলেও ইহুদী সম্প্রদায়ের নিকট তা যাদু অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তারা যাদু ও শয়তানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য প্রকাশ করে হক থেকে দূরে সরে গেছে।
(*৩) জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর অভিমত, ‘তাগুত’ দ্বারা গণককে বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ের আলোচনা সামনে করা হবে।
(*৪) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক’। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ! ঐ জিনিসগুলো কি কি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদু করা ‘ ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পাপগুলির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জগতেই ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নিসন্দেহে এগুলো মহাপাপ। সুতরাং যাদু শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
(*৫) জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে যে, যাদুকরের হদ তথা শাস্তি হচ্ছে তরবারি দ্বারা হত্যা করা(মৃত্যুদণ্ড)। (তিরমিযী) ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, সঠিক অর্থে হাদীসটি মওকুফ। শাস্তির ব্যাপারে মূলত যাদুকরগণের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখা হয়নি। যে কোন প্রকার যাদু হোক না কেন যাদুকরকে হত্যা করতে হবে এবং বাস্তবতা হচ্ছে যাদুকরের শাস্তি এবং মুরতাদের শাস্তি একই কেননা যাদুতে শিরক থাকেই। ফলে যে ব্যক্তি শিরক করল সে মুরতাদ হয়ে গেল এবং তার জানমাল বৈধ হয়ে গেল (হত্যাযোগ্য হয়ে গেল)।
(*৬) বাজালা বিন আবদুল্লাহ থেকে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফরমানজারী করেছিলেন যে, ‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যা কর, তিনি বলেন, ফলে আমরা তিনজন যাদুকারিনীকে হত্যা করেছিলাম’। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই।
(*৭) হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার অধীনস্ত একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাকে যাদু করেছিল, অতঃপর উক্ত দাসীকে হত্যা করা হয়েছিল। একই রকম হাদীস জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, তিনজন সাহাবী থেকে যাদুকরকে হত্যার ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যাদুকরকে হত্যার ফতোয়া ও আদেশ প্রদান করেছেন, এ মর্মে সেখানে কোন রকম পার্থক্য করেননি এবং এটাই ওয়াজিব যে, যেন কোন প্রকার পার্থক্য করা না হয়। প্রত্যেক মুসলমানদের প্রতি ওয়াজিব যে, তারা যাদুর সকল প্রকার থেকে সাবধান থাকবে এবং এই বিধান অর্থাৎ সাবধান থাকার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং এই গর্হিত কাজের বিরোধিতা করবে যেমন ইমামগণ বলেছেন যে, যখনই কোন যাদুকর কোন নগরীতে প্রবেশ করবে তখনই সেখানে অশান্তি, অত্যাচার সীমালংঘন এবং সন্ত্রাস বিরাজ করবে।
—————————————————————————–
উৎসঃ কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ২৩
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
ব্যাখ্যাকারঃ শায়খ সালেহ বিন আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়েখ
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আবদুর বর আফফান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

তাকদীর অস্বীকারকারীদের পরিচিতি – কিতাবুত তাওহীদ

কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ৫৯
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুল্লাহ)



আবদুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন, “সেই সত্ত্বার কসম যার হাতে ইবনে উমারের জীবন, তাদের(তাকদীর অস্বীকারকারীদের) কারও কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকে, অতঃপর তা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক উক্ত দান কবুল করবেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনে”। (*১)
অতঃপর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী দ্বারা তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে দলীল পেশ করেন, “ঈমান হচ্ছে, তুমি আল্লাহ তায়ালা, তাঁর সকল ফেরেশতা, তাঁর যাবতীয় [আসমানী] কিতাব,তাঁর সমস্ত রাসূল এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখবে। সাথে সাথে তাকদীর এবং এর ভালো-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে”। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮)
উবাদা বিন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর ছেলেকে বললেন, “হে বৎস, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে, ‘তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আর তোমার জীবনে যা ঘটেনি তা কোনোদিন জীবনে ঘটার ছিল না।’ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি একথা বলতে শুনেছি, “সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে ‘কলম’। সৃষ্টির পরই তিনি কলমকে বললেন, ‘লিখ’।(*২)কলম বলল, ‘হে আমার রব্ব, আমি কী লিখব?’ তিনি বললেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সব জিনিসের তাকদীর লিপিবদ্ধ কর।”
হে বৎস আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ” যে ব্যক্তি [তাকদীরের উপর] বিশ্বাস ব্যতীত মৃত্যুবরণ করল, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।” (সুনান আবী দাউদ, হাদীস নং ৪৭০০)
ইমাম আহমেদের অন্য একটি রেওয়ায়েতে বর্ণিত আছে, “আল্লাহ তা’আলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে ‘কলম’। এরপরই তিনি কলমকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘লিখ’। কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে, সে মুহুর্ত থেকে কলম তা লিখতে শুরু করে দিল।” (মুসনাদে আহমাদ, ৫/৩১৮)
ইবনে ওয়াহাবের একটি বর্ণনা মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ” যে ব্যক্তি তাকদীর এবং তাকদীরের ভালো-মন্দ বিশ্বাস করে না, তাকে আল্লাহ পাক জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবেন।” (ইবনে ওয়াহাব এর আল-কাদর:২৬; ইবনে আবী আসেম এর কিতাবুস সুন্নাহ; হাদীস নং ১১১)
ইবনু দাইলামী থেকে বর্ণিত আছে , কাতাদাহ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, ‘আমি ইবনে কা’ব এর কাছে গেলাম। তারপর তাকে বললাম, ‘তাকদীরের ব্যাপারে আমার মনে কিছু কথা আছে। আপনি আমাকে তাকদীর সম্পর্কে কিছু উপদেশমূলক কথা বলুন। এর ফলে হয়ত আল্লাহ তা’আলা আমার অন্তর থেকে উক্ত জমাটবাঁধা কাদা [কথা] দূর করে দেবেন। তখন তিনি বললেন, ‘তুমি যদি উহুদ [পাহাড়] পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় দান কর, আল্লাহ তোমার এ দান ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না তুমি তাকদীরকে বিশ্বাস করবে। আর এ কথা জেনে রাখ, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটতে কখনো ব্যতিক্রম হত না। আর তোমার জীবনে যা ঘটার ছিল না, তা কখনো ঘটত না। তাকদীর সম্পর্কিত এ বিশ্বাস পোষণ না করে মৃত্যুবরণ করলে, তুমি অবশ্যই জাহান্নামী হবে।’ তখন তিনি বললেন, অতঃপর আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান এবং যায়েদ বিন সাবিত (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) এর নিকট গেলাম। তাঁদের প্রত্যেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ জাতীয় হাদীস এর কথাই উল্লেখ করলেন। (সুনান আবী দাঊদ, হাদীস নং ৪৬৯৯; মুসনাদে আহমাদ, ৫/১৮৫,১৮৯)
————————————
ব্যাখ্যাঃ তাকদীর তথা ভাগ্যের প্রতি ঈমান বলতে বুঝায় যে, প্রত্যেক বিষয়েই আল্লাহর পূর্ব হতেই জ্ঞান আছে বিশ্বাস করা এবং কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু সংঘটিত হবে তার সবকিছুই তিনি লাওহে মাহফুজ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তা বিশ্বাস করা। একথা বিশ্বাস করা যে, তিনি যা ইচ্ছা করেন তাই করতে পারেন এবং তিনি বান্দার সমস্ত কর্মের স্রষ্টা। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা’। আল্লাহ বান্দা ও তাদের কর্মের স্রষ্টা। সুতরাং যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তার সমস্ত কিছুর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাকে মু’মিন বলা হবে না, কেননা এক্ষেত্রে অনেক অনেক দলীল রয়েছে। তাকদীরকে অস্বীকার করা কখনও ইসলাম থেকে বহিষ্কারের কারণ হয়। যেমন কেউ যদি আল্লাহর পূর্ব হতে জ্ঞান রাখেন অস্বীকার করে অথবা আল্লাহর লাওহে মাহফুজে সবকিছু লিপিবদ্ধ করে রাখেন তা অস্বীকার করে। তাকদীরকে অস্বীকার করা কখনও বিদ’আতের পর্যায় যা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী; যেমন- আল্লাহর ইচ্ছা বা তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে যে ব্যাপকতা, কেউ যদি তা অস্বীকার করে।
(*১) ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এভাবে বলার কারণ হল, আল্লাহ তা’আলা শুধু মুসলমানের নিকট থেকেই সৎ আমলসমূহ কবুল করেন। যে ব্যক্তি তাকদীরের প্রতি ঈমান রাখে না বরং অস্বীকার করে সে নিশ্চয়ই মুসলমান নয়। যদিও সে উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ দান করে, তার থেকে গ্রহণ করা হবে না। তিনি তাঁর কথার সমর্থনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উক্ত হাদীস পেশ করেন। তাকদীরের ভাল-মন্দ বলতে বান্দার স্বার্থে ভাল-মন্দের কথা বলা হয়েছে। যদিও আল্লাহর কর্ম সবই ভাল এবং হিকমতের অন্তর্গত ও অনুযায়ী।
(*২) তাকদীরের ব্যাপারে উবাদাহ বিন সামেতের হাদীসের মর্ম হল- তাকদীরের সব কিছু লিখা হয়ে গেছে। তাকদীরের প্রতি ঈমানের তাৎপর্য হল, মানুষ কার্যাবলী সম্পাদন করার ক্ষেত্রে বাধ্য নয় বরং তার স্বাধীনতা রয়েছে, সে তার ইচ্ছামত ভাল বা মন্দ কাজ করতে পারে। এ জন্যেই তাকে নেকী করার আদেশ ও গুনাহ থেকে বাঁচার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যদি বাধ্যই হতো তবে তাকে নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন ছিল না। ‘আল্লাহ তাকে(কলমকে) বললেন লেখ’। অত্র হাদীস দ্বারা লেখার গুরুত্ব প্রমাণিত হয় এবং ‘নিশ্চয়ই সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’আলা যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে কলম’। গবেষক উলামাদের এ ব্যাপারে সঠিক অভিমত হচ্ছে যে, আল্লাহ যখন কলম সৃষ্টি করলেন তখন তাকে এ কথা বললেন। এমন নয় যে, আল্লাহ সর্বপ্রথম কলমই সৃষ্টি করেছেন। কেননা তাঁর প্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আরশ।

এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১ তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা ফরয, এর বর্ণনা ।
২ তাকদীরের প্রতি কিভাবে ঈমান আনতে হবে, এর বর্ণনা ।
৩ তাকদীরের প্রতি যার ঈমান নেই, তার আমল বাতিল ।
৪ যে ব্যক্তি তাকদীরের প্রতি ঈমান আনে না সে ঈমানের স্বাদ অনুধাবন করতে অক্ষম ।
৫ সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি হয়েছে তার উল্লেখ ।
৬ কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে, সৃষ্টির পরক্ষণেই কলম দ্বারা তা উক্ত সময়ে লিখা হয়ে গেছে ।
৭ যে ব্যক্তি তাকদীর বিশ্বাস করে না, তার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দায়িত্বমুক্ত ।
৮ সালফে সালেহীনের রীতি ছিল, কোন বিষয়ের সংশয় নিরসনের জন্য জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনে প্রশ্ন করে জেনে নেয়া ।
৯  উলামায়ে কেরাম এমনভাবে প্রশ্নকারীকে জবাব দিতেন যা দ্বারা সন্দেহ দূর হয়ে যেত। জবাবের নিয়ম হচ্ছে, তাঁরা নিজেদের কথাকে শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের [কথা ও কাজের] দিকে সম্পৃক্ত করতেন।
উৎসঃ কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ৫৯
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুল্লাহ)


ব্যাখ্যাকারঃ শায়খ সালেহ বিন আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়েখ
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আবদুর বর আফফান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

কুফরি ও মুনাফেকি

গ্রন্থনা: শাইখ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইবরাহীম আল কার‘আওয়ী
অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
কুফরি দু প্রকার :
এক:
যা করলে ইসলাম থেকে বের হয়ে যায়।
নিম্নলিখিত পাঁচটি কারণে এ প্রকার কুফরি হয়ে থাকে:
১। মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী: “আর তার চেয়ে কে বেশি অত্যাচারী যে আল্লাহর উপর মিথ্যার সম্বন্ধ আরোপ করেছে, অথবা তার কাছে হক (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা আল্লাহ ছাড়া সঠিক কোন উপাস্য নেই এ কালেমা) আসার পর তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, জাহান্নাম কি কাফেরদেরই বাসস্থান নয়?” [সূরা আল আনকাবুত: ৬৮]

২। সত্য জেনেও অহংকার ও অস্বীকার করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী : “আর স্মরণ করুন যখন আপনার প্রভু আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশ্‌তাদেরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন ইবলিস ব্যতীত সবাই সিজদা করেছিল, সে অস্বীকার করেছিল, এবং অহংকার বোধে গর্ব করেছিল আর কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।” [সূরা আল বাকারা: ৩৪]

৩। সন্দেহ করার দ্বারা কুফরি করা- আর তা হলো অসার ধারণার বশবর্তী হয়ে কুফরি করা : এর প্রমাণ কোরআনের বাণী : “আর সে তার বাগানে প্রবেশ করল এমতাবস্থায় যে সে তার আত্মার উপর অত্যাচার করছে, এ-কথা বলে যে, আমি মনে করি না যে, এটা (বাগান) কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কোনোদিন কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে বলেও মনে করি না। আর যদি তা হয়েও যায় এবং আমাকে আমার প্রভুর কাছে ফিরে নেয়াও হয় তথাপি আমি তার কাছে ফিরে এর (বাগানের) চেয়ে আরও ভালো (বাগান) পেয়ে যাব। তার সাথী তাকে বলল: তুমি কি সেই স্বত্বার সাথে কুফরি করছ যিনি তোমাকে প্রথমে মাটি ও পরে বীর্য থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং এরপর পূর্ণ মানুষরূপে তোমাকে অবয়ব দান করেছেন? কিন্তু আমি (বলছি) সেই আল্লাহই আমার রব ও পালনকর্তা, তার সাথে কাউকে শরিক করি না।” [সূরা আল-কাহফ: ৩৫-৩৮]

৪। এড়িয়ে যাওয়ার (বিমুখ হওয়ার) কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “আর যারা কুফরি করেছে তারা যে সমস্ত বস্তুর ভয় তাদেরকে দেখান হয়েছে সেগুলো থেকে বিমুখ হয়েছে (এড়িয়ে গেছে)।” [সূরা আল-আহকাফ: ৩]

৫। মুনাফেকি করার কারণে কুফরি : এর প্রমাণ আল্লাহর পবিত্র কালামে এসেছে : “এটা এ জন্য যে, তারা ঈমান এনেছে অতঃপর কুফরি করেছে; ফলে তাদের অন্তরের উপর সিল মেরে দেয়া হয়েছে সুতরাং তারা বুঝছে না, বুঝবেনা।” [সূরা আল মুনাফিকুন: ৩]

দুই : দ্বিতীয় প্রকার কুফরি
আর তা হলো ছোট কুফরি, যা করলে গুনাহ হলেও ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবেনা, আর তা’ হলো আল্লাহর নেয়ামত এর সাথে কুফরি করা।
এর প্রমাণ : কোরআনের বাণী : “আল্লাহ্ তা‘আলা উদাহরণ দিচ্ছেন কোন নিরাপদ, শান্ত-স্থির জনপদের— যার জীবিকা চতুর্দিক থেকে অনায়াসে আসছিল, তখন তারা আল্লাহর নেয়ামতের সাথে কুফরি করলো, ফলে আল্লাহ তা‘আলা সে জনপদকে তাদের কার্যাদির শাস্তি স্বরূপ ক্ষুধা ও ভয়ে নিপতিত রাখল”। [সূরা আন্-নাহ্‌ল: ১১২]
মুনাফেকির প্রকারভেদ
মুনাফেকি দু প্রকার :
১। বিশ্বাসগত মুনাফেকি।
২। আমলগত (কার্যগত) মুনাফেকি।

এক : বিশ্বাসগত মুনাফেকি
এ-প্রকার মুনাফেকি ছয় প্রকার, এর যে কোন একটা কারো মধ্যে পাওয়া গেলে সে জাহান্নামের সর্বশেষ স্তরে নিক্ষিপ্ত হবে।
১। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
২। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা।
৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
৪। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার সামান্যতম অংশকে ঘৃণা বা অপছন্দ করা।
৫। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনের অবনতিতে খুশী হওয়া।
৬। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনের জয়ে অসন্তুষ্ট হওয়া।

দুই : কার্যগত মুনাফেকি
এ ধরণের মুনাফেকি পাঁচ ভাবে হয়ে থাকে: এর প্রমাণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “মুনাফিকের নিদর্শন হলো তিনটি:
১। কথা বললে মিথ্যা বলা।
২। ওয়াদা করলে ভঙ্গ করা।
৩। আমানত রাখলে খিয়ানত করা।[1]
অপর বর্ণনায় এসেছে :
৪। ঝগড়া করলে অকথ্য গালি দেয়া।
৫। চুক্তিতে উপনীত হলে তার বিপরীত কাজ করা।”[2]

[1] বুখারি (১/৮৩); মুসলিম (১/৭৮), হাদীস নং ৫৯।
[2] বুখারি (১/৮৪); মুসলিম (১/৭৮), হাদীস নং ৫৮।

শিরক ও এর বিভিন্ন রুপ নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা

গ্রন্থনা: শাইখ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইবরাহীম আল কার‘আওয়ী
অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
১। বড় শির্ক :
যা আল্লাহ কক্ষনো ক্ষমা করবেন না। এ শির্ক এর সাথে অনুষ্ঠিত কোন সৎকাজ আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না, তবে শির্ক ব্যতীত (শির্কের চেয়ে নিচু পর্যায়ের) যত গুনাহ আছে তা তিনি যাকে ইচ্ছা করেন ক্ষমা করে দেবেন। আর যে আল্লাহর সাথে শির্ক করলো সে পথভ্রষ্টতায় অনেকদূর এগিয়ে গেল (বেশী বিপথগামী হলো)।” [সূরা আন্‌-নিসা: ১১৬]
তিনি আরও বলেন: “অথচ মসীহ (ঈসা আলাইহিস্‌সালাম) বলেছেন: হে ইস্‌রায়েলের বংশধরগণ! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, যিনি আমার প্রভু, তোমাদের প্রভু, নিশ্চয়ই যদি কেউ আল্লাহর সাথে শরিক করে পরিণামে আল্লাহ তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন, তার আস্তানা হবে জাহান্নাম, আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই”। [সূরা আল-মায়েদা: ৭২]
তিনি আরও বলেন: “আর আমি তারা যা আমল করেছে সেগুলোর দিকে ধাবিত হয়ে সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় রূপান্তরিত করে দিয়েছি”। [সূরা আল-ফুরকান: ২৩]
আরও বলেন: “আপনি যদি শির্ক করেন তবে অবশ্যই আপনার আমলকে নষ্ট করে দেব এবং নিশ্চয়ই আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” [সূরা আয্‌-যুমার: ৬৫]
আরও বলেন: “যদি তারা শির্ক করে তবে অবশ্যই তারা যা আমল করেছে তা নষ্ট হয়ে যাবে।” [সূরা আল-আন‘আম ১৮৮]
বড় শির্ক এর প্রকারাদি
এক: দোয়ায় শির্ক করা : এর দলিল আল্লাহর বাণী :
“অতঃপর যখন তারা নৌকায় চড়ে তখন দীনকে নিষ্ঠা সহকারে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে তাঁকে ডাকতে থাকে কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে ডাঙ্গায় নিয়ে পরিত্রাণ দেন তখনই তারা তার সাথে শির্ক (অংশীদার) করে।” [সূরা আল আনকাবুত: ৬৫]

দুই: নিয়্যাত ও সংকল্পে শির্ক করা :
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “যারা পার্থিব জীবন ও তার চাকচিক্য পেতে চায় আমি তাদেরকে তাদের কার্যাদির প্রতিফল তাতেই (পার্থিব জীবনেই) পরিপূর্ণভাবে দিয়ে দেব, তাদের এতে কম দেয়া হবেনা, তাদের জন্য পরকালে জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই থাকবে না, তারা দুনিয়ায় যা করেছে তা নষ্ট হয়ে গেছে, আর যে সমস্ত (নেক) কার্যাদি তারা করেছে তা বাতিল হয়ে যাবে।” [সূরা হুদ: ১৫, ১৬]

তিন: আদেশ, নিষেধ প্রতিপালন বা বশ্যতায় শির্ক করা :
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী: “তারা আল্লাহ ছাড়া তাদের ‘আরবাব’ তথা আলেম, ‘আহবার’ তথা আবেদদের (পীর-দরবেশদের)-কে তাদের জন্য হালাল হারাম-কারী বানিয়ে নিয়েছে এবং মরিয়ম পুত্র মসিহ্‌-কেও, অথচ তাদেরকে শুধু এক মা’বুদ এর ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, তিনি ব্যতীত আর কোন হক মা’বুদ নেই। তার সাথে যাদের শরিক করছে তাদের থেকে তিনি কতইনা পবিত্র!” [সূরা আত্‌তাওবাঃ ৩১]
“আরবাব” শব্দের তাফসীর বা ব্যাখ্যা হলো আলেমদেরকে পাপ কাজে অনুসরণ করা, এর অর্থ তাদেরকে ডাকা নয়; কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রখ্যাত সাহাবী ‘আদি ইব্‌ন হাতিম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর প্রশ্নের উত্তরে এ প্রকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি যখন বললেন : আমরা তাদের ইবাদত (উপাসনা) করি না, উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “তাদের উপাসনা হলো পাপ কাজে তাদের আদেশ নিষেধ মান্য করা।”[1]

চার: ভালবাসায় শির্ক করা:
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “আর মানুষের মাঝে এমনও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া তার অনেক সমকক্ষ (সমপর্যায়ের ভালবাসা পাওয়ার অধিকারী, ভালবাসার পাত্র) নির্ধারণ করে সেগুলোকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসে, অথচ যারা ইমানদার তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালবাসে।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৫]

২। ছোট শির্ক:
আর তা হলো (সামান্য) লোক দেখানোর নিয়তে নেক কাজ করা।
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “সুতরাং যে আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে সে যেন নেক কাজ করে এবং তাঁর প্রভুর ইবাদতের সাথে অন্য কাউকে শরিক না করে।” [সূরা আল-কাহ্‌ফ: ১১০]

৩। গোপন (সূক্ষ্ম) শির্ক:
এর প্রমাণ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী : “এ [মুসলিম] জাতির মধ্যে শির্ক অন্ধকার রাত্রিতে কালো পাথরের উপর কালো পিপড়ার বেয়ে উঠার মতই সূক্ষ্ম বা গোপন।”[2]

শির্ক থেকে বাঁচার দোয়া:
اللَّهُمَّ إنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ شَيْئاً وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ مِنَ الذَّنْبِ الَّذِيْ لا أَعْلَمُ.
অর্থাৎ : “হে আল্লাহ আমি জেনে-শুনে তোমার সাথে কোন কিছুকে শরিক করা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, আর আমার অজ্ঞাত গুনাহরাজি থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।”[3]

[1] সুনান তিরমিযি, হাদিস নং ৩০৯৪। হাদিসটি হাসান।
[2] হাদিসটি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে। সনদটি হাসান।
[3] হাদিসটি ইমাম আহমাদ তাঁর মুসনাদে (১/৭৬) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেছেন।

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”র তাৎপর্য

আল্লাহর দিকে নবী-রাসূলদের আহবান

মানবজাতিকে (অর্থাৎ সর্বপ্রথম মানব আদম ও তাঁর স্ত্রীকে) এ দুনিয়ায় পাঠানোর সময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেছিলেনঃ
“আমি হুকুম করলাম, তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হেদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়েত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না (কোন কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে।”(সূরা,বাকারা ২: ৩৮)
যুগে যুগে নবী-রাসূলরা সে হেদায়েতের আহবান নিয়ে মানবজাতির কাছে এসেছিলেন। আমাদের ঐ সত্য পথের অনুসরণ করার জন্য জানা প্রয়োজন নবী-রাসূলদের আহবান সম্পর্কে, যাতে আমরা মুক্তি ও সফলতা লাভ করতে পারি। আল্-কুরআনের অনেক স্থানে আল্লাহ (সুবঃ),মানব জাতির প্রতি নবী-রাসূলদের আহবানের বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে আমরা আল-কুরআন থেকে কয়েকজন নবী এবং রাসূলের আহবান তুলে ধরছি-

নূহ (আঃ) এর আহবানের ব্যাপারে আল্লাহ (সুবঃ) বলেনঃ
“আর অবশ্যই আমি নূহ (আঃ) কে তাঁর জাতির প্রতি প্রেরণ করেছি, (তিনি বললেন) নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য প্রকাশ্য সতর্ককারী। তোমরা আল্লাহ ব্যতীত কারো এবাদত করবে না। নিশ্চয় আমি তোমাদের ব্যাপারে এক যন্ত্রণাদায়ক দিনের আযাবের ভয় করছি। ”(সূরা, হুদ ১১:২৫-২৬)
ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর কওমকে এই বলে আহবান জানিয়েছিলেনঃ

“অতঃপর যখন সূর্যকে চকচক করতে দেখল, বললঃ এটি আমার পালনকর্তা, এটি বৃহত্তর। অতপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বলল হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত। আমি এক মুখী হয়ে স্বীয় আনন ঐ সত্তার দিকে করেছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরেক নই।”(সূরা আন’আম ৬:৭৮-৭৯)

“স্মরণ কর ইব্রাহীমকে। যখন তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন; তোমরা আল্লাহর এবাদত কর এবং তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের জন্যে উত্তম যদি তোমরা বোঝ” (সূরা আনকাবুত ২৯: ১৬)
হুদ (আঃ) এর আহবানঃ
“আর আদ জাতির প্রতি আমি তাদের ভাই হুদকে প্রেরণ করেছি; তিনি বলেন-হে আমার জাতি, আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ভিন্ন তোমাদের কোন মাবুদ নেই, তোমরা সবাই মিথ্যা আরোপ করছ।” (সূরা, হুদ ১১:৫০)

সালেহ (আঃ) এর আহবানঃ
“আর সামুদ জাতি প্রতি তাদের ভাই সালেহ কে প্রেরণ করি; তিনি বললেন, হে আমার জাতি। আল্লাহর বন্দেগী কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন উপাস্য নাই। তিনিই যমীন হতে তোমাদেরকে পয়দা করেছেন, তন্মধ্যে তোমাদেরকে বসতি দান করেছেন। অতএব; তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে চল আমার পালনকর্তা নিকটেই আছেন, কবুল করে থাকেন; সন্দেহ নেই। ” (সূরা, হুদ ১১:৬১)

ইউসুফ (আঃ) এর আহবানের অংশবিশেষঃ
“হে কারাগারের সঙ্গীরা! পৃথক পৃথক অনেক উপাস্য ভাল, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ? তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত কর, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। আল্লাহ ছাড়া কারও বিধান দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারও এবাদত করো না। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না। ” (সূরা, ইউসুফ ১২:৩৯-৪০)
আল্লাহর একক সার্বভৌমত্বের দাবীদার ত্বাগুত ফিরাউনের উদ্দেশ্যে মুসা (আঃ) বলেছিলেনঃ
“এই মর্মে যে, আল্লাহর বান্দাদেরকে আমার কাছে অর্পণ কর। আমি তোমাদের জন্য প্রেরীত বিশ্বস্ত রসূল। আর তোমরা আল্লাহর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করো না। আমি তোমাদের কাছে প্রকাশ্য প্রমাণ উপস্থিত করছি।” (সূরা, আদ-দোখান ৪৪:১৮-১৯)
ঈসা (আঃ) এর আহবানঃ
“তিনি আরও বললেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ আমার পালনকর্তা ও তোমাদের পালনকর্তা। অতএব, তোমরা তার এবাদত কর। এটা সরল পথ।” (সূরা মারইয়াম ১৯:৩৬)
মুহাম্মদ (সঃ) রিসালাত পাওয়ার পর থেকে আমৃত্যূ আল্লাহর দিকে আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি আহবান জানিয়েছিলেন এই বলেঃ

“ইয়া আইয়ুহান্ নাস ক্বুলু লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা তুফলেহাও” -হে লোক সকল! তোমরা বল আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তাহলে তোমরা সফলকাম হবে। (আহমাদ, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)। মুহাম্মদ (সঃ) এর আহবান এর ব্যাপারে আল্লাহ বলেনঃ

“যেন তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো বন্দেগী না কর। নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি তাঁরই পক্ষ হতে সতর্ককারী ও সুসংবাদ দাতা। আর তোমরা নিজেদের পালনকর্তা সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অনন্তর তাঁরই প্রতি মনোনিবেশ কর। তাহলে তিনি তোমাদেরকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উৎকৃষ্ট জীবনোপকরণ দান করবেন এবং অধিক আমলকারীকে বেশী করে দেবেন আর যদি তোমরা বিমুখ হতে থাক, তবে আমি তোমাদের উপর এক মহা দিবসের আযাবের আশঙ্কা করছি। আল্লাহর সান্নিধ্যেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। আর তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। ” (সূরা, হুদ ১১:২-৪)

রাসূল (সঃ) যখন মুশরিকদের বাতিল ইলাহদের বর্জন করে এককভাবে শুধু আল্লাহর ইবাদতের আহবান জানিয়েছিলেন তখন তারা জবাবে বলেছিলঃ
“আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের মা‘বুদগুলোকে বর্জন করব?” (সূরা, সাফফাত ৩৭:৩৬)

আহলে কিতাবদের আহবান করার জন্য আল্লাহ তাঁর রাসূল (সঃ) কে শিক্ষাদান করেনঃ“বলুনঃ ‘হে আহলে-কিতাবগণ! একটি বিষয়ের দিকে আস-যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান-যে, আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করব না, তাঁর সাথে কোন শরীক সাব্যস্ত করব না এবং একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া কাউকে পালনকর্তা বানাব না। তারপর যদি তারা স্বীকার না করে, তাহলে বলে দাও যে, ‘সাক্ষী থাক আমরা তো অনুগত। ” (সূরা, আল- ইমরান ৩:৬৪)
উপরোক্ত আল্লাহর বানীগুলো থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় সমস্ত নবী-রাসূলরাই এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছিলেন, কুরআনে সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে রাসূলদের প্রেরণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা বলেনঃ
“আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য।” (সূরা, নাহল ১৬:৩৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আরো বলেনঃ
“আমি তোমার পুর্বে এমন কোন রাসূল পাঠাইনি তার কাছে এই ওহী ছাড়া যে আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” (সূরা, আম্বিয়া ২১:২৫)
সুতরাং সমস্ত নবী-রাসূলগনের আহবানের কালিমা ছিল একটাইঃ “আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।”

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা মানুষকে কেন সৃষ্টি করেছেন?
আল্লাহর (সুবঃ) বানীঃ

“মানুষের উপর এমন কিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে যখন সে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিশ্র শুক্রবিন্দু থেকে, এভাবে যে, তাকে পরীক্ষা করব অতঃপর তাকে করে দিয়েছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছি। এখন সে হয় কৃতজ্ঞ হয়, না হয় অকৃতজ্ঞ হয়।” (সূরা দাহর ৭৬:১-৩)
আল্লাহ্ (সুবঃ) মানবজাতিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন, তাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি এবং ভাল-মন্দের জ্ঞান দান করেছেন।সামান্য বীর্য কণা থেকে সৃষ্টি করে আল্লাহ্ মানুষকে অনেক উত্তম অবস্থানে নিয়ে এসেছেন, অন্যান্য প্রানী থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। তাদের জীবিকার প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস তিনিই সরবরাহ করছেন। আল্লাহ্ (সুবঃ) বলেনঃ

“নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা,বনী ঈসরাঈল ১৭:৭০)

আল্লাহ্ মানবজাতির জন্য এ যমীনকে সম্পূর্ণ বসবাস উপযোগী করে দিয়েছেন, আসমানকে তাদের জন্য করেছেন ছাদ স্বরূপ।আল্লাহ (সুবঃ) বলেনঃ
“হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার এবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পারবে। যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাকেও সমকক্ষ করো না। বস্তুতঃ এসব তোমরা জান।” (সূরা, বাকারা ২:২১-২২)
এতসব আল্লাহ্ (সুবঃ) এমনি এমনিই দেননি। এসব কিছুর পেছনে রয়েছে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, আল্লাহ্ (সুবঃ) বলেনঃ

“তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না?” (সূরা মু’মিনুন ২৩:১১৫)
মানুষ সৃষ্টির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ্ (সুবঃ) তায়ালা বলেনঃ

“আমি মানুষ এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য”।(যারিয়াত ৫১:৫৬)
আয়াতের এর ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেন অর্থাৎ আমার (আল্লাহর) একত্বকে মেনে নেয়ার জন্যই আমি তাদের সৃষ্টি করেছি। সুতরাং তাওহীদকে মেনে নিয়ে এককভাবে শুধু আল্লাহর ইবাদত করার জন্যই আল্লাহ (সুবঃ)মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর এ দিকেই সমস্ত নবী-রাসূলগণ আহবান করেছিলেনঃ
“আমি প্রত্যেক জাতির নিকট রাসুল প্রেরন করেছি আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগুতকে বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য।” (সূরা, নাহল ১৬:৩৬)
সমস্ত মানুষের প্রতি আল্লাহর হক্ হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা। রাসূল (সঃ) বলেছেন-“বান্দার প্রতি আল্লাহর হক্ হচ্ছে তারা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না।” (মুসলিম, ইফাবা/৫০)
সুতরাং যে ব্যক্তি শরীকবিহীন অবস্থায় আল্লাহর ইবাদত করে সে তার সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে পূরণ করল, আল্লাহর হক্ আদায় করল।আর যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীক করল সে সৃষ্টির উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করল এবং আল্লাহর হক্ আদায় করল না। সে তার নিজের ধ্বংস ডেকে আনল, সে কাফির, মুশরিক এবং অকৃতজ্ঞ।অতএব একজন মানুষের উচিত তার নিজের মুক্তির জন্য নিম্নের তিনটি বিষয়ে জানা এবং নিজের জন্য মেনে নেয়াঃ

১। এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা
২। আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করা
৩। আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকে রব এবং ইলাহ হিসেবে গ্রহন না করা
আর কালেমার স্বীকৃতির মাধ্যমে উপরোক্ত তিনটি জিনিসেরই স্বীকৃতি দেয়া হয়।

কালেমা সম্পর্কে জানার প্রয়োজনীয়তা
হে আল্লাহর বান্দারা (আল্লাহ্ আপনাদের সত্য পথের দিশা দান করুন) আপনারা জেনে রাখুন ইসলামে প্রবেশের একটি মাত্র কালেমা ইহাকে কালেমা তাইয়্যেবা বা কালেমাতুত তাওহীদ বলে। এ কালেমার স্বাক্ষ্য দানের মাধ্যমে একজন মানুষ তাওহীদ কে মেনে নেয়, ইসলামে প্রবেশ করে এবং মুসলিমে পরিণত হয়। অপরদিকে যে এ কালেমার স্বাক্ষ্যদান থেকে বিরত থাকে সে কাফির এবং মুশরিক থেকে যায়। এ কালেমা সম্পর্কে জানার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা নির্র্দেশঃ

“তুমি জেনে রাখো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।” (মুহাম্মদ ৪৭:১৯)
রাসূল (সঃ) ইরশাদ করেছেনঃ

“আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই“একথা জানা অবস্থায় যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করলো সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)
আল্লামা শাইখ আব্দুর রহমান বিন হাসান আল শাইখ (রহঃ) বলেছেনঃ “লা ইলাহা ইলালাহর অর্থসহ সেই এলমে ইয়াকীনী বা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যা ﺕﺎﺒﺛﺍ ﻰﻔﻧ (কি অস্বীকার করা হয় আর কি সাব্যস্ত করা হয় তা) সহ জানা আল্লাহ্ ওয়াজিব করে দিয়েছেন।” (আদ দারু সুন্নাহ)

শাইখ আব্দুল্লাহ বিন আবদির রাহমান আবা বাতিন (রহঃ) বলেনঃ “আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ
“বস্তুতঃ সকল মানুষের জন্য এটা একটা পয়গাম। যাতে এর দ্বারা উহারা সতর্ক হয় এবং তারা জেনে নিবে যে, প্রকৃতপক্ষে ইলাহ শুধু একজনই, আর বুদ্ধিমান যাতে লোকেরা উপদেশ গ্রহন করে।” (সূরা ইবরাহীম ১৪: ৫২)
শেখ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব(রহঃ)বলেছেন, “অর্থ জানা ব্যতীত এবং কালেমা (লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ)এর দাবী মোতাবেক কর্ম সম্পাদন ব্যতীত শুধুমাত্র শাব্দিক স্বাক্ষ্য প্রদানকারী ব্যক্তি মুসলমান হতে পারে না। বরং এ মৌখিক স্বাক্ষ্য আদম সন্তানের বির€দ্ধে একটি দলিল হিসেবে বিবেচিত।” তিনি আরও বলেন,“আপনি জেনে রাখুন (আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন) যে, নামাজ-রোজা ফরজ কিন্তু এরও আগের ফরজ হচ্ছে কালেমার স্বাক্ষ্য দানের বিষয়টি জেনে নেয়া। অতএব নামাজ-রোজার গবেষণার অপরিহার্যতার চেয়ে বান্দার জন্য অধিকতর অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে কালেমা এর অর্থ নিয়ে গবেষণা করা।এ কালেমা সম্পর্কে জানা অপরিহার্য এ জন্য যে, “আল্লাহ এক এবং তিনিই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য হকদার” এটা না জানলে কোন ব্যক্তির ইসলামে প্রবেশ গ্রহনযোগ্য নয়। এ জন্যই তাওহীদের ইলমকে বান্দার ইসলাম কবুলের শর্তরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং এমন প্রত্যেক ব্যক্তি যে নিজেকে মুসলিম দাবী করে তার প্রতি ফরজ হচ্ছে সে এ কালেমার অর্থ, গুরুত্ব, মর্যাদা, ফযীলত, এর রোকন ও এর শর্তাবলী জেনে নেবে; যেন এর দাবী পুরণ করতে পারে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা লাভ করতে পারে। কারণ এ কালেমা সম্পর্কে অজ্ঞতা, মুর্খতা বান্দার ব্যর্থতা এবং চিরস্থায়ী ধ্বংস ডেকে আনে। আসুন, আমরা সকলে এ কালেমা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জেনে নেই।

কালেমা সম্পর্কে বর্তমানে অধিকাংশ লোকের অবস্থা
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ এ কালেমা সম্পর্কে অজ্ঞ, একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তায়ালা যার প্রতি করুনা করেছেন, আর শিরক্ থেকে রক্ষা করেছেন, সে ছাড়া অধিকাংশ লোকের মধ্যেই কতিপয় শিরক্ লুকায়িত আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অধিকাংশ লোকের অবস্থা হচ্ছে তারা জানে না এ কালেমার অর্থ কি, কি এর গুরুত্ব ও মর্যাদা, এ কালেমার দাবীই বা কি, এ কালেমার স্বাক্ষ্য দানের মাধ্যমে কি তারা স্বীকার করে নিয়েছে আর কি অস্বীকার করেছে। তারা দাবী করছে আমরা মুসলিম আমরা আল্লাহ্ ছাড়া আর করো ইবাদত করি না অথচ তারা বাস্তবিকভাবে আল্লাহর পাশাপাশি অন্য অনেক কিছুর ইবাদত করছে।
আল্লাহ্র (সুবঃ) বানীঃ
“অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শিরকও করে।” (সূরা, ইউসুফ ১২:১০৬)
বর্তমানে এ আয়াতের বাস্তবতায় দেখছি অধিকাংশ মানুষ মুখে ঈমানের দাবী করা সত্বেও কর্মের ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর সাথে শিরক্ করছে। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মানুষের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে শেখ মুহাম্মদ আলী আল রাফাঈ বলেন- “অধিকাংশ মুসলমানই এ ভুল ধারণা করে যে, কালেমাটি মুখে উচ্চারণ করলে অথবা মুসলিম ঘরে জন্মগ্রহন করলে ও লালিত পালিত হলে এবং একটি মুসলিম নামধারণ করলেই মুসলমান হওয়া যায়। তার কাজকর্ম, জীবন-যাপন পদ্ধতি যাই হোক না কেন। এটি খ্রিষ্টানদের একটি আক্বীদা। সাহাবাদের জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাস্তবিকভাবে, তাদের এবং আমাদের কালেমা বোঝার ক্ষেত্রে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলামের পতাকাতলে নিজেকে দাখিলের জন্য প্রত্যেকেরই কালেমাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।”

“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা” এর গুরুত্ব ও মর্যাদা
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা” এর গুরুত্ব যে কত অপরিসীম, এর মর্যাদা যে কত উচ্চ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ ক্ষুদ্র পরিসরে তা বলে শেষ করার মত নয়। তবুও সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা এ কালেমার গুরুত্ব এবং মর্যাদা তুলে ধরছি।
১. এটি ইসলামের মূল কালেমা। এর স্বাক্ষ্য দানই ইসলামে প্রবেশের একমাত্র রাস্তা। কেউ বুঝে শুনে এ কালেমার স্বাক্ষ্য দিলে সে হবে মুসলিম, আর অস্বীকার করলে সে হবে কাফির। এ হচ্ছে এমন এক কালেমা যা মানুষের ঈমান এবং কুফরীর মধ্যে পার্থক্য করে দেয়। সবারই একথা জানা আছে যে, একজন অন্য ধর্মাবলম্বী যদি ইসলামে আসতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই এ কালেমার স্বীকৃতি দিতে হয়। বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুসলিম দাবী করছে তাদের জন্যও অবশ্যই জরুরী যে তারা বুঝে-শুনে এ কালেমার স্বাক্ষ্য দেবে অন্যথায় তাদেরও মুসলিম দাবী করা বৃথা হবে। রাসূল (সঃ) যখন মুয়ায(রাঃ) কে ইয়ামানে পাঠিয়েছিলেন তখন বলেছিলেন, নিশ্চয়ই তুমি আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের) এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ।সুতরাং তুমি প্রথমে তাদেরকে কালেমা ‘র দাওয়াত দিবে। (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)
২. নাবী-রাসুলদের মূল দাওয়াতই ছিল “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহা” এর দিকে আহবান করা, যাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা মানব জাতির হেদায়েতের জন্য পাঠিয়েছিলেন।আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“আমি তোমার পূর্বে এমন কোন রাসূল পাঠাইনি তার কাছে এই ওহী ছাড়া যে,আমি ব্যতীত কোন ইলাহ্ নেই সুতরাং আমারই ইবাদত কর।” (সূরা, আম্বিয়া ২১:২৫)
সুতরাং এ কালেমার দাওয়াতই সর্বশ্রেষ্ঠ দাওয়াত, এ কালেমাকে মেনে নেয়াই হেদায়েতের রাস্তা গ্রহণ করা এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যানকে মেনে নেয়া।
৩. কালেমা ইসলামের মূল ভিত্তি। ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির প্রথম ভিত্তি হচ্ছে শাহাদাতাইন বা দুটি বিষয়ে স্বাক্ষ্য দেয়া। প্রথম যে বিষয়ে স্বাক্ষ্য দিতে হয় তা হচ্ছে। আল্লাহর রাসুল বলেছেন:-“ইসলাম ভিত্তি পাঁচটি। এ স্বাক্ষ্য দেয়া যে, “আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মদ (সঃ) আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসুল। সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, (আল্লাহর) ঘরের হাজ্জ আদায় করা এবং রমযান মাসে সিয়াম পালন করা।” (বুখারী, মুসলিম)
এটা যেহেতু ইসলামের মুল ভিত্তি, এখন কেউ যদি বলে আমি মুসলিম, আমার দ্বীন ইসলাম তাহলে অবশ্যই তাকে এ কালেমার স্বাক্ষ্য জেনে-শুনে দিতে হবে এবং এটাকে দৃঢ়ভাবে গ্রহন করতে হবে।
৪. কালেমা হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ শাখা। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) বলেন-
“ঈমানের শাখা সত্তুরটিরও কিছু বেশী। এর সর্বোচ্চ শাখা এ কথা স্বীকার করা । আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেয়া”। (বুখারী, মুসলিম)
এখন কেউ যদি ঈমান গ্রহন করতে চায় তবে অবশ্যই এ কালেমাকে স্বীকার করতে হবে। আর যারা কুফরীতে নিমজ্জিত থাকতে চায়, তারাই এ কালেমার স্বাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
৫. কালেমা কে মেনে নেয়া এবং সে অনুযায়ী কাজ করা, বান্দার প্রতি আল্লাহর হক্। কারণ এ কালেমা স্বাক্ষ্য দানের মাধ্যমে বান্দাহ্ তাওহীদ কে মেনে নেয়। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ্কে এক ও একক হিসেবে মেনে নেয় এবং যাবতীয় ইবাদত শুধু তাঁর জন্য নিবেদন করবে এবং তাঁর ইবাদতে কাউকে শরীক করবে না বলে স্বীকৃতি দেয়। রাসূল (সঃ) বলেছেন-
“বান্দার প্রতি আল্লাহর হক্ হচ্ছে তারা তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না।” (মুসলিম, ইফাবা/৫০)
৬. এ কালেমার জন্য আল্লাহতায়ালা মানুষ এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করেছেন। কারণ এ কালেমার স্বীকৃতির মাধ্যমে বান্দাহ্ ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর এককত্বকে মেনে নেয়। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ
“আমি মানুষ এবং জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য”। (যারিয়াত, ৫১:৫৬)
আয়াতের ব্যাখ্যায় আলেমগণ বলেন “আমার (আল্লাহর) একত্বকে মেনে নেয়ার জন্যই আমি তাদের (মানুষ ও জ্বিন) সৃষ্টি করেছি।”
৭. এমন এক মহান কালেমা যার স্বাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহতায়ালা, ফেরেশতা এবং যারা জ্ঞানবান তারা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেছেনঃ
“আল্লাহ্ স্বাক্ষ্য দেন যে, নিশ্চয়ই তিনি ব্যতীত কোন হক্ ইলাহ নেই। ফেরেশতাগণ এবং জ্ঞানবান লোকেরা সততা ও ইনসাফের সাথে এ স্বাক্ষ্যই দিচ্ছে যে, প্রকৃতপক্ষে সেই মহা পরাক্রমশালী এবং বিজ্ঞানী ছাড়া কেহই ইলাহ হতে পারে না।” (আল ইমরানঃ ১৮)
আল্লাহ্ বলেছেন যারা জ্ঞানী তারা সততা এবং ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে এ কালেমার স্বাক্ষ্য দেয়। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে যারা অজ্ঞ, মূর্খ, জাহেল তারাই এ কালেমার স্বাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত থাকে।
৮. এমন এক কালেমা যে, আসমান-যমীন এবং এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তা যদি এক পাল্লায় তোলা হয় আর কে অপর পাল্লায় তোলা হয় তবে এ পাল্লাই ভারী হবে।
হাদীসে এসেছে আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেন মুসা (আঃ) বলেন,
‘হে আমার রব আমাকে এমন কিছু শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে ডাকতে পারি এবং আপনার যিকর করতে পারি। আলাহ তা’য়ালা বললেন, “হে মুসা! বল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। মুসা (আঃ) বললেন, হে আমার রব আপনার সমস্ত বান্দারাতো ইহা বলে। আল্লাহ আহ্কামুল হাকিমিন, রাব্বুল আলামীন যিনি সব জানেন যেখানে আমরা কিছুই জানিনা, তিনি নাযিল করলেন, “হে মুসা! আমি ছাড়া সাত আকাশ এবং উহার মধ্যে যাহা কিছু আছে এবং সাত যমীন যদি পাল্লার এক দিকে স্থাপন করা হয় এবং অপর দিকে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” কে স্থাপন করা হয় তবে দ্বিতীয় অংশটি ভারী হয়ে যাবে।’ (ইবনে হিব্বানঃ২৩২৩, আল-হাকিম ১/৫২৮)
৯. এ কালেমার স্বীকৃতি দেওয়া না দেওয়ার উপরই নির্ভর করে বান্দার সফলতা ব্যর্র্থতা। যে এ কালেমাকে মনে-প্রানে গ্রহন করল সে জান্নাত লাভ করবে । আর জান্নাত পাওয়া বান্দার অনেক বড় সাফল্য। আল্লাহতায়ালা বলেনঃ
“নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং নেক আমল করেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশে নদী প্রবাহিত।এটা অনেক বড় সাফল্য।” (সূরা বুরুজ, ৮৫:১১)
আর এ কালেমার স্বাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তি যে চুড়ান্ত ব্যর্থতা জাহান্নাম থেকে বেঁচে চুড়ান্ত সফলতা জান্নাত লাভ করবে। এ ব্যাপারে রাসূল (সঃ) বলেনঃ “যে ব্যক্তি “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে (মুসলিম, ইফাবা/২৩)
রাসূল (সঃ) আরও বলেন, “আল্লাহতায়ালা ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের আগুন হারাম করে দিয়েছেন যে একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের জন্য- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করেছে।” (বুখারী, মুসলিম)
মূলকথা হচ্ছে তাওহীদই ইসলামের শুরু ও শেষ, জাহেরী-বাতেনী এবং মুখ্য উদ্দেশ্য। আর ইহাই সকল রাসূল (আলাইহিস সালাম) এর দাওয়াত ছিল। এ তাওহীদ (কায়েম) এর লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন, সকল নাবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন এবং সব আসমানী কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। আর এ তাওহীদের কারণেই মানুষ মু‘মিন-কাফির, সৌভাগ্য-দূর্ভাগ্যে বিভক্ত হয়েছে। আর তাওহীদই বান্দাদের উপর সর্বপ্রথম ওয়াজিব। সর্বপ্রথম এর মাধ্যমেই ইসলামে প্রবেশ করে।এবং এ তাওহীদ নিয়েই দুনিয়া ত্যাগ করে।
তাওহীদের উপকারিতা
কালেমা এর স্বীকৃতির মাধ্যমে মূলত তাওহীদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। তাওহীদের শাব্দিক অর্থ একীকরণ (কোন কিছু এক করা) অথবা দৃঢ়ভাবে এককত্ব ঘোষণা করা। কিন্তু যখন তৌহিদ শব্দটি আল্লাহর সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয় তখন আল্লাহ সম্পর্কিত মানুষের সকল পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকান্ডে আল্লাহর এককত্ব উপলদ্ধি করা ও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্ষুন্ন রাখা বুঝায়। মানুষের একক ও সমষ্টিগত জীবনে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”’র স্বাক্ষ্য দানের মাধ্যমে যখন সত্যিকার তাওহীদ আসবে তখন অতীব সুন্দর ফল পাওয়া যাবে। ঐ সমস্ত লাভের মধ্যে আছেঃ
১. তাওহীদ মানুষকে অপরের দাসত্ব থেকে এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে নত হওয়া এবং ঐ সমস্ত সৃষ্টি যারা কোন কিছু সৃষ্টি করে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়েছে, যাদের কোন ক্ষমতা নেই নিজেদের ক্ষতি ঠেকাতে বা ভাল করতে, না তারা মৃত্যু দেয়ার অধিকারী, না কবর থেকে বাঁচানোর ক্ষমতার অধিকারী, তাওহীদ ঐ সমস্ত কিছুর ইবাদত করা হতে মানুষকে মুক্তি দেয়; অপরের গোলামী করা হতে বাঁচিয়ে ঐ এক আল্লাহর দাসত্বে লাগিয়ে দেয় যিনি তার প্রতিপালক ও স্রষ্টা। তার বুদ্ধিকে নানা ধরনের কুসংস্কার ও মিথ্যা ধারণা হতে স্বাধীন করে। এজন্য কুরআন পাকে দেখা যায় মুশরিকদের নেতারা ও অজ্ঞ সীমালঙ্ঘনকারীরা সর্বদাই সমস্ত নবীদের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছে এবং বিশেষভাবে আমাদের রাসূল (সঃ)-এর দাওয়াতের কারণ তারা বুঝত যে যখনই কেউ বলবে কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তখনই সে মানুষের গোলামী করা হতে স্বাধীন হয়ে যাবে এবং সে অত্যাচারের বেড়াজাল ছিড়ে ফেলবে, মুমিনদের কপাল উঁচু হবে এবং তারা বিশ্বজগতের প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে তা নত করবে না।
২. তাওহীদ সঠিক ব্যক্তিত্ব গড়তে সহায়তা করে। মানুষ এতে সঠিকভাবে জীবন গঠন করতে পারে এবং সত্যিকারের দিক নির্দেশনা পায়। তার লক্ষ্য বস্তুকে নির্দিষ্ট করে দেয়। কারণ সে বুঝে এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপায় নাই। ফলে তাঁর দিকে গোপনে ও প্রকাশ্যে মুখ ফেরাতে পারে। সুখে ও দুঃখে তাঁকে ডাকতে পারে। অন্যদিকে মুশরিকদের আত্মা নানা ধরনের রব ও উপাস্যের প্রতি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। ফলে একবার সে জীবিতদের দিকে মুখ ঘোরায়, আবার সে মৃতদের দিকে ঘুরে। এ কারণেই ইউসুফ (আঃ) বলেছেনঃ
“হে আমার জেলের সাথীদ্বয়! নানা ধরনের রবই উত্তম, না এক আল্লাহ যিনি একক এবং সর্বোচ্চ শক্তিধর।” (সুরা ইউসুফঃ ৩৯)
তাই মুমিন এক আল্লাহর ইবাদত করেন। তিনি জানেন কি করলে তার রব খুশী হবেন, আর কি করলে তিনি নারাজ হবেন। তাই যে কাজে তিনি খুশী হন তাই করতে থাকেন। ফলে তার অন্তর শান্ত হয়ে যায়। আর মুশরিক নানা ধরনের উপাস্যের উপাসনা করে। কোনটা তাকে ডানে নিয়ে যায়, কোনটা বামে। আর তার মাঝে পড়ে সে হয় কিংকর্তব্যবিমূঢ়।এতে তার মনে কোন শান্তি থাকে না।
৩. তাওহীদ হচ্ছে মানুষের জীবনে নিরাপত্তার ভিত্তি। কারণ, এর দ্বারাই সে নিরাপত্তা ও শান্তি পায়। আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করে না। তা ভয়ের সমস্ত দ্বার বন্ধ করে দেয়, যেমন রিযিকের ব্যাপারে, জানের ব্যাপারে, পরিজনের জন্য, মানুষ হতে ভয়, জিন হতে, মৃত্যু হতে এবং অন্যান্য ভয়-ভীতি হতেও। একত্ববাদী মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করে না। অন্যেরা যখন ভয়ের মধ্যে থাকে তখন তাকে দেখবে নির্ভীক। যখন মানুষ চিন্তা পেরেশানীতে জর্জরিত, তখন সে অবিচলিত থাকে।এদিকে নির্দেশ করে কুরআন পাক বলেনঃ
“যারা ঈমান এনেছে এবং তার সাথে র্শিককে জড়িত করেননি, তাদের জন্যই রয়েছে শান্তি এবং তাঁরাই হচ্ছে হেদায়াতপ্রাপ্ত।” (সুরা আনআমঃ ৮২)
আর এই নিরাপত্তা মানুষের অন্তরের অন্তস্থল হতে নির্গত হয়। কোন প্রহরীর প্রহরায় হয় না। এ হল দুনিয়ার নিরাপত্তা। আর আখিরাতের নিরাপত্তা তো আরও বড় এবং চিরস্থায়ী। কারণ তারা আল্লাহর জন্য এখলাছের সাথে ইবাদত করেছে এবং তাদের একত্ববাদের সাথে কোন র্শিক মিশায়নি। কারণ র্শিকই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অত্যাচার।
৪. তাওহীদ হচ্ছে মানুষের মনের শক্তির উৎস। তা তাকে মানসিক শক্তি যোগায়। ফলে তার অন্তর আল্লাহ্ হতে প্রাপ্তির আশায় ভরে যায়। তার উপর বিশ্বাস জন্মে এবং তাঁর উপর ভরসা করে, তাঁর বিচারে মন খুশী থাকে, তাঁর হতে প্রদত্ত বিপদে সহ্য ক্ষমতা আসে। সৃষ্টি থেকে সে মুখ ঘুরাতে পারে, সে পাহাড়ের মত অটল হয়ে যায়। যখনই সে কোন বিপদে পতিত হয়, তখনই বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহকে ডাকতে থাকে। সে কখনও মাজারে মৃতের কাছে ফরিয়াদ করতে যায় না। তাদের নিদর্শন হচ্ছে নবী (সঃ)-এর নিম্নোক্ত হাদীসেঃ
“যখন কোন কিছু চাও শুধু আল্লাহর কাছেই চাও, যখন কোন সাহায্য চাও তাঁর কাছেই চাও।” (তিরমিযী, হাসান, ছহীহ)।
তাঁরা সাথে সাথে আল্লাহ্ পাকের ঐ কথার উপর আমল করে-
“যখন আল্লাহ পাক তোমাকে কোন বিপদ স্পর্শ করান, তখন তিনি ছাড়া কেউ তাকে দূর করার নেই।” (সুরা আনআমঃ ১৭)
৫. তাওহীদ হচ্ছে ভ্রাতৃত্ব এবং একতার বন্ধনের মূল। কারণ তা কখনই এমন অনুমতি দেয় না যে, আল্লাহকে ছেড়ে একদল লোক অপর দলকে রব হিসেবে মানবে। কারণ, উপাসনা করতে হবে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবং সমস্ত মানুষের ইবাদত পাওয়ার যোগ্যতা একমাত্র তিনিই রাখেন। আর সমস্ত আবেদদের মুকুট হচ্ছেন মুহাম্মদ (সঃ) যাকে আল্লাহ্ নির্বাচন করেছেন সকলের মধ্য হতে।

“‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”এর ফযীলত
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর স্বাক্ষ্য যে ব্যক্তি দেয় তিনি মুসলিম, সর্বোত্তম জিনিস ঈমান লাভ করে। সে হয় অনুগ্রহ লাভের যোগ্য এক আল্লাহর বান্দা।‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর অনেক ফযীলত। সংক্ষিপ্ত ভাবে এখানে কিছু ফযীলতের কথা আমরা তুলে ধরছি-
মানুষের জীবনের চুড়ান্ত সফলতা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। এ কালেমা জান্নাতে প্রবেশ করায়। আল্লাহর রাসুল বলেন,
“যে ব্যক্তি মারা গেল এ অবস্থায় যে সে জানে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ হক্ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম হা/২৬)
রাসুল (সঃ) আর ও বলেন,
“যে ব্যক্তি সত্যতার সাথে খাঁটি অন্তরে বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”। (মুসলিম)
তবে অবশ্যই এর জন্য শর্ত হচ্ছে বান্দাকে শিরক মুক্ত থাকতে হবে, যাবতীয় ইবাদত স্রেফ আল্লাহর জন্য নিবেদন করতে হবে। কারণ আল্লাহতা‘য়ালা বলেনঃ
“কেহ আল্লাহর সাথে শরীক করলে আল্লাহ তাঁর জন্য জান্নাতকে অবশ্যই হারাম করে দিবেন এবং তার আবাস জাহান্নাম। যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নাই।” (সূরা-মায়েদা, ৫:৭২)
মানুষের চুড়ান্ত ব্যর্থতা হচ্ছে জাহান্নামের অধিবাসী হওয়া। যে ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে সে ধ্বংসের গহবরে পড়বে।এমন মহান কালেমা যে তা জাহান্নামকে হারাম করে দেয়।
আল্লাহর রাসুল (সঃ) বলেন-
“যে কেউ অন্তর হতে সত্য সহকারে এ কালেমার স্বাক্ষ্য প্রদান করবে যে, (আল্লাহ ছাড়া কোন হক্ ইলাহ নেই) এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর রাসুল আল্লাহ তাঁর উপর জাহান্নমের আগুন কে হারাম করে দিবেন।” (বুখারী,মুসলিম)
কিয়ামতের কঠিন এবং ভয়াবহ মূহুর্তে এ কালিমার স্বাক্ষ্যদানকারীর জন্য নবী (সঃ) সুপারিশ করবেন। প্রিয় নবী (সঃ)এরশাদ করেন-
“আমার শাফায়াত পেয়ে সর্বাধিক সাফল্য লাভ করবে ঐ ব্যক্তি যে তার অন্তর থেকে খালেসভাবে বলবে- (বুখারী, কিতাবুল ইলম)
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর যিকর করতে সমস্ত মাখলুক আদিষ্ট । এ কালেমার যিকির সর্বোত্তম যিকির। নবী (সঃ)বলেন-
“সর্বোত্তম যিকির হচ্ছে-“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।(সহীহ সুনানে তিরমিজি লিল আলবানী ৩/২৬৯৪)
এ কালেমা যে স্বীকার করে নেবে এবং শিরক মুক্ত থাকবে সে নিরাপত্তা লাভ করবে। প্রিয় নবী (সঃ) বলেন,
“যে ব্যক্তি বলে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় তা সবই অস্বীকার (বর্জন)করে তার সম্পদ এবং রক্ত হারাম। আর তার হিসাব আল্লাহর উপর।” (মুসলিম)
আখেরাতের চিরস্থায়ী সুখ দেয় এবং গুনাহ মাফ করায়। শেখ আব্দুল্লাহ খৈয়্যাথ দালিলুর মুসলিম ফি-এ তেক্কাদ ওয়া তাথহীর-কিতাবে বলেন- মানুষ প্রকৃতিগত কারণে এবং মাসুম না হওয়ার কারণে মাঝে মাঝে পদলিত হয়। ফলে আল্লাহ পাকের বিরুদ্ধে পাপের মধ্যে লিপ্ত হয়। যদি সে র্শিক হতে বেঁচে খালেছ তাওহীদের অধিকারী হয়, তবে অবশ্যই তার একত্ববাদ শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য এবং এখলাস থাকবে বলার মধ্যে। ফলে এটা তার সবচেয়ে বড় কারণ হবে সুখের জন্য এবং তার গুনাহ মাফের জন্য এবং পাপকে দূরীভূত করার জন্য; যা নবী (সঃ)-এর হাদীসে এসেছেঃ
“যে সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোন উপাস্য নাই। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় এবং মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা এবং তাঁর প্রেরিত রাসূল। আর ঈসা (আঃ) আল্লাহর দাস এবং আল্লাহ তা’আলার ঐ কথা যা মরিয়ম (আঃ)- এর প্রতি প্রেরণ করেছিলেন এবং তিনি ঈসা (আঃ) আল্লাহ্ হতে প্রেরিত রূহ, জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য- তবে তাকে আল্লাহ পাক জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, সে যে কোন আমলই করুক না কেন।” (বুখারী ও মুসলিম)
এই সমস্ত সাক্ষ্য যখন কোন মুসলমান দিবে, তখন তার জন্য জান্নাতে প্রবেশ করা ওয়াজেব হবে, যা চিরস্থায়ী নেয়ামতের জায়গা, যদিও তার কোন কোন আমলে দোষ থাকে এবং কমতি থাকে। হাদীসে কুদসীতে পাওয়া যায় আল্লাহ পাক বলেনঃ
“হে আদমের সন্তান, যদি তুমি কোন র্শিক না করে আমার সামনে দুনিয়া ভর্তি পাপরাশি সহ হাজির হও, তবে আমি তোমাকে দুনিয়া ভর্তি ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করব।” (তিরমিযী)
অর্থাৎ, যদি আমার কাছে আস দুনিয়া পূর্ণ গুণাহ এবং পাপ নিয়ে, কিন্ত এমতাবস্থায় যে তুমি একমাত্র তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করেছ, তবে আমি অবশ্যই তোমার গুনাহখাতা মাফ করে দিব। অন্য হাদীসে আছেঃ
“যে আল্লাহ পাকের সাথে কোন র্শিক করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করে অবশ্যই সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যে র্শিকের উপরে মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (মুসলিম)
এই সমস্ত হাদীসসমূহ তাওহীদের ফযীলত প্রকাশ করছে। মানুষের সুখের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় কাজ। তার গুনাহ মাফের জন্য এবং তার ভুলভ্রান্তি মুছে ফেলার জন্য এটাই সবচেয়ে বড় অছিলা।

নিজ জীবনে তাওহীদ বাস্তবায়ন বা তাওহীদ প্রতিষ্ঠা
তাওহীদের বাস্তবায়ন হলঃ তাওহীদকে র্শিক, বিদ্আত ও পাপাচার মুক্ত করা।তাওহীদকে কলুষ মুক্ত করা দু’রকমঃ
ওয়াজিব ও মান্দুব বা মুস্তাহাব।

ওয়াজিব তাওহীদ তিন বিষয়ের মাধ্যমে হয়ঃ
• তাওহীদকে এমন র্শিক, হতে মুক্ত করা, যা মূল তাওহীদের পরিপন্থী।
• তাওহীদকে এমন বিদ্আত হতে মুক্ত করা যা তাওহীদের পরিপূর্ণতার পরিপন্থী বা মূল তাওহীদের পরিপন্থী অথবা সে বিদ্আত যদি কুফুরী পর্যায়ের হয়ে থাকে।
• তাওহীদকে এমন পাপকর্ম হতে মুক্ত করা যা তাওহীদের (অর্জিত) পূণ্য হ্রাস করে এবং তাওহীদে কু-প্রভাব ফেলে।
আর মান্দুব (তাওহীদ) হলো মুস্তাহাব কাজ। যেমন নিম্নরূপঃ
• ইহ্সানের (ইখলাসের) পূর্ণ বাস্তবায়ন।
• ইয়াকীনের পূর্ণ বাস্তবায়ন করা।
• আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট অভিযোগ না করে পূর্ণ ধৈর্য ধারণ করা।
• সৃষ্টি জীব হতে মুক্ত হয়ে শুধু মাত্র আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়াই যথেষ্ঠ মনে করা।
• কিছু বৈধ উপকরণ ত্যাগের মাধ্যমে আল্লাহর উপর পূর্ণ তাওয়াক্কুলের প্রকাশ। যেমন-ঝাড় ফুঁক ও দাগা (রোগ
• নিরাময়ের জন্য) ছেড়ে দেওয়া।
• নফল ইবাদাত করে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যমে পূর্ণ ভালবাসা লাভ করা।
অতঃপর যারা তাওহীদকে বাস্তবায়ন করবে উপরে বর্ণনানুপাতে এবং বড় র্শিক হতে বেঁচে থাকবে, তারা জাহান্নামে চিরস্থায়ী বসবাস করা হতে পরিত্রান লাভ করবে। আর যারা বড় ও ছোট র্শিক করা হতে বেঁচে থাকবে এবং বড় ও ছোট পাপ হতে দূরে থাকবে, তাদের জন্য দুনিয়াতে ও আখিরাতে পূর্ণ নিরাপত্তা রয়েছে।আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
“নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে র্শিকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না। আর ইহা ব্যতীত যাকে ইচ্ছা করেন (তার অন্যান্য অপরাধ) ক্ষমা করে দেন।” (সূরা আন-নিসা, আয়াত, ৪৮)
তিনি আরো বলেনঃ
“যারা ঈমান আনে এবং স্বীয় বিশ্বাসকে র্শিকের সাথে মিশ্রিত করেনা, তাদের জন্যই শান্তি এবং তারাই সুপথগামী।” (সূরা, আল-আনআম, আয়াত-৮২)

অন্তরের কাঠিন্য – ডঃ আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস পর্ব -১

 
হালাল ও হারাম সম্পর্কিত একটি বিখ্যাত হাদীসে  মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্তেরর গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন :


“আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে আর যা অসুস্থ হলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেটি হচ্ছে হৃদয়।” [সম্পূর্ণ হাদীসটি হচ্ছে : আন-নু’মান বিন বাশীর কর্তৃক বর্ণিত : আমি আল্লাহ’র রাসূলকে বলতে শুনেছি, “হালাল ও হারাম উভয়েই স্পষ্ট, কিন্তু এ দুটির মাঝখানে রয়েছে সন্দেহজনক বিষয়সমূহ যা অধিকাংশ লোকই জানেনা। সুতরাং যে নিজেকে সন্দেহজনক বিষয় থেকে বাঁচিয়ে চলে, সে তার দ্বীন ও সম্মানের সংরক্ষণ করে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে, তার উদাহরণ হচ্ছে সেই রাখালের মত যে তার মেষপাল চরায় কোন সংরক্ষিত চারণভূমির কাছাকাছি এমন ভাবে যে, যে কোন মুহূর্তে সে তাতে প্রবেশ করবে। (হে লোকসকল!) সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহরই একটি সংরক্ষিত সীমানা আছে এবং আল্লাহর সংরক্ষিত সীমানা হচ্ছে তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। সাবধান! আমাদের শরীরে এমন একটি মাংস পিণ্ড রয়েছে যা সুস্থ (পরিশুদ্ধ) থাকলে সারা শরীর সুস্থ থাকে, কিন্তু যদি তা কলুষিত হয়ে যায় সারা শরীর কলুষিত হয় এবং সেটি হচ্ছে হৃদয়।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড, ৪৯ নং হাদীস)
কথাটি তিনি বলেছেন, প্রথমে একথা ব্যাখ্যা করার পর যে হালাল স্পষ্ট, হারামও স্পষ্ট এবং এদের মাঝখানের ক্ষেত্রটি অস্পষ্ট যা অনেকেই জানেনা। যাহোক, যা একজন মানুষকে হারাম থেকে বাঁচতে ও হালাল অবলম্বন করতে সাহায্য করে তা হচ্ছে জ্ঞান ; এবং জ্ঞান ছাড়া আর যা একাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে অন্তেরর অবস্থা। যদি অন্তর পরিশুদ্ধ হয়, জ্ঞানকে ব্যবহার করে তা হারাম এড়িয়ে চলতে পারে। যদি তা কলুষিত হয়, জ্ঞান কোন উপকারে আসে না এবং মানুষ নিষিদ্ধ বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে।
বিদায় হজ্বে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবাদের ও অনাগত মুসলিম জাতিসমূহের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন যে, কোন অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই ; কালোর উপর সাদার কোন প্রাধান্য নেই, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহকে ভয় করে – যে তাকওয়া অর্জন করেছে। এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বলেন, “তাকওয়ার অবস্থান হচ্ছে আমাদের অন্তের।” এটি এবং অনুরূপ আরো বক্তব্যে অন্তেরর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে – যাকে আল্লাহ তাঁর সৃষ্ট অন্য সব অঙ্গের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন।
ঈমানের অবস্থান এখানেই। শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যদি আল্লাহর আরো কাছের হতো, তাকওয়া সেখানেই অবস্থান করতো, কারণ মানুষের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো ঈমান। এ ছাড়া আর কিছুরই মূল্য নেই। যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যারা তাঁর বাণী গ্রহণ করেছে এবং যারা জান্নাতকে জাহান্নামের পরিবর্তে বেছে নিয়েছে – ঈমান তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ঈমান বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য। দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে ঈমানের মূল্য বেশী। সেজন্য আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন একজন মানুষকেও ইসলামের পথ দেখানো দুনিযার সব কিছুর চেয়ে উত্তম। কারো জন্য অন্য কাউকে ঈমান অর্জনে সাহায্য করা যে কোন পার্থিব বস্তুর চেয়ে মূল্যবান।
কাজের শুদ্ধতার বিচার করা হয় হৃদয়ের অবস্থা দিয়ে। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্ললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে :
“কর্মের বিচার করা হয় নিয়ত অনুসারে।” নিয়ত বা ইচ্ছার স্থান ঠোঁটে নয়, হৃদয়ে। [হাদীসটির পূর্ণ বক্তব্য : উমর বিন খাত্তাব বর্ণনা করেছেন : আল্লাহর রাসূল বলেছেন, “কর্মফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেকই তা পাবে যা সে চেয়েছে। অতএব, যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের জন্য হিজরত করেছে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যেই। আর যে কোন পার্থিব স্বার্থ অর্জন বা কোন মহিলাকে বিয়ের উদ্দেশ্যে হিজরত করেছে, তার হিজরত সে জন্যই যে জন্য সে হিজরত করেছে।”] (বুখারী, প্রথম খণ্ড,  ৫১ নং হাদীস)
আমরা যে কাজই বাহ্যিকভাবে করি না কেন, আমাদের হৃদয়ের অবস্থা তখন কি ছিল, তা দিয়েই তার বিচার হবে। এগুলি হচ্ছে ভাল কাজ। মন্দ কাজ মন্দই, কিন্তু ভাল কাজ বলতে আমরা যা বুঝি তা সেসব কাজ যা ন্যায়পরায়ণতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আল্লাহ বিচার করবেন সত্যিই সেগুলি ন্যায় কাজ কিনা।
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন যে প্রথম যে তিন ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুনে ফেলা হবে তারা মানুষের দৃষ্টিতে বড় বড় কল্যাণকর কাজে লিপ্ত ছিল। তারা হচ্ছে জ্ঞানের প্রচারে নিয়োজিত আলেম, ধনী ব্যক্তি যে তার সম্পদ থেকে দান করতো এবং আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে শাহাদাৎ বরণকারী। একটি সহীহ হাদীসে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে তারা প্রথম জাহান্নামে নিক্ষিপ্তদের অন্তর্ভূক্ত হবে। কারণ সেই আলেম আল্লাহর সন্তুটির জন্য জ্ঞান প্রচার করতো না, করতো মানুষের কাছে বড় একজন জ্ঞানী হিসাবে সম্মান ও প্রশংসা পাওয়ার জন্য। আলাহ তাকে বলবেন : “দুনিয়াতে তুমি যা চেয়েছিলে সেই প্রশংসা তুমি পেয়ে গেছো, আখিরাতে তোমার জন্য কিছু নেই।” তারপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। একইভাবে ধনী লোকটিও তার ধন-সম্পদ উদার হস্তে দান করতো যাতে লোকে তাকে মহান দাতা হিসাবে প্রশংসা করে। কিন্তু আল্লাহ বলবেন, “তুমি প্রশংসার জন্য দান করেছ এবং তা পেয়েছো। তুমি বিশুদ্ধভাবে আল্লাহর জন্য তা করনি। যতক্ষণ লোকে প্রশংসা করেছে, তুমি বদান্যতা দেখিয়েছো, কিন্তু লোকে যখন তোমার প্রতি মনোযোগ দেয়নি, তুমিও দান করা বন্ধ করে দিয়েছ। তোমার বদান্যতা ছিল শর্তযুক্ত, আলাহর সন্তুষ্টির জন্য নয়।” অতঃপর তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আর যে আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছিল, আল্লাহ তাকে বলবেন : “তুমি এজন্য যুদ্ধ করেছো যে লোকে তোমাকে বলবে কত বড় একজন শক্তিশালী ও বীর যোদ্ধা তুমি!” লোকে তার প্রশংসা করেছে, কিন্তু সে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করেনি, সুতরাং তাকে উপুড় করে টেনে নিয়ে গিয়ে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে।
এসব কিছুই আমাদের এই শিক্ষা দিচ্ছে যে যদি হৃদয় অসুস্থ হয়, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, বড় বড় সৎকর্মও কোন কাজে আসবে না। সুতরাং হৃদয়ের প্রতি আমাদের গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত। নিজেদের হৃদয়ের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমাদের প্রচুর সময় দিতে হবে। যখন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীকের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে মানুষকে বলছিলেন, তিনি বলেছিলেন;


“সে তোমাদের চেয়ে বেশী সালাত আদায় করে না বা রোযা রাখেনা, তোমাদের অনেকেই তার চেয়ে বেশী সালাত আদায় কর ও রোযা রাখ, কিন্তু তার হৃদয়ে এমন কিছু আছে যা গভীরভাবে প্রোথিত … তা হচ্ছে তার হৃদয়ে অবস্থিত ঈমান।”
এখানেই ছিল তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। অতএব একজন মুমিনের কাছে মানব শরীরে ও অস্তিত্বে আর কোন যোগ্যতা থাকতে পারে না যে সম্পর্কে সে আরো অধিক সচেতন হবে। আল্লাহ যেভাবে চান সেভাবে এই দক্ষতা/যোগ্যতা ক্রিয়াশীল করার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। এ সম্পর্কে আমাদের খুব বেশী সচেতন হতে হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রায়ই দুআ শুরু করতেন এভাবে :


“হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা উপকারী নয় এবং এমন হৃদয় থেকে যা ভীত নয়।”
মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন। তিনি মানুষের সাথে খুবই নম্র ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রীরা বলেছেন যে তাঁরা এমন কোন ঘটনার কথা মনে করতে পারেন না যেখানে তিনি তাঁদের সাথে কর্কশ ভাষায় কথা বলেছেন বা তাঁদের আঘাত করেছেন। তিনি তাঁর নম্রতার জন্য সুপরিচিত ছিলেন। এবং আল্লাহ এই গুণটিকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা আলে-ইমরানে আল্লা বলেছেন :


“আল্লাহর দয়ার কারণেই তুমি তাদের সাথে নম্র। যদি তুমি রূঢ় ও কঠিন-হৃদয় হতে, তাহলে তারা তোমার কাছে থেকে দূরে সরে যেতো।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩ : ১৫৯)
নবীদের বৈশিষ্ট্য ছিল এটাই এবং এই বৈশিষ্ট্য তাদেরও অবশ্যই অর্জন করতে হবে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ দেখায়। যেহেতু নবীদের জন্য এই গুণটি আবশ্যকীয়, এটি আমাদের জন্যও আবশ্যকীয়। যারা জ্ঞানের সন্ধানী তাদের জন্য এটি দরকারী, সব মানুষের জন্যই এটি দরকারী। আর পিতামাতার জন্যও ছেলেমেয়েদের প্রতি কোমল-হৃদয় হওয়া বাঞ্ছনীয়।
হৃদয়ের কোমলতা এমন একটি বিষয় যাতে আমরা প্রচুর সময় দিলেও যথেষ্ট হবে না। একবার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল-আকরা বিন হারিস এর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তার একটি বাচ্চাকে কোলে বসিয়ে আদর করে চুমা দিলেন। আল-আকরা বলল : “আমার আরও দশটি ছেলেমেয়ে আছে, কিন্তু আমি কখনো তাদের কাউকে চুমা দেইনি।” এটি ছিল একটি গর্বের বিষয়, পৌরুষ – যা কোমল নয়, কঠোর। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, “আল্লাহ যদি তোমার অন্তর থেকে দয়ামায়া সরিয়ে নিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কি করার আছে!” তিনি আরো বললেন, “যে অন্যকে দয়া করে না সে দয়া পাবে না।” সুতরাং বাচ্চাদের প্রতি কোমল আচরণ করা পিতামাতার জন্য জরুরী। যে ঘরে বাবা ছেলেমেয়েদের প্রতি দয়ালু ও ক্ষমাশীল, সে ঘর সুখ ও আনন্দে ভরা থাকে।
দয়া এমন কিছু যা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। যারা জ্ঞানের সন্ধানী, যেহেতু দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক, জ্ঞানের সাথে যদি সে কোমল হৃদয়ের অধিকারী না হয়, তবে জ্ঞানের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা সম্ভব হয় না। যেমন হাসান আল-বসরী বলেছেন, “যদি কেউ জ্ঞান অনুসন্ধান করে, তা তার চেহারা, হাত ও জিহবায় এবং আল্লাহর প্রতি তার বিনয়ে প্রকাশ পাবে।” এর বিপরীত কথাটিও সত্য যে কোন কিছুই জ্ঞানকে এবং দ্বীনের প্রতি আহ্বানের কাজকে ততটা নষ্ট করে না যতটা করে হৃদয়ের কাঠিন্য। যেখানে হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, সেখানে জ্ঞান ব্যক্তির নিজেরও কোন উপকারে লাগে না বা সে তা দিয়ে অন্যেরও উপকার করতে পারে না।
হৃদয়ের কোমলতা সত্যিকার মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এর অনুপস্থিতিতে জীবন দুর্ভোগ ও অস্বচ্ছান্দ্যে ভরে যায়। এটা আল্লাহর ওয়াদা। যাদের হৃদয় কোমল নয় তারা দুর্ভোগময় জীবন যাপন করবে। যেমন সূরা আয-যুমারে আল্লাহ বলেছেন :


“যাদের অন্তর আল্লাহর স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্য দুর্ভোগ।” (সূরা আয-যুমার, ৩৯ : ২২)
তারা সুস্পষ্ট পথভ্রষ্টতার মধ্যে রয়েছে। তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা কুরআন শ্রবণ করে কিন্তু তারপরও তারা ভীত ও বিনীত হয় না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের চোখকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেও আল্লাহর ভয়ে তা ক্রন্দন করে না। দুর্ভোগ তাদের জন্য যাদের কাছে আল্লাহর সতর্কবাণী পৌঁছানোর পরও তারা তাঁর বাণীর প্রতি শ্রদ্ধাবনতও হয় না। কঠিন-হৃদয় বিশিষ্ট হওয়া একটি অভিশাপ আর হৃদয়ের নম্রতা সৌভাগ্যের কারণ। জীবনের সমস্ত কাম্য বস্তুর অধিকারী হলেও কঠিন হৃদয়-সম্পন্ন ব্যক্তি কষ্ট ভোগ করে। আপাত দৃষ্টিতে সুখময় মনে হলেও  তা এক শূন্য জীবন — একাকীত্বে পূর্ণ। তারা মনে এবং অন্তের শান্তি পায় না, কারণ তাদের অন্তর আল্লাহর প্রতি কঠিন – আল্লাহকে বিশ্বাসের ব্যাপারে ও তার আনুগত্যের ব্যাপারে। সেজন্যই আল্লাহ বলেছেন, যে তাঁর স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে দুদর্শাগ্রস্ত জীবন যাপন করবে।


“… যে আমার বাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য রয়েছে সংকীর্ণ জীবন, আর বিচার দিবসে আমরা তাকে উত্থিত করবো অন্ধ করে।” (সূরা তা-হা, ২০ : ১২৪)
এবং তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা’আলা) বলেছেনম একমাত্র আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্ত হয়।


“যারা বিশ্বাস করে, এবং যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে তৃপ্তি লাভ করে : নিঃসন্দেহে আল্লাহর স্মরণেই হৃদয়সমূহ শান্তি লাভ করে।”(সূরা রা’দ, ১৩ : ২৮)
এ জীবনে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হচ্ছে একটি কোমল হৃদয়। আমরা হৃদয়ের কোমলতা অর্জনে চেষ্টা করবো। কারণ এছাড়া সবকিছুই অর্থহীন ও অপ্রয়োজনীয় হয়ে যাবে। কিভাবে আমরা তা অর্জন করতে পারি ? (চলবে)

তাগুত এর অর্থ এবং এর প্রধান প্রধান অংশ

গ্রন্থনা: শাইখ আব্দুল্লাহ ইব্‌ন ইবরাহীম আল কার‘আওয়ী

অনুবাদ: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

এ-কথা জানা প্রয়োজন যে, আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির উপর সর্ব প্রথম যা ফরজ করেছেন তা হচ্ছে তাগুতের সাথে কুফরি এবং আল্লাহর উপর ঈমান।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর নিশ্চয়ই আমি প্রত্যেক জাতির কাছে রাসূল পাঠিয়েছি এ কথা বলে যে, তোমরা শুধু আল্লাহর 

উপাসনা কর এবং তাগুতকে পরিত্যাগ কর।” [সূরা আন্‌-নাহল: ৩৬]
 
তাগুতের সাথে কুফরির ধরণ হলো : আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুর উপাসনা (ইবাদত) বাতিল বলে বিশ্বাস করা, তা ত্যাগ করা, ঘৃণা ও অপছন্দ করা, এবং যারা তা করবে তাদের অস্বীকার করা, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করা।
আর আল্লাহর উপর ঈমানের অর্থ হলো : আল্লাহ তা‘আলাই কেবলমাত্র হক উপাস্য ইলাহ, অন্য কেউ নয়— এ-কথা বিশ্বাস করা, আর সবরকম ইবাদতকে নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা যাতে এর কোন অংশ অন্য কোন উপাস্যের জন্য নির্দিষ্ট না হয়; আর মুখলিস বা নিষ্ঠাবানদের ভালবাসা, তাদের মাঝে আনুগত্যের সম্পর্ক স্থাপন করা, মুশরিকদের ঘৃণা ও অপছন্দ করা, তাদের শত্রুতা করা।
আর এটাই ইবরাহীম আলাইহিস্‌সালাম এর প্রতিষ্ঠিত দীন বা মিল্লাত, যে ব্যক্তি তার থেকে বিমুখ হবে সে নিজ আত্মাকে বোকা বানাবে, আর এটাই হলো সে আদর্শ (أسوة) বা (Model) যার কথা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বাণীতে বলেছেন : “অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে ইবরাহীম ও তার সাথীদের মাঝে সুন্দর আদর্শ, যখন তারা তাদের জাতিকে বলেছিল: আমরা তোমাদের এবং আল্লাহ ছাড়া তোমাদের অপরাপর উপাস্য দেবতাদের থেকে সম্পূর্ণ সম্পর্কমুক্ত, আমরা তোমাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলাম, আর আমাদের ও তোমাদের মাঝে চিরদিনের জন্য শত্রুতা ও ঘৃণার সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়ল, যে পর্যন্ত তোমরা শুধু এক আল্লাহর উপর ঈমান স্থাপন না করছ।” [সূরা আল-মুমতাহিনাঃ ৪]

তাগুত:
শব্দটি ব্যাপক, এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যা কিছুর ইবাদত বা উপাসনা করা হয়, এবং উপাস্য সে উপাসনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করে এমন সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে, চাই কি তা দেবতা, বা নেতা, বা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণের বাইরে অন্য কারো অনুসরণই হোক, ঐসবগুলোকেই তাগুত বলা হবে।

আর এ তাগুত -এর সংখ্যা অত্যধিক; তবে প্রধান-প্রধান তাগুত হলো পাঁচটি :
এক: শয়তান :
যে আল্লাহর ইবাদত থেকে মানুষকে অন্য কিছুর ইবাদতের দিকে আহবান করে।
এর প্রমাণ আল্লাহর বাণী : “হে আদম-সন্তান, আমি কি তোমাদের থেকে শয়তানের ইবাদত না করার অঙ্গিকার নিই নি? নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।” [সূরা ইয়াসিন: ৬০]
দুই: আল্লাহর আইন (হুকুম) পরিবর্তনকারী অত্যাচারী শাসক :
এর প্রমাণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী: “আপনি কি তাদের দেখেন নি যারা মনে করে আপনার কাছে এবং আপনার পূর্ববর্তীদের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর ঈমান এনেছে, তারা তাগুতকে বিচারক হিসাবে পেতে আকাঙ্ক্ষা করে অথচ তাদেরকে এর (তাগুতের) সাথে কুফরির নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর শয়তান তাদেরকে সহজ সরল পথ থেকে অনেক দুর নিয়ে যেতে চায়।” [সূরা আন্‌নিসাঃ ৬০]
তিন : আল্লাহ কর্তৃক অবতীর্ণ (আইনের) হুকুমের বিপরীত হুকুম প্রদানকারী :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর যারা আল্লাহর অবতীর্ণ আইন অনুসারে বিচার করে না তারা কাফের।” [সূরা আল মায়েদা: ৪৪]

চার : আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন গায়েবের খবর রাখার দাবিদার :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “তিনি গায়েবের জ্ঞানে জ্ঞানী, সুতরাং তার অদৃশ্য জ্ঞানকে কারও জন্য প্রকাশ করেন না, তবে যে রাসূল এর ব্যাপারে তিনি সন্তুষ্ট তিনি তাকে তার সম্মুখ ও পশ্চাৎ থেকে হিফাজত করেন।” [সূরা আল-জিন: ২৬, ২৭]
অন্য আয়াতে বলেন : “আর তার কাছেই সমস্ত অদৃষ্ট বস্তুর চাবিকাঠি, এগুলো তিনি ছাড়া আর কেউ জানে না, তিনি জানেন যা ডাঙ্গায় আছে আর যা সমুদ্রে আছে। যে কোন (গাছের) পাতাই পতিত হয় তিনি তা জানেন, জমিনের অন্ধকারের কোন শস্য বা কোন শুষ্ক বা আর্দ্র বস্তু সবই এক প্রকাশ্য গ্রন্থে সন্নিবেশিত আছে।” [সূরা আল-আন‘আম: ৫৯]

পাঁচ : আল্লাহ ছাড়া যার ইবাদত করা হয় এবং সে এই ইবাদতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট :
আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আর তাদের থেকে যে বলবে- আল্লাহ ব্যতীত আমি উপাস্য, তাকে আমি জাহান্নাম দ্বারা পরিণাম ফল প্রদান করব, এভাবেই আমি অত্যাচারীদের পরিণাম ফল প্রদান করে থাকি”। [সূরা আল-আন্‌বিয়াঃ ২৯]


মনে রাখা দরকার কোন মানুষ তাগুতের উপর কুফরি ছাড়া ইমানদার হতে পারেনা, আল্লাহ বলেন : “সুতরাং যে তাগুতের সাথে কুফরি করে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে সে এমন মজবুত রজ্জুকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে যার কোন বিভক্তি বা চিড় নেই, আর আল্লাহ সর্ব শ্রোতা ও সর্ব জ্ঞানী।” [সূরা আল-বাকারা: ২৫৬]
এ আয়াতের পূর্বাংশে আল্লাহ বলেছেন যে, “বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন পথ, ভ্রষ্ট-পথ থেকে স্পষ্ট হয়েছে”। ‘বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন পথ’ বলতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দীনকে, আর ‘ভ্রান্ত-পথ’ বলতে আবু জাহলের দীন, আর এর পরবর্তী আয়াতের ‘মজবুত রশি বা রজ্জু’ দ্বারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (বা আল্লাহ ছাড়া হক কোন উপাস্য নেই) এ সাক্ষ্য প্রদানকে বুঝিয়েছেন।
‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এ কলেমা কিছু জিনিসকে নিষেধ করে, এবং কিছু বস্তুকে সাব্যস্ত করে, সকল প্রকার ইবাদতকে আল্লাহর ছাড়া অন্যের জন্য হওয়া নিষেধ করে। শুধুমাত্র লা-শরীক আল্লাহর জন্য সকল প্রকার ইবাদতকে নির্দিষ্ট করে।

“আল্লাহর জন্যই সমস্ত শোকর, যার নেয়ামত ও অনুগ্রহেই যাবতীয় ভাল কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।”

তাওহীদের প্রকারভেদ

তাওহীদ এবং এর শ্রেনী বিভাগ

তৌহিদের আক্ষরিক অর্থ একীকরণ (কোন কিছু এক করা) অথবা দৃঢ়ভাবে এককত্ব ঘোষণা করা এবং এটার উৎপত্তি আরবী ‘ওয়াহহাদা’ শব্দ হতে যার অর্থ এক করা, ঐক্যবদ্ধ করা অথবা সংহত হওয়া। কিস্তু যখন তৌহিদ শব্দটি আল্লাহর (অর্থাৎ তৌহিদুল্লাহ) সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয় তখন আল্লাহ সম্পর্কিত মানুষের সকল পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কর্মকান্ডে আল্লাহর এককত্ব উপলদ্ধি করা ও তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অক্ষুন্ন রাখা বুঝায়। আল্লাহ এক, তাঁর আধিপত্যে এবং তাঁর কর্মকান্ডে (রবুবিয়াহ) কোন শরীক বা অংশীদার নেই। এটাই বিশ্বাস যে, আল্লাহ একক, তাঁর রাজত্বে এবং কর্মে কোন শরীক নেই (রবুবিয়াহ)। তিনি তাঁর মৌলিকত্বে এবং গুণাবলীতে অতুলনীয় (আসমা ওয়াস সিফাত) এবং উপাস্যরূপে চির অপ্রতিদ্বন্দ্বী (উলুহিয়াহ/ইবাদাহ)। এই তিনটি বিষয়কে ভিত্তি করে তাওহীদের শ্রেণী বিন্যাস করা হয়েছে। এই শ্রেণী তিনটি পরস্পর ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং একটির সঙ্গে অপরটি এতই অবিচ্ছেদ্য যে, কেউ যদি একটি বিষয় বাদ দেন তাহলে তিনি তাওহীদের শর্ত পূরণে ব্যর্থ হবেন। উপরে বর্ণিত তাওহীদের যে কোন একটি বিষয় বাদ দেয়াকে “শির্ক” (অংশীদারী) বলে; আল্লাহকে অংশীদারদের সঙ্গে সংযুক্ত করা, যা ইসলাম অর্থে প্রকৃতপক্ষে পৌত্তলিকতা।
তাওহীদের তিন শ্রেণীকে সাধারণতঃ নিম্নলিখিত শিরোনামে উল্লেখ করা হয়ে থাকেঃ
১) তাওহীদ আর-রবুবিয়াহ (প্রতিপালকের এককত্ব অক্ষুন্ন রাখা)
২) তাওহীদ আল-আছমা ওয়াছ ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুনাবলীর এককত্ব বজায় রাখা)
৩) তাওহীদ আল-ইবাদাহ (আল্লাহর ইবাদতের এককত্ব বজায় রাখা)

রাসুল (সঃ) এর সময় তাওহীদের মূল তত্ত্বগুলি এমনভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছিল না বিধায় রাসূল (সাঃ) অথবা তাঁর সাহাবাগণ কর্তৃক তাওহীদকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়নি। তা সত্ব্ওে,কোরআনের আয়াত এবং রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগণের ব্যাখ্যামূলক বক্তব্যের মাধ্যমে তাওহীদের শ্রেণীগুলি ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে।
তাওহীদ আর-রবুবিয়াহ –
তাওহীদ আর-রবুবিয়ার মূল কথা হচ্ছে যে যখন কিছুই ছিল না তখন আল্লাহ একই সকল সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দেন; সৃষ্টি থেকে অথবা সৃষ্টির জন্য কোন প্রয়োজন মেটানোর কারণ ব্যতিরেকেই আল্লাহ সৃষ্ট জগৎ প্রতিপালন করেন। তিনি সমগ্র বিশ্ব ও এর অধিবাসীদের একমাত্র প্রভু এবং তাঁর সার্বভৌমত্বের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আরবী ভাষায় “রবুবিয়াহ” শব্দটির মূল ধাতু হচ্ছে “রব” (প্রতিপালক) যা একই সাথে সৃষ্টি ক্ষমতা এবং প্রতিপালন উভয় গুণের পরিচয় বহন করে। এই শ্রেণী বিন্যাস অনুযায়ী আল্লাহই একমাত্র সত্যিকার শক্তি, তিনিই সকল বস্তুর চলাফেরা ও পরিবর্তনের ক্ষমতা দিয়েছেন। তিনি যেটুকু ঘটনা ঘটাতে দেন সেটুকু ব্যতীত সৃষ্টি জগতে কিছুই ঘটে না। এই বাস্তবতার স্বীকৃতি স্বরূপ রাসূল মুহাম্মদ (সঃ) প্রায়ই “লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ”(আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত কোন বিচলন অথবা ক্ষমতা নেই) বলে বিস্ময়সূচক উক্তি করতেন।

কোরআনের বহু আয়াতে রবুবিয়াহ আকীদার ভিত্তি পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহ বলেছেন-

“আল্লাহ সমস্ত কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা।” (সূরা আয-যূমার ৩৯: ৬২)
“প্রকৃত পক্ষে আল্লাহই সৃষ্টি করিয়াছেন তোমাদিগকে এবং তোমরা যাহা কর তাহাও।” (সুরা আছ্-ছাফফাত ৩৭: ৯৬)
“এবং তুমি যখন নিক্ষেপ করিয়াছিলে তখন তুমি নিক্ষেপ কর নাই, আল্লাহই করিয়াছিলেন।” (সূরা আল্-আনফা’ল ৮: ১৭)
“আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বিপদই আপতিত হয় না।” (সূরা আত্-তাগাবুন ৬৪: ১১)
রাসূল (সঃ) এই ধারণার আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন,


“সাবধান, যদি সমস্ত মানব জাতি তোমাকে সাহায্য করার জন্য কিছু করতে চায়, তারা শুধু অতটুকুই করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন। অনুরূপ, যদি সমস্ত মানব জাতি ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, তারা শুধু ততটুকুই ক্ষতি করতে সক্ষম হবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য আগেই লিখে রেখেছেন।”
কাজেই, মানুষ যা সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য বলে ধারণা করে তা শুধুমাত্র এই জীবনের পুর্ব নির্ধারিত পরীক্ষার অংশ। আল্লাহ যে ভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন সেই ভাবেই ঘটনাসমূহ সংঘটিত হয়। আল্লাহ কোরআনে উলেখ করেছেন,


“হে মু’মিনণ! তোমাদিগের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে তোমাদিগের (কিছু) শত্র“ রহিয়াছে; অতএব তাহাদিগের সম্পর্কে তোমরা সর্তক থাকিও।” (সূরা আত্-তাগা’বুন ৬৪:১৪)
অর্থাৎ


“মানুষের জীবনের ভাল জিনিসের মধ্যেও আল্লাহর উপর বিশ্বাসের কঠিন পরীক্ষা নিহিত আছে। অনুরূপভাবে,জীবনের কঠিন ও ভয়াবহ ঘটনাবলীতেও পরীক্ষা নিহিত রয়েছে; যেমন আয়াতে উল্লেখ হয়েছেঃ “নিশ্চয়ই আমি তোমাদিগকে ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে পরীক্ষা করিব। তুমি ধৈযশীলগণকে শুভ সংবাদ দাও।” (সূরা আল্-বাকারা ২:১৫৫)
কখনও কখনও জীবনের ঘটনাগুলো উপলদ্ধি ও ব্যাখ্যা করা সহজ যখন কার্যকরণ অনুযায়ী ফলাফল ঘটে। আবার কখন উপলদ্ধি করা কঠিন যখন আপাতঃ দৃষ্টিতে মন্দ কাজের সুফল অথবা ভাল কাজ থেকে খারাপ ফল আসে। আল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে,সীমিত জ্ঞানের জন্যে এই ধরনের আপাতঃ অনিয়মের পেছনে কি বিজ্ঞতা রয়েছে তা মানুষের প্রত্যক্ষ উপলদ্ধির বাইরে।
“কিন্তু তোমরা যাহা পছন্দ কর না সম্ভবতা তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পছন্দ করা সম্ভবতা তাহা তোমাদের কাছে অকল্যাণকর।” (সূরা-আল বাকারা ২: ২১৬)
মানুষের জীবনে আপাতঃ অকল্যাণকর ঘটনা কখনো শেষ পর্যন্ত কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয় এবং আপাতঃ কল্যাণকর জিনিস যা মানুষ পছন্দ করে তা শেষ পর্যন্ত অকল্যাণকর হয়। জীবনে যে সব সুযোগ আসে তা থেকে পছন্দ করে জীবন গড়ার মধ্যেই মানুষের প্রভাব সীমাবদ্ধ- সুযোগের প্রকৃত ফলাফলের উপর মানুষের কোন ক্ষমতা নেই। অন্য কথায়- “মানুষ প্রস্তাব করে, স্রষ্টা নিষ্পত্তি করে।”
তাওহীদুর রবুবিয়্যার প্রতি ঈমানের দাবী হচ্ছে নিম্নে লিখিত ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব মেনে নেয়াঃ


১) “আল্লাহই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা”- সূরা আন‘আম ৬:১০২/ আরাফ ৭:৫৪/ যুমার ৩৯:৬৫/ সাফফাত ৩৭:৯৬।
২) “তিনিই আসমান, যমীন এবং এর মধ্যবতী সবকিছুর প্রতিপালক”- সূরা ফাতিহা ১:১/ শুয়ারা ২৬:২৪/ নাস ৪:১।
৩) “তিনিই সবপ্রানীর একমাত্র জীবিকা দাতা”- সূরা হুদ ১১:৬/ যারিয়াত ৫১:৫৮।
৪) “সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র মালিকানা তাঁরই”- সূরা বাকারা ২:২৫৫/ মু’মিনুন ২৩:৮৪-৮৫।
৫) “আল্লাহই আসমান-যমীন সহ সব কিছুর পরিচালনাকারী”- সূরা সাজদা ৩২:৫।
৬) “আল্লাহই আসমান, যমীন এবং এর মধ্যবর্তী সমস্ত কিছুর একচ্ছত্র কতৃর্ ত্বের অধিকারী”- সূরা মু’মিনুন ২৩:৮৮।
৭) “আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী”- সূরা আলে ইমরান ৩:২৬/ ফোরকান ২৫:২/ আরাফ ৭:১৫৮।
৮) “আল্লাহই একমাত্র আইন-বিধান দাতা, হালাল-হারাম ঘোষনাকারী”- সূরা ইউসুফ ১২:৪০/ আরাফ ৭:৫৪/ রাদ
১৩:৪১/ কাসাস ২৮:৭০, ৮৮/ আন’আম ৬:৫৭/ ১০:৫৯/ ৯:৩৭/ ৫:৫০/ নাহল ১৬:১১৬।
৯) “তিনিই ভাল-মন্দ নির্ধারণকারী, সাহায্যকারী, বিপদাপদ দাতা এবং মুক্তিদাতা, রক্ষাকর্তা”- সূরা তাগাবুন ৬৪:১১/
ইউনুস ১০:১০৭/ আন’আম ৬:৬৪/ আলে ইমরান ৩:২৬/ ৭:১৮৮/ ৩:১৫০/ ৩৬:৭৪-৭৫।
১০) “তিনিই একমাত্র সন্তানদাতা এবং জীবন-মৃত্যুর মালিক”- সূরা শুরা ৪২:৪৯-৫০/ হাজ্জ ২২:৬৬।
১১) “তিনিই একমাত্র গায়েব বা অদৃশ্যের জ্ঞানী”- সূরা আন’আম ৬:৫৯/ নামল ২৭:৬৫/ লুকমান ৩১:৩৪।
তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর এককত্ব বজায় রাখা)-
এই শ্রেণীর তাওহীদের পাঁচটি প্রধান রূপ আছেঃ

১) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর এককত্ব বজায় রাখার প্রথম শর্ত হ’ল, কোরআন এবং হাদিসে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সাঃ) আল্লাহর যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন সেভাবে ছাড়া আর কোনভাবে আল্লাহর নাম এবং গুণাবলীর বর্ণনা দেয়া যাবে না। তিনি বলেন,


“এবং মুনাফিক পুরুষ ও নারী এবং মুশরিক পুরুষ ও নারী যাহারা আল্লাহ সম্বন্ধে মন্দ ধারণা পোষণ করে তাহাদিগকে তিনি শাস্তি দিবেন। উহাদিগের চারিদিকে অমঙ্গল চক্র, আল্লাহ উহাদিগের প্রতি রাগ করিয়াছেন,উহাদিগকে অভিশপ্ত করিয়াছেন এবং উহাদিগের জন্য অমঙ্গল পরিণতি প্রস্তুত রাখিয়েছেন।” (সূরা আল্-ফাত্হ্ ৪৮: ৬)
কাজেই ক্রোধ আল্লাহর গুণাবলীর একটি। এটা বলা ভূল হবে যে, যেহেতু ক্রোধ মানুষের মধ্যে একটি দুর্বলতার চিহ্ন যা আল্লাহর জন্য শোভন নয় সেহেতু আল্লাহর ক্রোধ অবশ্যই তাঁর শাস্তি বুঝায়। “কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নহে” (সূরা আশ্-শূরা ৪২: ১১) আল্লাহর এই ঘোষণার ভিত্তিতে আল্লাহর ক্রোধ যে মানুষের ক্রোধের মত নয় তা গ্রহণ করতে হবে। তথাকথিত “বিজ্ঞতাপূর্ণ” (rational interpretation) ব্যাখ্যা অনুযায়ী যখন যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তে পৌছান যায় তখন তা নাস্তিকতার জন্ম দেয়। (অনুবাদকের মতামতঃ “rational interpretation” দ্বারা খুব সম্ভবত লেখক আবু আমিনাহ এটাই বলতে চেয়েছেন যে যেহেতু “কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নহে” (৪২: ১১) কাজেই আল্লাহ মানুষের মত এবং যেহেতু মানুষের প্রাণ আছে কাজেই আল্লাহর প্রাণ থাকতে পারে না। এই যুক্তির ফলেই একজন নাস্তিকতায় উপনীত হয়। কিন্তু এটা শুধু শব্দের মারপ্যাঁচের মাধ্যমে সত্যের অপব্যাখ্যা) কারণ আল্লাহ নিজেকে জীবন্ত বলে উল্লেখ করেছেন, সুতরাং যুক্তিবাদী বিচার অনুযায়ী স্রষ্টা নিষ্প্রাণ এবং অস্তিত্বহীন নয়। প্রকৃত ব্যাপার হ’ল আল্লাহর গুণাবলীর সঙ্গে মানুষের সাদৃশ্য শুধুমাত্র নামে, মাত্রায় নয়। যখন স্রষ্টাকে উদ্দেশ্য করে গুণাবলি ব্যবহৃত হয় তখন সেগুলি সার্বভৌম অর্থে গ্রহণ করতে হবে এবং বুঝতে হবে সে সেগুলি মানব সুলভ অসম্পুর্ণতা মুক্ত।
২) তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াস-সিফাত এর দ্বিতীয় রূপ হ’ল আল্লাহর উপর কোন নতুন নাম ও গুণাবলী আরোপ না করে তিনি নিজেকে যেভাবে উলেখ করেছেন সেভাবেই তাঁকে উলেখ করা। উদাহরণস্বরূপ, যদিও তিনি বলেছেন যে তিনি রাগ করেন তথাপি তাঁর নাম আল্-গাদিব (রাগী জন) দেয়া যাবে না কারণ আল্লাহ বা তাঁর রাসুল (সাঃ) কেউ এই নাম ব্যবহার করেননি। এটা একটি ক্ষুদ্র বিষয় মনে হতে পারে,কিন্তু আল্লাহর অসত্য বা ভূল বর্ণনা রোধ করার জন্য তৌহিদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ সসীম মানুষের পক্ষে কখনোই অসীম স্রষ্টার সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
৩) তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াছ-ছিফাত এর তৃতীয় শর্ত অনুযায়ী আল্লাহকে কখনোই তাঁর সৃষ্টির গুণাবলি দেয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাইবেল ও তৌরাতে দাবী করা হয় যে আল্লাহ ছয় দিনে বিশ্ব সৃষ্টি করেন এবং তারপর সপ্তম দিনে নিদ্রা যান। এই কারণে ইহুদি ও খৃষ্টানগণ হয় শনিবার নতুবা রবিবারকে বিশ্রামের দিন হিসাবে নেয় এবং ঐ দিন কাজ করাকে পাপ বলে গণ্য করে। এই ধরণের দাবী স্রষ্টার উপর তাঁর সৃষ্টির গুণাবলী আরোপ করে। মানুষই গুরুভার কাজের পর ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং সবলতা পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের ঘুমের প্রয়োজন হয়। এর বিপরীতে আল্লাহ কোরআনে পরিস্কারভাবে উল্লেখ করেছেন,
‘‘তাঁহাকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।’’ (সূরা আল বাকারা ২ঃ২৫৫)
বাইবেল ও তৌরাতের অন্য জায়গায় উলেখ করা হয়েছে যে মানুষ যেমন তার ভূল উপলদ্ধি করে অনুতপ্ত হয় তেমনি স্রষ্টাও তাঁর খারাপ চিন্তার জন্য অনুতপ্ত হন।অনুরূপভাবে স্রষ্টা একটি আত্মা অথবা তাঁর একটি আত্মা আছে বলে দাবী করা তৌহিদ আল্-আছমা ওয়াছ ছিফাতকে সম্পুর্ণভাবে ধ্বংস করে দেয়। আল্লাহ কোরআনের কোন জায়গায় নিজেকে আত্মা বলে উল্লেখ করেননি অথবা তাঁর রাসুল (সঃ) হাদিসে ঐ ধরণের কোন বক্তব্য প্রদান করেননি। প্রকৃতপক্ষে, আল্লাহ আত্মাকে তাঁর সৃষ্টির একটি অংশ হিসাবে উলেখ করেছেন।আল্লাহর গুণাবলী উল্লেখ করতে কোরআনের আয়াতকে মৌলিক নিয়ম হিসাবে অনুসরণ করতে হবে,
“কোন কিছুই তাঁহার সদৃশ নহে, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা আশ-শূরা ৪২ঃ ১১)

শ্রবণ ও দর্শন মানুষের গুণাবলী কিস্তু যখন স্রষ্টার উপর আরোপিত করা হয় তখন সেগুলি তুলনাবিহীন এবং ত্রুটিমুক্ত। যাহোক এই গুণাবলী মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চোখ ও কান অপরিহার্য, যা স্রষ্টার জন্য প্রযোজ্য নয়। স্রষ্টা সম্বন্ধে মানুষ কেবলমাত্র ততটুকুই জ্ঞাত যতটুকু তিনি তাঁর পয়গম্বরদের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। সুতরাং, মানুষ এই সংকীর্ণ গন্ডির মধ্যে অবস্থান করতে বাধ্য। মানুষ যদি স্রষ্টার বর্ণনা দিতে লাগামহীন বুদ্ধি প্রয়োগ করে তাহলে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির গুণাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার মত ভূলের সম্ভবনা থেকে যায়।
কল্পিত চিত্রের প্রতি আসক্তির কারণে খৃষ্টানরা মানুষ সদৃশ অগণিত চিত্র অঙ্কন, খোদাই এবং ঢালাই করে সেগুলিকে স্রষ্টার প্রতিচ্ছবি নাম দিয়েছে। এইগুলি জনগণের মধ্যে যিশুখৃষ্টের দেবত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে সাহায্য করেছে। স্রষ্টা মানুষের মত, একবার এই কল্পনা গ্রহণযোগ্য হলে, যিশুখৃষ্টকে স্রষ্টা হিসাবে গ্রহণ করতে সত্যিকার কোন সমস্যা দেখা দেয় না।

৪) তাওহীদ আল্-আছ্মা ওয়াছ্-ছিফাতের চতুর্থ রূপের জন্য প্রয়োজন মানুষের উপর আল্লাহর গুণাবলী আরোপ না করা। যেমন, বাইবেলের নতুন সংস্করণে (Newtestament) পলকে (paul) তৌরাতে (Genesis 14:18-20)বর্ণিত সালেমের রাজা মেলচিজদেকের রূপে দেখান হয়েছে এবং তার ও যিশুখৃস্টের কোন আদি বা অন্ত নেই। এই বলে স্বর্গীয় গুণে গুণাম্বিত করা হয়েছেঃ


• “স্রষ্টার প্রধান পুরোহিত, সালেমের রাজা মেলচিজদেক রাজাদের বধ করার পর প্রত্যাগত আব্রাহামের সঙ্গে সাক্ষাত করলেন এবং তাকে আর্শীবাদ করলেন”;
• “এবং আব্রাহাম তাকে সব কিছুর এক দশমাংশ বিলি করে দিলেন। তাঁর নামের অর্থ হিসাবে তিনিই প্রথম ন্যয়নিষ্ঠার রাজা এবং সালেমেরও রাজা, অর্থাৎ শান্তির রাজা”
• “তিনি পিতা অথবা মাতা অথবা বংশ বৃত্তান্ত এবং আদি অন্তবিহীন; কিস্তু স্রষ্টার পুত্রের সদৃশ হয়ে চিরদিন পুরোহিত হিসাবে বহাল থাকবেন।”
• সুতরাং যিশুখৃস্টও নিজেকে প্রধান পুরোহিত পদে পদোন্নতি দেননি কিস্তু তাঁর দ্বারা নিয়োজিত হয়েছিলেন যিনি তাঁকে বললেন, “তুমি আমার পুত্র, আজ আমি তোমাকে জন্মদান করলাম;”
• যেমন তিনি অন্যখানেও বলেন,“মেলচিজদেকের পরে তুমি চিরদিনের জন্য পুরোহিত”।বেশীর ভাগ শিয়া সম্প্রাদায় (ইয়েমেনের যাইদাইদরা ছাড়া) তাদের ইমামগণকে সম্পুর্ণভাবে ভূলভ্রান্তির উর্দ্ধে (মাসুম),অতীত,ভবিষ্যত ও অদৃশ্য সম্বন্ধে জ্ঞানী,ভাগ্য পরিবর্তনে সক্ষম এবং সৃষ্টির অনুপরমাণু নিয়ন্ত্রণকারী।
৫) আল্লাহর নামের এককত্ব বজায় রাখার আরও অর্থ হ’ল যদি নামে আগে আব্দ’ (অর্থ ভৃত্য অথবা বান্দা) সংযোজিত না করা হয় তাহলে তার সৃষ্টিকে আল্লাহর কোন নামে নামকরণ করা যাবে না। কিস্তু ‘রাউফ’ এবং ‘রহিম’ এর মত বহু স্বর্গীয় নাম মানুষের নাম হিসাবে অনুমোদিত কারণ রাসুল (সঃ) কে উল্লেখ করতে যেয়ে আল্লাহ এই ধরনের কিছু নাম ব্যবহার করেছেন। হিসাবে স্বর্গীয় গুণে গুনাম্বিত করেছে। এঁটা করতে যেয়ে তারা সেই সব প্রতিদ্বন্দ্বী সৃষ্টি করেছে যারা স্রষ্টার অদ্বিতীয় গুণাবলির অংশীদার এবং আল্লাহর সমসাময়িক।
“তোমাদিগের মধ্যে হইতেই তোমাদিগের নিকট এক রাসুল আসিয়াছে। তোমাদিগকে যাহা বিপন্ন করে উহা তাঁহার জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদিগের মঙ্গলকামী,মু’মিনদের প্রতি সে দরদী (রাউফ) ও পরম দয়ালু (রহিম)।” (সূরা আত্-তওবা ৯ঃ ১২৮)
কিস্তু ‘আর-রাউফ’ (যিনি সবচেয়ে সমবেদনায় ভরপুর) এবং ‘আর রহিম’ (সবচেয়ে ক্ষমাশীল) মানুষের ব্যাপারে তখনই ব্যবহার করা যাবে যখন নামের আগে আবদ ব্যবহার করা হবে, যেমন আব্দুর-রাউফ অথবা আব্দুর রহিম। আর-রাউফ এবং আর রহিম এমন এক পূর্ণতার প্রতিনিধিত্ব করে যা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য। তেমনিভাবে,আব্দুর-রাসূল (বার্তাবাহকের গোলাম), আব্দুন-নবী (রাসুলের গোলাম), আব্দুল-হুসাইন (হুসাইনের গোলাম) ইত্যাদি নামগুলি নিষিদ্ধ, কারণ এখানে মানুষ নিজেদেরকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের গোলাম হিসাবে ঘোষণা করেছে। এই মতবাদের ভিত্তিতে, রাসুল (সঃ) মুসলিমদের তাদের অধীনস্থদের ‘আবদী’ (আমার গোলাম) অথবা ‘আমাতী’ (আমার বাঁদী) বলে উলেখ করতে নিষেধ করেছেন।তাওহীদ আল্-ইবাদাহ্ (আল্লাহর ইবাদতের এককত্ব বজায় রাখা) প্রথম দুই শ্রেণীর তাওহীদের ব্যাপক গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা থাকলেও শুধুমাত্র সেগুলির উপর দৃঢ় বিশ্বাসই তৌহিদের ইসলামী প্রয়োজনীয়তা পরিপূরণে যথেষ্ট নয়। ইসলামী মতে তৌহিদকে পরিপূর্ণতা দেয়ার জন্য তৌহিদ আর-রবুবিয়াহ এবং আল্-আছমা ওয়াছ-ছিফাত অবশ্যই এদের পরিপূরক তৌহিদ আল্-ইবাদাহ্-র সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই বিষয়টি যে ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত তা’হল আল্লাহ নিজেই পরিস্কার ভাষায় উলেখ করেছেন যে রাসুলের সময়কার মুশরিকণ (পৌত্তলিকণ) তৌহিদের প্রথম দুই শ্রেণীর বহু বিষয় সত্য বলে স্বীকার করেছিল। কোরআনে আল্লাহ রাসুল (সঃ)-কে পৌত্তলিকদের বলতে বলেছেন,
“বল কে তোমাদিগকে আকাশ ও পৃথিবী হইতে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কাহার কর্তৃত্বাধীন, কে জীবিতকে মৃত হইতে নির্গত করে এবং কে মৃতকে জীবিত হইতে নির্গত করে এবং কে সকল বিষয় নিয়ন্ত্রিত করে? তখন তাহারা বলিবে, আল্লাহ”। (সুরা ইউনুছ ১০: ৩১)
“যদি তুমি উহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর,কে উহাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছে, উহারা অবশ্যই বলিবে, ‘আল্লাহ’।” (সুরা আয-যুখরুফ ৪৩ঃ ৮৭)
“যদি তুমি উহাদিগকে জিজ্ঞাসা কর, ভুমি মৃত হইবার পর আকাশ হইতে বারি বর্ষণ করিয়া কে উহাকে সঞ্জীবিত করে? উহারা অবশ্যই বলিবে, ‘আল্লাহ’।” (সুরা আল-আনকাবুত ২৯: ৬৩)
মক্কার পৌত্তলিকরা সবাই জানতো যে আল্লাহ হ’ল তাদের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, তাদের প্রভু এবং মালিক তবুও আল্লাহর কাছে ঐ জ্ঞান তাদের মুসলিম বানাতে পারেনি। আল্লাহ বলেছেনঃ “তাহাদিগের অধিকাংশ আল্লাহ বিশ্বাস করে কিন্তু তাঁহাকে শরীক করিয়া।” (সুরা ইউসুফ ১২: ১০৬)
এই আয়াতের উপর, মুজাহিদের ভাষ্য হলঃ আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের প্রতিপালন করেন এবং আমাদের জীবন নেন এই বক্তব্যের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ঘোষণা তাদেরকে আল্লাহর পাশাপাশি অন্যান্য দেব দেবতার উপাসনা হতে বিরত করেনি।
পূর্বে উল্লেখকৃত আয়াতে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, কাফেররা আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, রাজত্ব ও ক্ষমতা সম্বন্ধে জ্ঞাত ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভীষণ প্রয়োজন এবং দুর্যোগের সময় তারা বিশ্বস্ততার সঙ্গে হজ্জ, দান, পশু বলি, মানত এমনকি উপাসনাও করত। এমনকি তারা ইব্রাহিমের ধর্ম অনুসরণ করছে বলেও দাবি করত। ঐ ধরণের দাবীর কারণে আল্লাহ এই আয়াত নাযিল করলেনঃ

“ইব্রাহিম ইয়াহুদীও ছিল না, খৃস্টানও ছিল না,সে ছিল একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী এবং সে মুশরিকদের অস্তুর্ভুক্ত ছিল না।” (সুরা আল-ইমরান ৩ঃ৬৭)
কিছু পৌত্তলিক মক্কাবাসী এমনকি পুনরুত্থান, শেষ বিচার এবং পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্য (কদর) বিশ্বাস করত। প্রাক-ইসলামী কবিতায় তাদের এই বিশ্বাসের প্রচুর সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, কবি যুহাইর বলেছিলেনঃ
“হয় ইহা স্থগিত করা হয়েছিল, একটি পুস্তকে রক্ষিত হইয়াছিল এবং শেষ বিচার দিনের জন্য রক্ষা করা হয়েছিল নতুবা ত্বরাম্বিত করা হয়েছিল এবং প্রতিশোধ লওয়া হইয়াছিল।”
আন্তারা বলেছেন বলে উদ্ধৃত আছেঃ
“ওহে এবিল মৃত্যু হইতে তুমি কোথায় পালাইয়া যাইবে, যদি আসমানস্থিত আমার স্রষ্টা তোমার ভাগ্যে তা লিখিয়া থাকে?”

মক্কাবাসীরে তৌহিদ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি এবং আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান থাকা সত্বেও একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের পাশাপাশি তারা অন্যান্য দেবদেবীর উপাসনা করার কারণে আল্লাহ তাদেরকে নাস্তিক (কাফের) এবং পৌত্তলিক (মুশরিক) হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।
ফলে তৌহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হ’ল তৌহিদ আল-ইবাদাহ অর্থাৎ আল্লাহর ইবাদতে এককত্ব বজায় রাখা। যেহেতু একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত প্রাপ্য এবং মানুষের ইবাদতের ফল হিসাবে একমাত্র তিনিই মঙ্গল মঞ্জুরী করতে পারেন,সেজন্য সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহকে উদ্দেশ্য করেই করতে হবে। অধিকস্তু, মানুষ এবং স্রষ্টার মধ্যে যে কোন ধরণের মধ্যস্থতাকারী অথবা যোগাযোগকারীর প্রয়োজন নেই। আল্লাহ একমাত্র তাঁকে উদ্দেশ্য করেই ইবাদতের গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এটাই সকল পয়গম্বর কর্তৃক প্রচারিত বার্তার সারমর্ম। আল্লাহ বলেছেন-
“আমি সৃষ্টি করিয়াছি জিন এবং মানুষকে এই জন্য যে,তাহারা আমারই ইবাদত করিবে।” (সুরা আয-যারিয়াত ৫১: ৫৬)
“আল্লাহর ইবাদত করিবার ও তাগুতকে (মিথ্যা দেবদেবীকে) বর্জন করিবার নির্দেশ দিবার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসুল পাঠাইয়াছি।” (সুরা আন-নাহল ১৬: ৩৬)
সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পুর্ণভাবে উপলদ্ধি করা মানুষের সহজাত ক্ষমতার উর্দ্ধে। মানুষ একটি সসীম সৃষ্টিকর্ম এবং তার নিকট হতে অসীম স্রষ্টার ক্রিয়াকান্ড সম্পুর্ণ যুক্তিসঙ্গতভাবে উপলদ্ধি আশা করা যায় না। এই কারণে স্রষ্টা তাঁকে ইবাদত করা মানুষের স্বভাবের একটি অংশ হিসাবে তৈরি করেছেন। সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরিস্কার করে বুঝানোর জন্য তিনি পয়গম্বারদের এবং মানসিক ক্ষমতার বোধগম্য কিতাবসমূহ প্রেরণ করেছিলেন। স্রষ্টার ইবাদত (ইবাদাহ) করা উদ্দেশ্য এবং পয়গম্বারদের প্রার্থনা বার্তা ছিল একমাত্র সৃষ্টাকে ইবাদত করা, তৌহিদ আল ইবাদাহ। এর কারণে আল্লাহ ছাড়া অথবা আল্লাহ সহ অন্যকে ইবাদত করা কঠিন গুনাহ, র্শিক। যে সূরা আল ফাতিহা, মুসলিম নরনারীদের নামাজে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে সতেরবার পড়তে হয় সেই সূরার চতুর্থ আয়াত উল্লেখ করে ‘‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং একমাত্র তোমার কাছেই আমবা সাহায্য চাই।’’ এই বিবৃতি থেকে পরিস্কার হয়ে যায়, সকল প্রকার ইবাদত আল্লাহকে উদ্ধেশ্য করে করতে হবে যিনি সাড়া দিতে পারেন।
রাসূল (সাঃ) এককত্বের দর্শন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বলেছেনঃ তুমি যদি ইবাদতে কিছু চাও তাহলে শুধু আল্লাহর নিকট চাও এবং তুমি যদি সাহায্য চাও তাহলে শুধু আল্লাহর নিকট চাও’’ প্রয়োজনীয় এবং আল্লাহর নিকটবর্তীতা আরও দৃঢ়ভাবে প্রকাশ পায়
কোরআনের বহু আয়াতে। উদাহরনস্বরূপঃ

“আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে আপনাকে প্রশ্ন করে, আমি তো নিকটেই। আহবানকারী যখন আমাকে আহ্ন করে আমি তার আহবানে সাড়া দেই। সুতরাং তাহারও আমার ডাকে সাড়া দিক এবং আমাতে বিশ্বাস স্থাপন করক যাহাতে তাহারা ঠিক পথে চলিতে পারে।” (সূরা আল বাকারা ২: ১৮৬)
“আমিই মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি এবং তাহার প্রবৃত্তি তাহাকে কুমন্ত্রনা দেয় তাহা আমি জানি। আমি তাহার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষা ও নিকটতম। ” (সূরা কাফ ৫০: ১৬)
তৌহিদ আল ইবাদাহ এর স্বীকৃতি,বিপরীত ভাবে সকল প্রকার মধ্যস্থতাকারী অথবা আল্লাহর সঙ্গে অংশীদারের সম্পৃক্ততার অস্বীকৃতি অপরিহার্য করে তোলে। যদি কেউ জীবিত ব্যক্তিদের জীবনের উপর অথবা যারা মারা গিয়েছে তাদের আত্মার উপর প্রভাব বিস্তারের জন্য মৃত্যের কাছে প্রার্থনা করে, তারা আল্লাহর সঙ্গে একজন অংশীদার যুক্ত করে। এই ধরণের প্রার্থনা আল্লাহর পাশাপাশি অন্যের উপাসনা করার মত। রাসূল (সঃ) সুস্পষ্টভাবে বলেছেনঃ “প্রার্থনাই ইবাদত” যদি কেউ রাসূল (সাঃ) অথবা তথকথিত আউলিয়া,জিন অথবা ফেরেশতাগণের নিকট সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করে অথবা প্রার্থনাকারীর পক্ষ হয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে অনুরোধ করে তাহলে তারাও র্শিক করে। মূর্খ লোকেরা যখন আব্দুল কাদের জিলানীকে এবং আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ট এবং মহিমান্বিত বলেছেনঃ
“আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত কর না যাহা তোমাদিগের কোন উপকার করিতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে না।” (সূরা আল আম্বিয়া ২১: ৬৬)
“আল্লাহ ব্যতীত তোমরা যাহাদিগকে আহবান কর তাহারা তো তোমাদিগেরই মত বান্দা।”(সূরা আল আরাফ ৭: ১৯৪)
যদি কেউ রাসূল (সাঃ) অথবা তথকথিত আউলিয়া, জিন অথবা ফেরেশতাগণের নিকট সাহায্যের জন্য প্রার্থনা করে অথবা প্রার্থনাকারীর পক্ষ হয়ে তাদেরকে সাহায্য করতে অনুরোধ করে তাহলে তারাও র্শিক করে। মূর্খ লোকেরা যখন আব্দুল কাদের জিলানীকে গাওছি আজম উপাধীতে ভূষিত করে তখন তৌহিদের এই নিয়মে র্শিক করে। উপাধিটির আক্ষরিক অর্থ, মুক্তি প্রাপ্তির প্রধান উৎস; এমন একজন যিনি বিপদ হতে রক্ষা করার চেয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত অথচ এই ধরণের বর্ণনা শুধু মাত্র আল্লাহর জন্য প্রযোজ্য। দূর্ঘটনা ঘটলে কেউ কেউ আবদুল কাদিরেকে এই উপাধিতে ডেকে তাঁর সাহায্য এবং আত্মরক্ষা কামনা করে, যদিও আল্লাহ আগেই বলেছেনঃ
“আল্লাহ তোমাকে ক্লেশ দান করলে তিনি ব্যতীত উহা মোচনকারী আর কেহ নাই।” (সূরা আল-আন্আম ৬: ১৭)
কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, যখন মক্কাবাসিদের তাদের মূর্তিপূজার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হলে তারা উত্তর দিলঃ
“আমরা তাদের ইবাদত করি যাহাতে তাহারা আমাদিগকে আল্লাহর কাছাকাছি পৌছায়।” (সূরা আয্-যুমার ৩৯: ৩)
মূর্তিগুলিকে শুধুমাত্র মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ব্যবহার করলেও আল্লাহ তাদের আচার অনুষ্ঠানের কারণে তাদের পৌত্তলিক বলেছেন। মুসলিমদের মধ্যে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে ইবাদত করার প্রতি জোর দেয় তারা ভাল ভাবে এ বিষযে চিন্তা করে দেখতে পারেন।
তার্সাস নগরীর সলের (পরবর্তীকালে যাকে পল বলা হত) শিক্ষায় প্রভাবাম্বিত হয়ে খৃস্টানগণ পয়গম্বর যিশুখৃস্টের উপর দেবত্ব আরোপ করেছিল এবং তারা যিশুখৃষ্ট ও তাঁর মাতাকে উপাসনা করত। খৃস্টানদের মধ্যে ক্যাথোলিকদের প্রতিটি উপলক্ষের জন্য কিছু সাধু আছে। ক্যাথোলিকরা সাধুদের কাছে সেই বিশ্বাসের ভিত্তিতেই প্রার্থনা করে যে এই সব সাধুরা জাগতিক ঘটনাবলিতে সরাসরিভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। ক্যাথলিকরা তাদের পুরোহিতদের আল্লাহ এবং তাদের নিজেদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসাবেও ব্যবহার করে। তারা বিশ্বাস করে যে এইসব পুরোহিতদের কৌমার্য ও ধর্মানুরাগের কারণে আল্লাহ কর্তৃক তাদের কথা শুনার সম্ভবনা বেশী। মধ্যস্থতাকারী সম্বন্ধে বিকৃত বিশ্বাসের কারণে শিয়া সম্প্রাদায়ের বেশীর ভাগ লোক সপ্তাহের কয়েকটি দিন এবং দিনের কয়েক ঘন্টা আলী,ফাতেমা,হাসান এবং হোসেন- এর প্রতি প্রার্থনার জন্য নির্ধারিত রেখেছে।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ইবাদতে (ইবাদাহ্) শুধু রোজা রাখা, যাকাত প্রদান, হজ্জ এবং পশু কোরবানী করা ছাড়াও অনেক কিছু অন্তুর্ভূক্ত। এর মধ্যে ভালবাসা, বিশ্বাস এবং ভয়ের মত আবেগ অন্তর্ভুক্ত, যেগুলির বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে এবং যা শুধুমাত্র স্রষ্টার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতে হবে। আল্লাহ এই সব আবেগের বাড়াবাড়ি সম্বন্ধে সাবধান করে দিয়ে উলেখ করেছেনঃ


“তথাপি কেহ কেহ আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায় তাহাদিগকে
ভালবাসে; কিস্তু যাহারা ঈমান আনিয়াছে আল্লাহর প্রতি তাহাদের ভালবাসা দৃঢ়তম।” (সূরা আল-বাকারা ২ :১৬৫)
“তোমরা কি সেই সম্প্রদায়ের সহিত যুদ্ধ করিবে না, যাহারা নিজেদিগকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করিয়াছে ও রাসুলের বহিষ্করণের জন্য সংকল্প করিয়াছে? উহারাই প্রথম তোমাদিগের বিরুদ্ধাচারণ করিয়াছে। তোমরা কি তাহাদিগকে ভয় কর? মুমিন হইলে আল্লাহকে ভয় করাই তোমাদের পক্ষে সমীচীন।” (সুরা আত্-তাওবা ৯: ১৩)
“আর তোমরা মুমিন হইলে আল্লাহর উপরেই নির্ভর কর।” (সুরা আল্-মায়েদা, ৫: ২৩)
ইবাদত (ইবাদাহ্) শব্দের অর্থ সম্পুর্ণভাবে আত্মসমর্পণ এবং আল্লাহকে চুড়ান্ত আইন প্রণেতা হিসাবে গণ্য করা। কাজেই স্বর্গীয় আইনের (শারীয়াহ) উপর ভিত্তি না করে ধর্মনিরপেক্ষ আইন বিধান বাস্তবায়ন স্বর্গীয় আইনের প্রতি অবিশ্বাস এবং তার শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে। এই ধরনের বিশ্বাস আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের উপাসনা করার নামান্তর (শির্ক)। আল্লাহ কোরআনে উলেখ করেছেনঃ
“আল্লাহ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদানুসারে যাহারা বিধান দেয় না, তাহারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী (কাফিরুন)।”(সুরা আল-মায়েদা ৫: ৪৪)।
সাহাবী আদি ইবনে হাতিম, যিনি খৃস্টান ধর্ম হতে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন, রাসুল (সাঃ) কে কোরআনের আয়াত পড়তে শুনেন “তাহারা আল্লাহ ব্যতীত তাহাদিগের পন্ডিতগণকে ও সংসার-ত্যাগীগণকে তাহাদিগের প্রভু (আরবাব) রূপে গ্রহণ করিয়াছে।” (সুরা আত্-তওবা ৯:৩১)
তিনি রাসুল (সাঃ) কে বললেন,“নিশ্চয়ই আমরা তাদের উপসনা করি না।” রাসূল (সঃ) তার দিকে তাকিয়ে বললেন “আল্লাহ যা কিছু হালাল করেছেন তারা কি তা হারাম ঘোষনা করেনি এবং তোমরা সকলে তা হারাম করনি এবং আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা কি তারা হালাল করেনি এবং তোমরা সকলে তা হালাল করনি?” তিনি উত্তরে বললেন নিশ্চয়ই আমরা তা করেছি। রাসূল (সঃ) তখন উত্তর দিলেন, “ঐ ভাবেই তোমরা তাদের উপসনা করেছিলে।”(আত তিরমিজি কর্তৃক সংগৃহীত)
অতএব তাওহীদ আল ইবাদাহ এর একটি উলেখযোগ্য অংশ হল শরীয়াহ বাস্তবায়ন, বিশেষ করে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলিম। বহু তথাকথিত মুসলমান দেশ, যেখানে সরকার আমদানীকৃত গনতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত এবং যেখানে স্বর্গীয় আইন সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত অথবা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে ইসলামি আইন চালু করতে হবে। অনুরূপভাবে মুসলিম দেশ সমূহ যেখানে ইসলামি আইনকানুন চালু রয়েছে সেখানেও শরীয়াহ আইনকানুন প্রবর্তন করতে হবে কারণ জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই আইনকানুন সম্পর্কযুক্ত। মুসলিম দেশে শরীয়াহ আইনের পরিবর্তে অনৈসলামিক আইনকানুনের স্বীকৃতি হল র্শিক এবং এটা একটি কুফরী কাজ। যাদের ক্ষমতা আছে তাদের অবশ্যই এই অনৈসলামিক আইনকানুন পরিবর্তন করা উচিত। যাদের সে ক্ষমতা নেই তাদের অবশ্যই কুফর এর বিরুদ্ধে এবং শরীয়াহ আইন বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার হওয়া উচিত। যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে আল্লাহর সস্তুষ্টি ও তৌহিদ সমুন্নত রাখার জন্য অনৈসলামিক সরকারকে আন্তরিকভাবে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করতে হবে। জেনে রাখা প্রয়োজন যে আল্লাহ একক ইলাহ হিসেবে নিম্নের ইবাদতগুলি একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য। ইবাদতের প্রকার সমূহ যা আল্লাহ তাআ’লা নির্দেশিত করেছেন তা হচ্ছেঃ


(ক)(আল- ইসলাম)- আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সমর্পণ করা।
(খ)(আল-ঈমান)- বিশ্বাস স্থাপন করা।
(গ)(আল-ইহসান)-নিষ্ঠার সাথে কাজ করা। দয়া-দাক্ষিণ্য ও সহানুভূতি প্রদর্শন, উপকার সাধন করা।
(ঘ)(আদ-দো’য়া) প্রার্থনা, আহবান করা।
(ঙ)(আল-খাওফ) ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা ।
(চ)(আর-রাজা) আশা-আকাংখা করা ।
(ছ)(আত্-তাওয়াক্কুল) নির্ভরশীলতা, ভরসা করা ।
(জ)(আর-রাগ্বাহ) অনুরাগ, আগ্রহ।
(ঝ)(আর-রাহ্বাহ) ভয় ভীতি।
(ঞ)(আল-খূশূ) বিনয়-নম্রতা।
(ট) (আল-খাশিয়াত) অমংগলের আশংকা।
(ঠ) (আল- ইনাবাহ) আল্লাহর অভিমুখী হওয়া, তাঁর দিকে ফিরে আসা।
(ড)(আল-ইস্তে’আনাত) সাহায্য প্রার্থনা করা।
(ঢ) (আল-ইস্তে-আযা) আশ্রয় প্রার্থনা করা।
(ণ)(আল-ইস্তেগাসাহ) নিরুপায় ব্যাক্তির বিপদ উদ্ধারের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা।
(ত)(আয্-যাবাহ) আত্ব ত্যাগ বা কুরবানী করা।
(থ)(আন্-নযর) মান্নত করা।
এগুলি এবং অন্যান্য যে পদ্ধতি সমূহের আদেশ ও নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন সবকিছুই তাঁর সšত্তষ্টি বিধানের জন্যে। উপোরোল্লিখিত ইবাদতগুলির কোন একটি যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য নিবেদন করে তবে সে মুশরিকে পরিণত হবে।
আল কুরআনে ইলাহের পরিচয় –
কালেমা এর স্বীকৃতির মাধ্যমে আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ জন্য আমাদের ইলাহের পরিচয় জানা প্রয়োজন। আল কুরআনে সুষ্পষ্টভাবে হিসেবে আল্লাহর পরিচয় পাওয়া যায়।
সূরা বাক্বারা ২: ২৫৫ আয়াতটি আয়াতুল কুরসী নামে খ্যাত। সে আয়াতের প্রথমে বলা হয়েছে অর্থাৎ “আল্লাহ তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই” যিনি-


• “চিরঞ্জীব”, আল্লাহ ছাড়া আর এমন কেউই নেই যে চিরঞ্জীব কারণ প্রত্যেক প্রানীকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। অপরদিকে আল্লাহ “চির প্রতিষ্ঠিত” তিনি ছাড়া আর কেউই নেই যে চির প্রতিষ্ঠিত কারণ প্রত্যেক বস্তুই ধ্বংসশীল আর আল্লাহ হচ্ছেন অবিনশ্বর সত্ত্বা। যেহেতু আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ চিরঞ্জীব এবং চির প্রতিষ্ঠিত নয় সেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হবার যোগ্যতা রাখে না।
• অতঃপর বলা হয়েছে “তাঁকে তন্দ্রা এবং নিদ্রা স্পর্শ করে না”। আল্লাহর তো ঘুম আসেই না এমনকি ঘুমের যে ঝিমুনি ভাব সেটাও আসে না, তিনি এসব দূর্বলতা থেকে মুক্ত। কারণ যিনি ইলাহ তিনি যদি এসব দূর্বলতা থেকে মুক্ত না হতেন তবে তো আসমান-যমীন সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যেত। অথচ সৃষ্টির যত প্রানী আছে তারা কেউই এসব দূর্বলতা থেকে মুক্ত নয়, এজন্যই আল্লাহই একমাত্র যোগ্য ইলাহ।
• “আকাশ এবং পৃথিবীর সবকিছুই তাঁর”। এই আসমান-যমীন এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে সবকিছুর একচ্ছত্র মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ ছাড়া কেউই এ মালিকানা দাবী করতে পারে না, দাবী করার কোন অধিকারও নেই। এ কারণে তিনিই একমাত্র ইলাহ।
• “কে আছে এমন যে তাঁর নিকট সুপারিশ করবে তাঁর অনুমতি ব্যতীত”। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা এমন শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী যে তাঁর সামনে কেউ সুপারিশ করার অধিকার রাখে না, তিনি যাকে অনুমতি দেন সে ব্যতীত। এমনকি কোন নবীও আল্লাহর সামনে মুখ খোলার বা সুপারিশ করার অধিকার রাখেন না যতক্ষন না আল্লাহ তাদের অনুমতি দেবেন। আল্লাহ ছাড়া এমন মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব আর কারো নেই,এ জন্যই আল্লাহই একমাত্র ইলাহ।
• অতঃপর বলা হয়েছে “তাদের সম্মুখে এবং পশ্চাতে যা কিছু আছে তা তিনি জানেন।” আল্লাহই একমাত্র সত্ত্বা যিনি মানুষের অগ্র-পশ্চাত সবকিছুই জানেন, তিনি ছাড়া আর কেউ তা জানে না। এ জন্যই আল্লাহ ব্যতীত কেউ ইলাহ হবার যোগ্য নয়।
• “যা তিনি ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত তাঁর জ্ঞান ভান্ডার থেকে কিছুই তারা আয়ত্ব করতে পারে না।” আল্লাহ হচ্ছেন পরিপূর্ণ জ্ঞানী, তিনি সৃষ্টি জীবকে দয়া করে যতটুকু জ্ঞান দিয়েছেন সেটুকু জ্ঞানই সৃষ্টির আছে। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে যতকিছু আছে সবাই হচ্ছে অপূর্ণাঙ্গ জ্ঞানী, আবার এ সামান্য জ্ঞানটুকুও আল্লাহর দেয়া। সুতরাং আল্লাহ পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী বলেই তিনি আমাদের একমাত্র ইলাহ,তিনি ছাড়া আর কেউ ইলাহ হতে পারে না।
• “তাঁর কুরসী আকাশ এবং পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত”। আল্লাহর ‘কুরসী’ আকাশ এবং পৃথিবীকে পরিবেষ্টন করে আছে।
• “এদের (আকাশ এবং পৃথিবীর) রক্ষনা-বেক্ষনে তাঁকে ক্লান্ত করে না।” আল্লাহই একমাত্র সত্ত্বা যিনি আসমান-যমীন এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে সবকিছুর রক্ষণাবেক্ষণ করছেন অন্যথায় সবকিছু মূহুর্তের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যেত। আর এসব কিছুর রক্ষণাবেক্ষণে আল্লাহকে বিন্দু মাত্র ক্লান্ত করে না। তিনি যাবতীয় দূর্বলতা-অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত এবং পবিত্র। এ জন্যই আল্লাহই একমাত্র ইলাহ।
সবশেষে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেছেন- “আর তিনি মহান,শ্রেষ্ঠ।” উপরে উল্লেখিত গুনাবলীগুলোর অধিকারী একমাত্র আল্লাহ। তিনি ব্যতীত আর কেউই এরূপ শ্রেষ্ঠত্ব এবং কর্তৃত্বের অধিকারী নেই। এ কারণে আল্লাহই আমাদের একমাত্র ইলাহ তনি ব্যতীত আর কেউ ইলাহ নেই,হওয়ার যোগ্য নয়,হতে পারে না।
আল্ কুরআনে অপর এক আয়াতে ইলাহ হিসেবে আল্লাহর পরিচয় পাওয়া যায়ঃ
“তিনিই আল্লাহ তা’আলা, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই; তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যকে জানেন তিনি পরম দয়ালু, অসীম দাতা।তিনিই আল্লাহ তিনি ব্যতিত কোন উপাস্য নেই। তিনিই একমাত্র মালিক, পবিত্র, শান্তি ও নিরাপত্তাদাতা, আশ্রয়দাতা, পরাক্রান্ত, প্রতাপান্বিত, মাহাত্নশীল। তারা যাকে অংশীদার করে আল্লাহ তা’ আলা তা থেকে পবিত্র।তিনিই আল্লাহ তা’আলা, স্রষ্টা, উদ্ভাবক, রূপদাতা, উত্তম নাম সমূহ তাঁরই। নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।[৫৯ঃ২২-২৪]”
আল্লাহই একমাত্র ইলাহ আল-কুরআনে এ ব্যাপারে চ্যালেঞ্জ-

১ম চ্যালেঞ্জঃ “বল তো কে সৃষ্টি করেছেন নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বর্ষণ করেছেন পানি; অতঃপর তা দ্বারা আমি মনোরম বাগান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষাদি উৎপন্ন করার শক্তিই তোমাদের নেই। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তারা সত্যবিচ্যুত সম্প্রদায়।” (সূরা, নামল ২৭: ৬০)
২য় চ্যালেঞ্জঃ
“বল তো কে পৃথিবীকে বাসোপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থিত রাখার জন্যে পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন। অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।” (সূরা, নামল ২৭: ৬১)
৩য় চ্যালেঞ্জঃ
“বল তো কে নিঃসহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে পুর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তোমরা অতি সামান্যই ধ্যান কর। ”(সূরা, নামল ২৭:৬২)
৪র্থ চ্যালেঞ্জঃ
“বল তো কে তোমাদেরকে জলে ও স্থলে অন্ধকারে পথ দেখান এবং যিনি তাঁর অনুগ্রহের পূর্বে সুসংবাদবাহী বাতাস প্রেরণ করেন? অতএব, আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ তা থেকে অনেক ঊর্ধ্বে।” (সূরা নামল ২৭:৬৩)
৫ম চ্যালেঞ্জঃ
“বল তো কে প্রথমবার সৃষ্টি করেন, অতঃপর তাকে পুনরায় সৃষ্টি করবেন এবং কে তোমাদেরকে আকাশ ও মর্ত্য থেকে রিযিক দান করেন। সুতরাং আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্য আছে কি? বলুন, তোমরা যদি সত্যবাদী হও তবে তোমাদের প্রমাণ উপস্থিত কর।” (সূরা নামল ২৭:৬৪)
৬ষ্ঠ চ্যালেঞ্জঃ
“তিনিই আল্লাহ তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ইহকাল ও পরকালে তাঁরই প্রশংসা। বিধান তাঁরই ক্ষমতাধীন এবং তোমরা তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে।বলুন, ভেবে দেখ তো, আল্লাহ যদি রাত্রিকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে, যে তোমাদেরকে আলোক দান করতে পারে? তোমরা কি তবুও কর্ণপাত করবে না ? বলুন, ভেবে দেখ তো, আল্লাহ যদি দিনকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত স্থায়ী করেন, তবে আল্লাহ ব্যতীত এমন উপাস্য কে আছে যে, তোমাদেরকে রাত্রি দান করতে পারে, যাতে তোমরা বিশ্রাম করবে? তোমরা কি তবুও ভেবে দেখবে না ?” (সূরা, কাসাস ২৮: ৭০-৭২)

“তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন এবং তিনি সুর্য ও চন্দ্রকে কাজে নিযুক্ত করেছেন প্রত্যেকেই বিচরণ করে নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত। জেনে রাখুন, তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে একই ব্যক্তি থেকে। অতঃপর তা থেকে তার যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তোমাদের জন্যে আট প্রকার চতুষ্পদ জন্তু অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে। তিনি আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা, সাম্রাজ্য তাঁরই। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব, তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হচ্ছ? ” (সূরা যূমার ৩৯:৫-৬)
ইলাহ বনাম ক্ষমতা –
যে ব্যক্তি কাউকে সাহায্যকারী, অভাব পূরণকারী, দোয়া শ্রবনকারী, ভাল-মন্দ সাধনকারী বলে মনে করে, তার এমনটি মনে করার কারণ এই যে তার মতে ঐ ব্যক্তি বিশ্ব-জাহান পরিচালনায় কোন না কোন ক্ষমতার অধিকারী। অনুরূপভাবে কেউ যদি কোন ব্যক্তিকে ভয় করে এবং মনে করে যে তার অসন্তুষ্টি আমার ক্ষতির কারণ এবং সন্তুষ্টি কল্যানের কারণ। তার এ বিশ্বাস ও কর্মের কারণ এছাড়া আর কিছু নয় যে, তার মনে সে ব্যক্তির সম্মন্ধে এক ধরনের শক্তির ধারণা রয়েছে। অপরদিকে কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীনকে স্বীকার করার সত্বেও এভাবে অন্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে,তার এহেন কর্মের কারণ শুধু এই যে, সে অন্যকে কোন না কোনভাবে আল্লাহর সাথে অংশীদার বনিয়ে নেয় বা এরূপ অংশীদারিত্বের ধারণা করে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কারো নির্দেশকে আইন এবং অবশ্য পালনীয় মনে করে, সে তাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী স্বীকার করে। সুতরাং উলুহিয়্যাতের অর্থাৎ ইলাহ হিসেবে আল্লাহর একত্বের প্রকৃত স্পিরিট হচ্ছে ক্ষমতা। প্রত্যেক বিষয়ে আল্লাহই একক এবং নিরংকুশ ক্ষমতার অধিকারী। সার্বভৌম কর্তৃত্বের অধিকারী তিনি একাই। আসমান-যমীনের সকল ক্ষমতা তাঁরই ইখতিয়ারে। সৃষ্টি করা, নিয়ামত দান করা, নির্দেশ দেয়া, শক্তি-সামর্থ সবকিছুই তাঁর হাতে নিহিত। সবকিছুই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর আনুগত্য করছে। তিনি ছাড়া কারো কোন ক্ষমতা নেই, নেই নির্দেশ দানের অধিকার, সৃজন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার রহস্য সম্পর্কেও কেউ অবগত নয়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, হবার যোগ্যতা রাখে না, হতে পারেনা। এ কারণেই আল-কুরআনে একক ইলাহ হিসেবে আল্লাহর নিরংকুশ ঘোষণাঃ


“আর তোমাদের উপাস্য একইমাত্র উপাস্য। তিনি ছাড়া মহা করুণাময় দয়ালু কেউ নেই।“(সূরা, বাক্বারা ২: ১৬৩)
“তিনিই উপাস্য নভোমন্ডলে এবং তিনিই উপাস্য ভুমন্ডলে। তিনি প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা, যুখরুফ ৪৩: ৮৪)
“যদি নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকত, তবে উভয়ের ধ্বংস হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ পবিত্র।” (সূরা, আম্বিয়া ২১: ২২)
“তিনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনিই সব কিছুর স্রষ্টা। অতএব, তোমরা তাঁরই এবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্তুর কার্যনির্বাহী।“(সূরা, আনআম ৬: ১০২)