শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা – ১


আল্লাহ তাআলা বলেন:
আর যেন তোমাদের মধ্য থেকে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৪)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. মুসলিমদের মধ্যে কল্যাণকর ও ভাল কাজের দিকে আহবান, সৎ কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করার জন্য একটি দল গঠন করার অপরিহার্যতা প্রমাণিত হল।
দুই. যারা এ  দায়িত্ব পালন করবে তারাই সফলকাম হবে।
তিন. এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় প্রথমে ভাল কাজের দিকে দাওয়াত দিতে হবে। তারপর সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করতে হবে। দাওয়াত দানের মাধ্যমে জানাতে হবে কোনটি ভাল কাজ আর কোনটি মন্দ।
আরও ইরশাদ হচ্ছে:
তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি। মানুষের কল্যাণের জন্য যাদের বের করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে আর মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. পৃথিবিতে যত জাতি আছে তার মধ্যে মুসলিম উম্মাহ হল সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি।
দুই. সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি বলে তাদের দায়িত্ব হল সমগ্র মানবতাকে ভাল কাজ ও কল্যাণের দিকে আহবান করা, অন্যায় ও মন্দ কাজ-কথা-বিশ্বাস থেকে তাদের নিষেধ করা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
তুমি ক্ষমা প্রদর্শন করো ও সৎ কাজের আদেশ দাও। (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৯৯)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. ইসলামে ক্ষমা করার গুরুত্ব প্রমাণিত হল। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে ক্ষমার নীতি গ্রহণ করার আদেশ করেছেন। এমনিভাবে সকলকে তিনি ক্ষমা করার জন্য আল কুরআনের একাধিক স্থানে আদেশ করেছেন।
দুই. ভাল কাজের দিকে আহবান, সৎ কাজের আদেশ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীরা একে অপরের বন্ধু। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয় আর মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। (সূরা আত তাওবা, আয়াত: ৭১)
আয়াতের শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. ঈমানদার নারী ও পুরুষেরা একে অপরের বন্ধু ও কল্যাণকামী।
দুই. সৎ কাজের আদেশ করা ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করা, কল্যাণ কামনার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এবং এটি মুমিন পুরুষ ও নারীদের গুণাবলির অন্যতম একটি গুণ।
তিন. দাওয়াত, শিক্ষা, সৎকাজের আদেশ ও অন্যায় থেকে নিষেধ করার দায়িত্ব শুধু পুরুষের একার নয়। নারীদেরও এ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে দাউদ ও মারইয়ামপুত্র ঈসার মুখে (ভাষায়) অভিশাপ দেয়া হয়েছে। কারণ, তারা অবাধ্য হয়েছে এবং সীমালঙ্ঘন করত। তারা পরস্পরকে মন্দ থেকে নিষেধ করত না, যা তারা করত তা থেকে। তারা যা করত তা কতই না মন্দ! (সূরা আল মায়েদা, আয়াত : ৭৮-৭৯)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. নবীর মুখ দিয়ে বনী ইসরাইলের ঐ সকল লোকদের অভিশাপ দেয়া হয়েছে যারা সীমালঙ্ঘন করেছে, অবাধ্য হয়েছে। তারা সমাজে প্রচলিত খারাপ ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত না।
দুই. সমাজে প্রচলিত মন্দ, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ না করা ইহুদীদের স্বভাব।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
বল, সত্য তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে। সুতরাং যার ইচ্ছা সে যেন ঈমান আনে আর যার মনে চায় সে যেন কুফরী করে। (সূরা আল কাহফ, আয়াত: ২৯)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. সত্য ও ন্যায় আল্লাহর পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে।
দুই. সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর যে তার অনুসরণ করবে তার পুরস্কার  সে-ই লাভ করবে আর যে অমান্য করবে তার শাস্তি সে-ই ভোগ করবে। দু’টো পথে চলার স্বাধীনতা আল্লাহ তাআলা সবাইকে দিয়েছেন।
যখন দুটো পথ মানুষের সামনে উম্মুক্ত তখন অবশ্যই ভাল পথের দিকে মানুষকে আহবান করতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেয়া হয়েছে তা ব্যাপকভাবে প্রচার কর। (সূরা আল হিজর, আয়াত ৯৪)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. যা কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে সেটাই প্রচার করতে হবে।
দুই. ব্যাপকভাবে এটা প্রচার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
তখন আমি মুক্তি দিলাম তাদেরকে যারা মন্দ হতে নিষেধ করে। আর যারা জুলুম করেছে তাদেরকে কঠিন আযাব দ্বারা পাকড়াও করলাম। কারণ, তারা পাপাচারে লিপ্ত হত। (সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৬৫)
আয়াত থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. যারা মন্দ থেকে নিষেধ করবে তারা আযাব ও আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্ত থাকবে।
দুই. খারাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকা, অন্যকে নিষেধ করা আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচার একটি পথ। আর এতে লিপ্ত হওয়া, অন্যকে লিপ্ত হতে নিষেধ না করা আল্লাহর আযাব নাযিলের একটি কারণ।
তিন. পাপাচারের কারণে সমাজ ও দেশে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিভিন্ন রকম শাস্তি অবতীর্ণ হয়।
হাদীস – ১.
1- عن أَبي سعيدٍ الخُدْريِّ رضي اللَّه عنه قال : سمِعْتُ رسُولَ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم يقُولُ : « مَنْ رَأَى مِنْكُم مُنْكراً فَلْيغيِّرْهُ بِيَدهِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطعْ فبِلِسَانِهِ ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبقَلبهِ وَذَلَكَ أَضْعَفُ الإِيمانِ » رواه مسلم .
আবু সায়ীদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি : তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখবে তখন সে যেন তা হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয় (অর্থাৎ নিষেধ করবে) যদি সে এ সামর্থ না রাখে তাহলে তার মুখ দিয়ে।  যদি এ সামর্থও না থাকে তাহলে অন্তর দিয়ে। আর এটা হচ্ছে ঈমানের দুর্বলতর স্তর। (মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. অন্যায় ও খারাপ কাজ দেখলে তা প্রতিরোধ-প্রতিহত করা ঈমানের দাবী।
দুই. সামর্থ অনুযায়ী প্রত্যেকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ করবে। সামর্থের বাইরে কোন কিছু করে নিজের উপর বিপদ ডেকে আনা ঠিক নয়।
তিন. যদি অন্যায় অনাচার দেখে কারো হৃদয়ে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হয়, বুঝতে হবে তার ঈমানের পূর্ণতায় ঘাটতি রয়েছে।
চার. এ হাদীসে পরিবর্তন করা বা বদলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বদলে দেয়ার তিনটি ধাপ রয়েছে। প্রথম পর্যায় হল: দাওয়াত। দ্বিতীয় পর্যায় হল: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ। তৃতীয় পর্যায় হল : শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায় ও অসৎ কাজ পরিবর্তন করে দেয়া।
হাদীস – ২.
2- عن ابنِ مسْعُودٍ رضي اللَّه عنه أَنَّ رسولَ اللَّه صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وسَلَّم قال : «مَا مِنَ نَبِيٍّ بعَثَهُ اللَّه في أُمَّةٍ قَبْلِي إِلاَّ كان لَه مِن أُمَّتِهِ حواريُّون وأَصْحَابٌ يَأْخذون بِسُنَّتِهِ ويقْتدُون بأَمْرِه، ثُمَّ إِنَّها تَخْلُفُ مِنْ بعْدِهمْ خُلُوفٌ يقُولُون مَالاَ يفْعلُونَ ، ويفْعَلُون مَالاَ يُؤْمَرون ، فَمَنْ جاهدهُم بِيَدهِ فَهُو مُؤْمِنٌ ، وَمَنْ جاهدهم بقَلْبِهِ فَهُو مُؤْمِنٌ ، ومَنْ جَاهَدهُمْ بِلِسانِهِ فَهُو مُؤْمِنٌ ، وليس وراءَ ذلِك مِن الإِيمانِ حبَّةُ خرْدلٍ » رواه مسلم .
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমার পূর্বে আল্লাহ তাআলা কোন জাতির কাছে যে নবীই পাঠিয়েছেন, তাঁর সহযোগিতার জন্য তাদের মধ্য হতে কিছু সাথী থাকত। তারা তাঁর সুন্নতকে আঁকড়ে ধরত এবং তাঁর নির্দেশের অনুসরণ করত। কিন্তু এদের পর এমন কিছু লোকের অভ্যূদয় ঘটল, তারা যা বলত নিজেরা তা করত না। আর এমন সব কাজ করত যার নির্দেশ তাদের দেয়া হয়নি। অতএব তাদের বিপক্ষে যে ব্যক্তি হাত দিয়ে জিহাদ করবে, সে ঈমানদার। যে তাদের সাথে অন্তর দিয়ে জিহাদ করবে সে ঈমানদার। আর যে তাদের সাথে মুখ দিয়ে জিহাদ করবে সে ঈমানদার। এ তিন অবস্থা ব্যতীত সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই। (মুসলিম)
হাদীস থেকে শিক্ষা ও মাসায়েল :
এক. নবী ও রাসূলদের যারা সঙ্গী-সহচর হবেন, তাদের প্রধান কর্তব্য হল, নবী ও রাসূলদের আদর্শ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করা।
দুই. এক দল মানুষ নিজেদেরকে নবী ও রাসূলদের অনুসারী বলে দাবী করে। তাদের ভালোবাসে বলে প্রচার করে কিন্তু তাদের আদর্শ অনুসরণ করে না। তারা যা বলে তা করে না। আবার তাদের যা করতে বলা হয়নি তা করে থাকে। ধর্মের নামে বিদআতে লিপ্ত হয়। এরা যেমন অন্যান্য নবীদের অনুসারীদের মধ্যে ছিল, তেমনি উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যেও আছে।
তিন. যারা এ রকম কাজে লিপ্ত হয় তারা বিদআতী। তারা জেনে হোক বা না জেনে হোক আল্লাহ তাআলার ধর্মকে বিকৃত করার কাজে লিপ্ত। তাই তাদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সকল উপায়ে জিহাদ করতে হবে।
চার. এদের বিরুদ্ধে যারা কোন ধরনের জিহাদ করবে না তারা ঈমানদার হতে পারবে না।
পাঁচ. বিদআত ও বিদআতপন্থীদের বিরুদ্ধে সামর্থ অনুযায়ী জিহাদ করা, তাদের কাজ-কর্মের প্রতিবাদ করা ঈমানের দাবী।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন