কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ২৩
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর তারা অবশ্যই অবগত আছে, যে ব্যক্তি যাদু অবলম্বন করে তার জন্যে পরকালে সামান্যতমও কোন অংশ নেই’। (*১) (সূরা বাকারাহঃ১০২)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন, “তারা জিবত ও তাগুতের প্রতি বিশ্বাস করে”।(*২) (সূরা নিসাঃ৫১)
হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘জিবত’ হচ্ছে যাদু, আর ‘তাগুত’ হচ্ছে শয়তান। (ত্বাবারানী,৫৮৩৪)
হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তাগুত’ হচ্ছে গণক। তাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো। আর সাধারণত প্রত্যেক গোত্রের জন্যই একজন করে গণক নির্ধারিত ছিল।(*৩) (ইবনে আবী হাতিম, ২/২২; সহীহ বুখারী, ৮/৩১৭)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি?’ তিন জবাবে বললেন, ‘১ আল্লাহর সাথে শিরক করা ২যাদু করা ৩অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ তায়ালা হারাম করে দিয়েছেন ৪সুদ খাওয়া ৫এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা ৬যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা ৭ সতী সাধ্বী মু’মিন মহিলাকে অপবাদ দেয়া’।(*৪) (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৬৬,৫৭৬৪; সহীহ মুসলিম,হাদীস নং ৮৯)
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া(মৃত্যুদণ্ড)”।(*৫) (জামে’ তিরমিযী, হাদীস নং ১৪৬)
সহীহ বুখারিতে বাজালা বিন আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশ নামায় লিখেছিলেন, “তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা কর”। বাজালা বলেন, ‘এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকরকে হত্যা করেছি’। (*৬)(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৫৬, সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩০৪৩, মুসনাদ আহমাদ, ১/১৯০,১৯১)
হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে আছে, ‘তিনি তাঁর অধীনস্থ একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাঁকে যাদু করেছিল। অতঃপর উক্ত নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদীস নং৪৬; একই রকম হাদীস জুনদুব থেকে বর্ণিত রয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহি) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিনজন সাহাবী থেকে একথা সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে।) (*৭)
এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়,
১ সূরা বাকারাহর ১০২ নং আয়াতের তাফসীর
২ সূরা নিসার ৫১ নং আয়াতের তাফসীর
৩ ‘জিবত’ ও ‘তাগুত’ এর তাফসীর এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য
৪ ‘তাগুত’ কখনো জ্বিন আবার কখনো মানুষ হতে পারে
৫ ধ্বংসাত্মক এমন সাতটি বিশেষ বিষয়ের জ্ঞান যে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে
৬ যাদুকরকে কাফের ঘোষণা দিতে হবে
৭ তাওবার সুযোগ ছাড়াই যাদুকরকে হত্যা করতে হবে
৮ যদি ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালার যুগে যাদুবিদ্যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর পরবর্তী যুগের অবস্থা কি দাঁড়াবে [অর্থাৎ তাঁর পরবর্তী যুগে যাদুবিদ্যার প্রচলন অবশ্যই আছে]
ব্যাখ্যা– যাদু শিরকে আকবার তথা বড় শিরকের অন্যতম এবং তা তাওহীদের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যাদুর বাস্তবতা হচ্ছে তা কার্যকর এবং ক্রিয়াশীল করতে হলে শয়তানকে ব্যবহার এবং নৈকট্য লাভ করতেই হয়। আর শুধুমাত্র তার নৈকট্য লাভের মাধ্যমেই জিন-শয়তান যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরে যাদুর ক্রিয়া শুরু করে। শয়তানের নৈকট্য লাভ ছাড়া কোন যাদুকরের পক্ষেই যাদুকর হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমরা বলব যে, যাদু শিরক এর পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ পাক বলেন, ‘(বলুন যে আমি পরিত্রাণ কামনা করছি) গিরা তথা বন্ধনে অধিক ফুঁ দান কারিনীদের অনিষ্ট হতে’।نفاثات শব্দটি نفاثةএর বহুবচন। نفاثة /نفتথেকে মুবালাগা তথা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করার অর্থ বহন করে এবং তা দ্বারা নিসন্দেহে যাদুকারিনী বুঝানো হয়েছে এবং সরাসরি যাদুকারিনী না বলে অতিমাত্রায় ফুঁ দানকারিনী বলা হয়েছে । কেননা তারা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করত এবং ঝাড় ফুঁক ও বিভিন্ন রকমের তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা ফুঁ দিত এবং সে ফুঁ এর মাধ্যমে জ্বিন সেই গিরা বন্ধনে কাজ করত যাতে যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরের কিছু একটা থাকত অথবা এমন কিছু থাকত যার সাথে যাদুকৃত ব্যক্তির সম্পর্ক রয়েছে । এভাবে যাদু ক্রিয়াশীল হয়ে যেত।
(*১)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আর তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে যে, যে ব্যক্তি যাদু ক্রয়(অবলম্বন) করল’ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে যাদুকর ব্যক্তি যাদু ক্রিয়া করল এবং বিনিময়ে তাওহীদ প্রদান করল, ফলে মূল্য হচ্ছে তাওহীদ আর পণ্য হচ্ছে যাদু’ । যাদুকর ব্যক্তির পরকালে কোন অংশ থাকবে না , ঠিক এইরুপ অবস্থা মুশরিকদেরও হবে। পরকালে তাদের ভাগ্যেও কিছুই জুটবে না।
(*২)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তারা জিবত ও তাগুতে বিশ্বাস করে’। উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলেন, জিবত হচ্ছে যাদু। উল্লেখিত আয়াতে আহলে কিতাবদের দোষারোপ ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। কেননা তারা যাদুতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর এটা সাধারণত ইহুদীদের ক্ষেত্রে অধিক দেখা যায়। এ কথা সুস্পষ্ট বলা যায় যে, যাদুবিদ্যা চর্চা ও তা অবলম্বনের কারণে আল্লাহ তাদের দুর্নাম করেছেন ও তাদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন এবং তাদের প্রতি ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, সুনিশ্চিত এটা হারাম ও কবীরা গুনাহ। আর যদি তাতে শিরকী কথা থাকে তবে অবশ্যই সেটা শিরক বলেই গণ্য হবে। এভাবেই তার সমস্ত প্রকারের এক নির্দেশ।
তাগুত হচ্ছে শয়তান এবং জিবত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ হলেও ইহুদী সম্প্রদায়ের নিকট তা যাদু অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তারা যাদু ও শয়তানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য প্রকাশ করে হক থেকে দূরে সরে গেছে।
(*৩) জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর অভিমত, ‘তাগুত’ দ্বারা গণককে বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ের আলোচনা সামনে করা হবে।
(*৪) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক’। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ! ঐ জিনিসগুলো কি কি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদু করা ‘ ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পাপগুলির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জগতেই ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নিসন্দেহে এগুলো মহাপাপ। সুতরাং যাদু শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
(*৫) জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে যে, যাদুকরের হদ তথা শাস্তি হচ্ছে তরবারি দ্বারা হত্যা করা(মৃত্যুদণ্ড)। (তিরমিযী) ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, সঠিক অর্থে হাদীসটি মওকুফ। শাস্তির ব্যাপারে মূলত যাদুকরগণের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখা হয়নি। যে কোন প্রকার যাদু হোক না কেন যাদুকরকে হত্যা করতে হবে এবং বাস্তবতা হচ্ছে যাদুকরের শাস্তি এবং মুরতাদের শাস্তি একই কেননা যাদুতে শিরক থাকেই। ফলে যে ব্যক্তি শিরক করল সে মুরতাদ হয়ে গেল এবং তার জানমাল বৈধ হয়ে গেল (হত্যাযোগ্য হয়ে গেল)।
(*৬) বাজালা বিন আবদুল্লাহ থেকে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফরমানজারী করেছিলেন যে, ‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যা কর, তিনি বলেন, ফলে আমরা তিনজন যাদুকারিনীকে হত্যা করেছিলাম’। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই।
(*৭) হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার অধীনস্ত একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাকে যাদু করেছিল, অতঃপর উক্ত দাসীকে হত্যা করা হয়েছিল। একই রকম হাদীস জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, তিনজন সাহাবী থেকে যাদুকরকে হত্যার ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যাদুকরকে হত্যার ফতোয়া ও আদেশ প্রদান করেছেন, এ মর্মে সেখানে কোন রকম পার্থক্য করেননি এবং এটাই ওয়াজিব যে, যেন কোন প্রকার পার্থক্য করা না হয়। প্রত্যেক মুসলমানদের প্রতি ওয়াজিব যে, তারা যাদুর সকল প্রকার থেকে সাবধান থাকবে এবং এই বিধান অর্থাৎ সাবধান থাকার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং এই গর্হিত কাজের বিরোধিতা করবে যেমন ইমামগণ বলেছেন যে, যখনই কোন যাদুকর কোন নগরীতে প্রবেশ করবে তখনই সেখানে অশান্তি, অত্যাচার সীমালংঘন এবং সন্ত্রাস বিরাজ করবে।
—————————————————————————–
উৎসঃ কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ২৩
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
ব্যাখ্যাকারঃ শায়খ সালেহ বিন আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়েখ
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আবদুর বর আফফান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আর তারা অবশ্যই অবগত আছে, যে ব্যক্তি যাদু অবলম্বন করে তার জন্যে পরকালে সামান্যতমও কোন অংশ নেই’। (*১) (সূরা বাকারাহঃ১০২)
আল্লাহ তায়ালা আরো এরশাদ করেছেন, “তারা জিবত ও তাগুতের প্রতি বিশ্বাস করে”।(*২) (সূরা নিসাঃ৫১)
হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘জিবত’ হচ্ছে যাদু, আর ‘তাগুত’ হচ্ছে শয়তান। (ত্বাবারানী,৫৮৩৪)
হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, ‘তাগুত’ হচ্ছে গণক। তাদের উপর শয়তান অবতীর্ণ হতো। আর সাধারণত প্রত্যেক গোত্রের জন্যই একজন করে গণক নির্ধারিত ছিল।(*৩) (ইবনে আবী হাতিম, ২/২২; সহীহ বুখারী, ৮/৩১৭)
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাকো’। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ঐ ধ্বংসাত্মক জিনিসগুলো কি?’ তিন জবাবে বললেন, ‘১ আল্লাহর সাথে শিরক করা ২যাদু করা ৩অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা যা আল্লাহ তায়ালা হারাম করে দিয়েছেন ৪সুদ খাওয়া ৫এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা ৬যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা ৭ সতী সাধ্বী মু’মিন মহিলাকে অপবাদ দেয়া’।(*৪) (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৭৬৬,৫৭৬৪; সহীহ মুসলিম,হাদীস নং ৮৯)
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে ‘মারফু’ হাদীসে বর্ণিত আছে, “যাদুকরের শাস্তি হচ্ছে তলোয়ারের আঘাতে তার গর্দান উড়িয়ে দেয়া(মৃত্যুদণ্ড)”।(*৫) (জামে’ তিরমিযী, হাদীস নং ১৪৬)
সহীহ বুখারিতে বাজালা বিন আবাদাহ থেকে বর্ণিত আছে, ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিম গভর্ণরদের কাছে পাঠানো নির্দেশ নামায় লিখেছিলেন, “তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা কর”। বাজালা বলেন, ‘এ নির্দেশের পর আমরা তিনজন যাদুকরকে হত্যা করেছি’। (*৬)(সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১৫৬, সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং ৩০৪৩, মুসনাদ আহমাদ, ১/১৯০,১৯১)
হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে আছে, ‘তিনি তাঁর অধীনস্থ একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাঁকে যাদু করেছিল। অতঃপর উক্ত নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।’ (মুওয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদীস নং৪৬; একই রকম হাদীস জুনদুব থেকে বর্ণিত রয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহি) বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তিনজন সাহাবী থেকে একথা সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে।) (*৭)
এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়,
১ সূরা বাকারাহর ১০২ নং আয়াতের তাফসীর
২ সূরা নিসার ৫১ নং আয়াতের তাফসীর
৩ ‘জিবত’ ও ‘তাগুত’ এর তাফসীর এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য
৪ ‘তাগুত’ কখনো জ্বিন আবার কখনো মানুষ হতে পারে
৫ ধ্বংসাত্মক এমন সাতটি বিশেষ বিষয়ের জ্ঞান যে ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে
৬ যাদুকরকে কাফের ঘোষণা দিতে হবে
৭ তাওবার সুযোগ ছাড়াই যাদুকরকে হত্যা করতে হবে
৮ যদি ওমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালার যুগে যাদুবিদ্যার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে তাঁর পরবর্তী যুগের অবস্থা কি দাঁড়াবে [অর্থাৎ তাঁর পরবর্তী যুগে যাদুবিদ্যার প্রচলন অবশ্যই আছে]
ব্যাখ্যা– যাদু শিরকে আকবার তথা বড় শিরকের অন্যতম এবং তা তাওহীদের মূলনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। যাদুর বাস্তবতা হচ্ছে তা কার্যকর এবং ক্রিয়াশীল করতে হলে শয়তানকে ব্যবহার এবং নৈকট্য লাভ করতেই হয়। আর শুধুমাত্র তার নৈকট্য লাভের মাধ্যমেই জিন-শয়তান যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরে যাদুর ক্রিয়া শুরু করে। শয়তানের নৈকট্য লাভ ছাড়া কোন যাদুকরের পক্ষেই যাদুকর হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কারণেই আমরা বলব যে, যাদু শিরক এর পর্যায়ভুক্ত। আল্লাহ পাক বলেন, ‘(বলুন যে আমি পরিত্রাণ কামনা করছি) গিরা তথা বন্ধনে অধিক ফুঁ দান কারিনীদের অনিষ্ট হতে’।نفاثات শব্দটি نفاثةএর বহুবচন। نفاثة /نفتথেকে মুবালাগা তথা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করার অর্থ বহন করে এবং তা দ্বারা নিসন্দেহে যাদুকারিনী বুঝানো হয়েছে এবং সরাসরি যাদুকারিনী না বলে অতিমাত্রায় ফুঁ দানকারিনী বলা হয়েছে । কেননা তারা অতিমাত্রায় ফুঁ দান করত এবং ঝাড় ফুঁক ও বিভিন্ন রকমের তন্ত্র মন্ত্র দ্বারা ফুঁ দিত এবং সে ফুঁ এর মাধ্যমে জ্বিন সেই গিরা বন্ধনে কাজ করত যাতে যাদুকৃত ব্যক্তির শরীরের কিছু একটা থাকত অথবা এমন কিছু থাকত যার সাথে যাদুকৃত ব্যক্তির সম্পর্ক রয়েছে । এভাবে যাদু ক্রিয়াশীল হয়ে যেত।
(*১)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আর তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে যে, যে ব্যক্তি যাদু ক্রয়(অবলম্বন) করল’ এর সঠিক অর্থ হচ্ছে যাদুকর ব্যক্তি যাদু ক্রিয়া করল এবং বিনিময়ে তাওহীদ প্রদান করল, ফলে মূল্য হচ্ছে তাওহীদ আর পণ্য হচ্ছে যাদু’ । যাদুকর ব্যক্তির পরকালে কোন অংশ থাকবে না , ঠিক এইরুপ অবস্থা মুশরিকদেরও হবে। পরকালে তাদের ভাগ্যেও কিছুই জুটবে না।
(*২)আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘তারা জিবত ও তাগুতে বিশ্বাস করে’। উমর রাদিয়াল্লাহু তায়ালা বলেন, জিবত হচ্ছে যাদু। উল্লেখিত আয়াতে আহলে কিতাবদের দোষারোপ ও ভর্ৎসনা করা হয়েছে। কেননা তারা যাদুতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আর এটা সাধারণত ইহুদীদের ক্ষেত্রে অধিক দেখা যায়। এ কথা সুস্পষ্ট বলা যায় যে, যাদুবিদ্যা চর্চা ও তা অবলম্বনের কারণে আল্লাহ তাদের দুর্নাম করেছেন ও তাদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করেছেন এবং তাদের প্রতি ভীষণ ক্রোধ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এ থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, সুনিশ্চিত এটা হারাম ও কবীরা গুনাহ। আর যদি তাতে শিরকী কথা থাকে তবে অবশ্যই সেটা শিরক বলেই গণ্য হবে। এভাবেই তার সমস্ত প্রকারের এক নির্দেশ।
তাগুত হচ্ছে শয়তান এবং জিবত ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ হলেও ইহুদী সম্প্রদায়ের নিকট তা যাদু অর্থেই ব্যবহৃত হয়। তারা যাদু ও শয়তানের উপর বিশ্বাস স্থাপন ও আনুগত্য প্রকাশ করে হক থেকে দূরে সরে গেছে।
(*৩) জাবির বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর অভিমত, ‘তাগুত’ দ্বারা গণককে বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ের আলোচনা সামনে করা হবে।
(*৪) আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক’। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ ! ঐ জিনিসগুলো কি কি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শিরক করা, যাদু করা ‘ ইত্যাদি। উপর্যুক্ত পাপগুলির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা দুনিয়া ও আখিরাতে উভয় জগতেই ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নিসন্দেহে এগুলো মহাপাপ। সুতরাং যাদু শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
(*৫) জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত আছে যে, যাদুকরের হদ তথা শাস্তি হচ্ছে তরবারি দ্বারা হত্যা করা(মৃত্যুদণ্ড)। (তিরমিযী) ইমাম তিরমিযী (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, সঠিক অর্থে হাদীসটি মওকুফ। শাস্তির ব্যাপারে মূলত যাদুকরগণের মধ্যে কোন পার্থক্য রাখা হয়নি। যে কোন প্রকার যাদু হোক না কেন যাদুকরকে হত্যা করতে হবে এবং বাস্তবতা হচ্ছে যাদুকরের শাস্তি এবং মুরতাদের শাস্তি একই কেননা যাদুতে শিরক থাকেই। ফলে যে ব্যক্তি শিরক করল সে মুরতাদ হয়ে গেল এবং তার জানমাল বৈধ হয়ে গেল (হত্যাযোগ্য হয়ে গেল)।
(*৬) বাজালা বিন আবদুল্লাহ থেকে সহীহ বুখারীতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু ফরমানজারী করেছিলেন যে, ‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যা কর, তিনি বলেন, ফলে আমরা তিনজন যাদুকারিনীকে হত্যা করেছিলাম’। এখান থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যাদুকর এবং যাদুকারিনীকে হত্যার ব্যাপারে কোন মতপার্থক্য নেই।
(*৭) হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, তিনি তার অধীনস্ত একজন ক্রীতদাসীকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে দাসী তাকে যাদু করেছিল, অতঃপর উক্ত দাসীকে হত্যা করা হয়েছিল। একই রকম হাদীস জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) বলেন, তিনজন সাহাবী থেকে যাদুকরকে হত্যার ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম যাদুকরকে হত্যার ফতোয়া ও আদেশ প্রদান করেছেন, এ মর্মে সেখানে কোন রকম পার্থক্য করেননি এবং এটাই ওয়াজিব যে, যেন কোন প্রকার পার্থক্য করা না হয়। প্রত্যেক মুসলমানদের প্রতি ওয়াজিব যে, তারা যাদুর সকল প্রকার থেকে সাবধান থাকবে এবং এই বিধান অর্থাৎ সাবধান থাকার কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে এবং এই গর্হিত কাজের বিরোধিতা করবে যেমন ইমামগণ বলেছেন যে, যখনই কোন যাদুকর কোন নগরীতে প্রবেশ করবে তখনই সেখানে অশান্তি, অত্যাচার সীমালংঘন এবং সন্ত্রাস বিরাজ করবে।
—————————————————————————–
উৎসঃ কিতাবুত তাওহীদ ও এর ব্যাখ্যা – অধ্যায় ২৩
মুহাম্মদ বিন সুলায়মান আত-তামীমী(রাহিমাহুমুল্লাহ)
ব্যাখ্যাকারঃ শায়খ সালেহ বিন আব্দুল আযীয বিন মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়েখ
ভাষান্তরঃ মুহাম্মদ আবদুর বর আফফান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন