গত
দুই পোস্টের আলোচনা আলোচনা থেকে আমরা নসিহত, প্রচার, ন্যায়ের আদেশ ও
অন্যায়ের নিষেধ এককথায় আল্লাহর পথে দাওয়াতের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে
পেরেছি। এখন আমাদের দেখতে হবে, এ দায়িত্ব পালনের জন্য শর্তাবলী কি ? দায়ী ও
মুবাল্লিগ অর্থাৎ দাওয়াত দানকারী ও প্রচারকের মধ্যে কি কি গুণাবলী
বিদ্যমান থাকা প্রয়োজন? কারণ শরিয়ত সম্মতভাবে দায়িত্ব পালন না করলে আমরা
ভাল কাজ করতে যেয়ে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ব। সে দিকটি বিবেচনা করে আমরা কিছু
শর্ত ও গুণাবলী নিম্নে প্রদান করেছি:
এ স্পষ্ট জ্ঞান হলো ওহীনির্ভর জ্ঞান বা কোরআন ও হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
অন্যায়ে লিপ্ত বা বিভ্রান্ত যে ব্যক্তিকে তিনি দাওয়াত দিচ্ছেন তার প্রতি তার হৃদয়ের অনুভূতি হবে বিপদগ্রস্ত আপনজনের মত। যার বিপদে তিনি ব্যাথা অনুভব করছেন এবং যাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য হৃদয়ের আকুতি অনুভব করছেন। তাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিলে যদি সে তা না মানে বা বিরোধিতা করে তবে আহবানকারী মুমিনের হৃদয়ে ক্রোধ বা প্রতিহিংসা জাগ্রত হবে না, বরং বেদনা ও দুশ্চিন্তা তার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করবে। বেদনায় তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে উঠবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অবস্থার কথা আল্লাহ কোরআনুল কারীমের একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জীবনে এই ভালবাসা ও প্রেমের অগণিত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। যে কাফিরগণ তাঁর দেহকে রক্তরঞ্জিত করছে তাদেরই জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও করুণা প্রর্থনা করছেন। তিনি তাঁর কপালের রক্ত মুছছেন আর বলছেন,
ইহুদিরা সর্বদা ধর্ম ও মানবতার বিষয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আদর্শের বুলি আউড়ায় কিন্তু নিজেরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন:
আল্লাহ হক কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু গরম কথা বলতে কখনও নির্দেশ দেননি। হক্ক কথাকে নরম করে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম তাগুত আল্লাহদ্রোহী জালিম ফিরাউনের কাছে মূসা ও হারূন আ. কে প্রেরণ করে তিনি নরম কথার নির্দেশ দিয়ে বলেন:
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
সম্মানিত পাঠক, দাওয়াত বা সৎকাজের নির্দেশনা ও অসৎকাজের নিষেধ-এর উদ্দেশ্য মানুষের উপরে মাতব্বরি করা বা মানুষের ভুল ধরা নয়। বরং মানুষদেরকে সৎপথে আহবান করা এবং যথাসম্ভব মানুষকে ভাল পথে আসতে সাহায্য করা। এজন্য সর্বোচ্চ বিনম্রতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় দায়ী ও আদেশ নিষেধকারী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল বিনম্রতা। বিনম্রতা ও ধৈর্যের অনুপম আদার্শ দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন অগণিত বেদুঈন আরবের কঠিন হৃদয়। অস্ত্র বা শক্তি দিয়ে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেননি। অনুপম চরিত্র ও ভালবাসাময় আদেশ নিষেধ বা দাওয়াত দিয়ে হৃদয়গুলিকে জয় করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মদিনার রাষ্ট্র। এরপর সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা করেছেন যুদ্ধের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ হৃদয় জয়ের এ কাহিনী বিদ্ধৃত করে বলেছেন,
আল্লাহ তাআলা বলেন:
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান আচরণের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করতে পৃথক গ্রন্থ প্রয়োজন। এখানে কয়েকটি দিক উল্লেখ করা যায়:
কাফিরদের নিন্দামন্দ, মিথ্যা-অপবাদ, বিরূপ কথা ও ষড়যন্ত্রের মুকাবিলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়ে সূরা নাহলের ১২৭-১২৮ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
ইলম বা জ্ঞান
দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য প্রথম শর্ত হলো, ন্যায়-অন্যায়, তার পর্যায় এবং সেগুলির প্রতিবাদ-প্রতিকারের ইসলামি পদ্ধতি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান। আমি যে কাজ করার বা বর্জন করার দাওয়াত দিচ্ছি তা সত্যিই ইসলামের নির্দেশ কিনা তা জানতে হবে। ভালমন্দ অনেক ক্ষেত্রে সকল মানুষই বিবেক ও জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারেন। খুন, জুলুম, রাহাজানি, চুরি , ডাকাতি, মারামারি, নেশা-মাদকাশক্তি ইত্যাদি অগণিত অন্যায় কাজকে অন্যায় বলে জানতে বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। অনুরূপভাবে মানুষকে সাহায্য করা, সান্ত্বনা দেওয়া, সৃষ্টির কল্যাণে এগিয়ে আসা ইত্যাদি ভাল কাজ বলে সবাই বুঝি। কিন্তু ইসলামি কর্মকাণ্ড বা ধর্মীয় নির্দেশনা বিষয়ক অগণিত বিষয় রয়েছে যে সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান না থাকলে মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে নিজেই অন্যায়ে লিপ্ত হবেন। অথবা সৎকার্যে আদেশ দান করতে যেয়ে অসৎকার্যে আদেশ করবেন। যেমন একব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ কাজ করছেন বা স্ত্রী-সন্তানদের প্রতিপালনের জন্য জরুরি কাজ করছেন। কাজটি তার জন্য ফরজে আইন। আপনি তাকে এই দুনিয়াবী কাজ বর্জন করে নফল বা ফরজে কিফায়া পর্যায়ের মাহফিল, মিছিল, মিটিং বা দাওয়াতে অংশগ্রহণ করতে অহবান করলেন। অথবা একব্যক্তি ওজরের কারণে দাঁড়িয়ে পেশাব করছেন দেখে আপনি তাকে যাচ্ছেতাই গালি-গালাজ করলেন। উভয় ক্ষেত্রে আপনি ন্যায় করতে যেয়ে অন্যায়ে লিপ্ত হলেন। এরূপ অগণিত উদাহরণ আমরা দেখতে পাব। এজন্য ধর্মীয় বিধি-বিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির ক্ষেত্রে মুমিনের উচিত বিষয়টি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বা অন্যায় তা স্পষ্টভাবে না জেনে হটকারিতায় লিপ্ত না হওয়া। দাওয়াতের ক্ষেত্রে স্পষ্ট জ্ঞানের অত্যাবশ্যিকতা বিষয়ে আল্লাহ বলেন:বল, এটিই আমার পথ। স্পষ্ট জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহর দিকে আহবান করি আমি এবং আমার যারা অনুসারী। (সূরা ইউসুফ ১০৮ আয়াত)।
এ স্পষ্ট জ্ঞান হলো ওহীনির্ভর জ্ঞান বা কোরআন ও হাদিসের স্পষ্ট নির্দেশনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
সূরা আহকাফের ৯ নম্বর আয়াত ও অন্যান্য স্থানে একই কথা বলা হয়েছে। এজন্য দাওয়াতের দায়িত্ব পালনকারীকে কোরআন ও হাদিসের আলোকে স্পষ্টরূপে জানতে হবে, যে কাজ করতে বা বর্জন করতে তিনি দাওয়াত দিচ্ছেন তার শরয়ি বিধান কি এবং তা পালন-বর্জনের দাওয়াতের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শেখানো পদ্ধতি কি? কাজটি সৎকর্ম হলে তা ফরজ, ওয়াজিব, মুসতাহাব ইত্যাদি কোন পর্যায়ের ইত্যাদি স্পষ্ট কোরআন ও হাদিসের আলোকে জানতে হবে। ওহীর স্পষ্ট নির্দেশনা ব্যতীত সাধারণ ধারণা, আবেগ আন্দাজ ইত্যাদির ভিত্তিতে কোনো কিছুকে হালাল বা হারাম বলতে কোরআনুল কারিমে নিষেধ করা হয়েছে। এরশাদ করা হয়েছে:বল আমি তো শুধু ওহীর ভিত্তিতেই তোমাদেরকে ভয় প্রদর্শন করছি। (সূরা আম্বিয়া: ৪৫)
দায়ী ও মুবাল্লিগকে অবশ্যই সর্বদা বেশি বেশি কোরআন ও হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, ও অন্যান্য ইসলামি গ্রন্থ অধ্যায়ন করতে হবে। কোরআন-হাদিস বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আলেমদের রচিত গ্রন্থদি পড়ে দীনকে জানার চেষ্টা করা কঠিন অন্যায় এবং কোরআন হাদিসের প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন। মহান আল্লাহ কোরআনকে সকল মানুষের হেদায়েতরূপে প্রেরণ করেছেন। তিনি তা বুঝা সহজ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য তাঁর মহান সুন্নাত ও হাদিস রেখে গিয়েছেন। এগুলির সার্বক্ষণিক অধ্যায়ন মুমিনের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত, শ্রেষ্ঠতম জিকর ও দাওয়াতের প্রধান হাতিয়ার।তোমাদের জিহবা দ্বারা মিথ্যা আরোপ করে (মনগড়াভাবে) বলবে না যে, এটি হালাল ও এটি হারাম। এভাবে আল্লাহর নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করা হবে। যারা আল্লাহর নামে মিথ্যা উদ্ভাবন করে তারা সফল হয় না। (সূরা নাহল: ১১৬)
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি ভালবাসা ও আন্তরিকতা
আদেশ-নিষেধ, নসিহত, বা আল্লাহর পথে আহবান করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয় হল, যাকে আদেশ করছি বা আহবান করছি তার প্রতি হৃদয়ের ভালবাসা ও আন্তরিক মঙ্গল কামনা। এ জন্যই দাওয়াতের এ কর্মকে কোরআন ও হাদিসে নসিহত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা দেখছি যে, নসিহতের মূল অর্থ আন্তরিক ভালবাসা ও মঙ্গল কামনা। আল্লাহর পথে আহবানকারী বা আদেশ নিষেধকারী কারো ভুল ধরে দেওয়া, নিজের জ্ঞান প্রদর্শন বা নিজের মাতব্বরি প্রতিষ্ঠার জন্য এই কাজ করবেন না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি হৃদয়ের ভালবাসার টানেই এ দায়িত্ব পালন করবেন।অন্যায়ে লিপ্ত বা বিভ্রান্ত যে ব্যক্তিকে তিনি দাওয়াত দিচ্ছেন তার প্রতি তার হৃদয়ের অনুভূতি হবে বিপদগ্রস্ত আপনজনের মত। যার বিপদে তিনি ব্যাথা অনুভব করছেন এবং যাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য হৃদয়ের আকুতি অনুভব করছেন। তাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিলে যদি সে তা না মানে বা বিরোধিতা করে তবে আহবানকারী মুমিনের হৃদয়ে ক্রোধ বা প্রতিহিংসা জাগ্রত হবে না, বরং বেদনা ও দুশ্চিন্তা তার হৃদয়কে আচ্ছন্ন করবে। বেদনায় তার হৃদয় দুমড়ে মুচড়ে উঠবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অবস্থার কথা আল্লাহ কোরআনুল কারীমের একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন:
সূরা শুআরা-এর ৩ নং আয়াতেও অনুরূপ বলা হয়েছে।তারা এই বাণীতে বিশ্বাস স্থাপন না করলে সম্ভবত আপনি তাদের পিছনে ঘুরে দু:খ-বেদনায় নিজেকে ধ্বংস করে ফেলবেন। (সূরা কাহফ: ১০)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জীবনে এই ভালবাসা ও প্রেমের অগণিত উদাহরণ আমরা দেখতে পাই। যে কাফিরগণ তাঁর দেহকে রক্তরঞ্জিত করছে তাদেরই জন্য তিনি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও করুণা প্রর্থনা করছেন। তিনি তাঁর কপালের রক্ত মুছছেন আর বলছেন,
মক্কাবাসীদের অত্যাচারে জর্জরিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তায়েফে যেয়ে পেলেন নির্মমতম অত্যাচার। সে সময়ে জিবরাঈল (আ.) পাহাড়ের ফিরিশতাকে নিয়ে তাঁর নিকট আগমন করে বললেন, আপনার অনুমতি হলে পাহাড় উঠিয়ে এ জনপদকে ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কঠিনতম কষ্টের সে মুহূর্তেও তিনি বললেন:হে আমার প্রতিপলক, আমার জাতিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ তারা জানে না। (বুখারি ও মুসলিম, ফতহুল বারী)
সুবহানাল্লাহ! কত বড় ধৈর্য! কত মহান প্রেম!! আমরা যারা সামান্য বিরোধিতায় উত্তেজিত হয়ে গালাগালি করি ও প্রতিশোধের পরিকল্পনায় বিভোর হই তাদের একটু চিন্তা করা দরকার!না বরং আমি আশা করি যে, আল্লাহ হয়ত এদের ঔরস থেকে এমন মানুষের জন্ম দেবেন যারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কিছু শরিক করবে না। (বুখারি ও মুসলিম)
ব্যক্তিগত আমল
দায়ী ইলাল্লাহ বা আল্লাহর পথে আহবানকারী ও আদেশ-নিষেধকারী অবশ্যই তাঁর প্রচারিত আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান, বিশ্বাসী ও পালনকারী হবেন। সারা বিশ্বে যিনি আল্লাহর দ্বীন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদর্শের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা দেখতে চান, তাকে সবার আগে তার ব্যক্তিগত জীবনের সকল ক্ষেত্রে ও সকল দিকে এ আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট আদর্শ নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠার চেয়ে অন্যকে দাওয়াত দেওয়া আনেক বেশি সহজ ও আকার্ষণীয় কাজ। এজন্য শয়তান এবং মানবীয় প্রবৃত্তির কাছে তা খুবই প্রিয়। এর শাস্তিও খুব কঠিন।ইহুদিরা সর্বদা ধর্ম ও মানবতার বিষয়ে সবচেয়ে আকর্ষণীয় আদর্শের বুলি আউড়ায় কিন্তু নিজেরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করে। মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন:
দ্বীনের দাওয়াত ও প্রতিষ্ঠার কাজে লিপ্ত অনেকেই বুঝে অথবা না বুঝে এ অপরাধে অপরাধী। ইসলামের দাওয়াত ও প্রতিষ্ঠার কথা বললেও ব্যক্তিগত ইবাদত, আচরণ, পারিবারিক সম্পর্ক, স্ত্রী, সন্তান, পিতামাতা, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, কর্মস্থল, সহকর্মী ও অন্যান্য মানুষের অধিকার আদায় ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত দুর্বল। এদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। দুই পর্যায়ে আমরা এ অপরাধে লিপ্ত হই:তোমরা কি মানুষদেরকে সৎকার্যে নির্দেশ দাও আর নিজেদের কথা ভুলে যাও! অথচ তোমরা কিতাব অধ্যায়ন কর! তবে কি তোমরা বুঝ না। (সূরা বাকারা : ৪৪)
- প্রথমত: যে কার্যের জন্য আদেশ বা নিষেধ করছি তা আমরা নাজেরাই পালন বা বর্জন করছি না। যেমন আমরা প্রতিবেশীর অধিকার পালন অথবা সুদ বর্জনের দাওয়াত দিচ্ছি, কিন্তু নিজেরাই প্রতিবেশীর অধিকার নষ্ট করছি বা সুদে লিপ্ত রয়েছি।
- দ্বিতীয়ত: আমরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অপরাধী না হলেও, অন্যান্য
সমপর্যায়ের অপরাধে লিপ্ত রয়েছি। যেমন আমরা সুদ খাচ্ছি না, তবে ঘুষ, যৌতুক,
কর্মে ফাঁকি, ভেজাল ইত্যাদি অপরাধে লিপ্ত আছি।
মহান আল্লাহ বলেন:
হে মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা তোমরা কেন বল? আল্লাহর দৃষ্টিতে অতিশয় অসন্তোষজনক যে, তোমরা যা কর না বলবে। (সূরা সফ:২-৩)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:
কেয়ামতের দিন এক ব্যক্তিকে আনায়ন করে জাহান্নামের অগ্নির মধ্যে নিক্ষেপ করা হবে। আগুনে তার নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়বে এবং গাধা যেমন যাতা (ঘানি) নিয়ে ঘুরে তেমনি সে ঘুরতে থাকবে। তখন জাহান্নামবাসীরা তার নিকট সমবেত হয়ে বলবে, হে অমুক, তোমার কি হল? তুমি না আমাদেরকে সৎকার্যে আদেশ দিতে এবং অসৎকার্য থেকে নিষেধ করতে? সে বলবে আমি তোমাদেরকে সৎকার্যে আদেশ দিতাম কিন্তু নিজে করতাম না। আর অসৎকার্য থেকে নিষেধ করতাম, কিন্তু নিজেই তা করতাম। (বুখারি)
ব্যক্তিগত অমলে ত্রুটি সহ দাওয়াতের বিধান
উপরের আয়াত ও হাদিস থেকে বুঝতে পারছি যে, নিজে পালন না করে অন্যকে দাওয়াত দেওয়া অন্যায়। তবে দাওয়াত বা আদেশ নিষেধ ফরজে আইন পর্যায়ের হলে নিজের আমলে ত্রুটি থাকলেও আদেশ নিষেধ করতে হবে । যেমন একব্যক্তি ধুমপান করেন বা ঠিকমত জামাতে নামাজ পড়েন না। তিনি তার অধিনস্ত বা পরিবারের সদস্য কাউকে এ পাপে লিপ্ত দেখলে তার জন্য তাকে আদেশ বা নিষেধ করা ফরজে আইন দায়িত্ব হয়ে যাবে। এ অবস্থায় আদেশ নিষেধ না করলে তিনি দ্বিতীয় একটি অন্যায় ও অপরাধের মধ্যে পতিত হবেন।বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা
দাওয়াতের ক্ষেত্রে অন্যতম মৌলিক শর্ত হলো বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা। আমরা অনেক সময় সৎকার্যে আদেশ বা অন্যায় থেকে নিষেধ করাকে ব্যক্তিগত অহং প্রতিষ্ঠার পর্যায়ে নিয়ে যাই। ফলে আমরা কথা বলি মাতব্বরি ভঙ্গিতে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষের অহংবোধে আঘাত করে এবং আমাদের কথা গ্রহণ করতে বাধা দেয়। এরপর যখন সে তা গ্রহণ না করে বা আমাদের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলে তখন আমরা তাকে ইসলামের শত্রু আখ্যায়িত করে কঠিনভাবে তার বিরুদ্ধে আক্রোশমূলক কথা বলি। এগুলি সবই কঠিন অন্যায় এবং আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার পথ। আমরা অনেক সময় গরম কথা বা কড়া কথা বলাকে সাহসিকতা ও জিহাদ বলে মনে করি। অথচ আল্লাহ কোরআনুল কারীমে নরম কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন।আল্লাহ হক কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন কিন্তু গরম কথা বলতে কখনও নির্দেশ দেননি। হক্ক কথাকে নরম করে বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম তাগুত আল্লাহদ্রোহী জালিম ফিরাউনের কাছে মূসা ও হারূন আ. কে প্রেরণ করে তিনি নরম কথার নির্দেশ দিয়ে বলেন:
এ যদি হয় কাফিরকে দাওয়াত দেওয়ার বা আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রে নবী –রাসূলগণের প্রতি নির্দেশ, তাহলে যারা কালিমা পড়েছেন তাদেরকে আদেশ নিষেধ করার ক্ষেত্রে আমাদের আরো কত বিনম্র ও বন্ধুভাবাপন্ন হওয়া উচিত তা একটু চিন্তা করুন।তোমরা উভয়ে ফিরাউনের নিকট গমন কর, সে অবাধ্যতা ও সীমালংঘন করেছে। তোমরা তার সাথে নরম কথা বলবে, হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে বা ভয় করবে। (সূরা ত্বহা : ৪৩-৪৪)
আল্লাহ তায়ালা বলেন:
এ যদি হয় কাফেরদের দেবদেবীর ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ, তাহলে কালিমা পাঠকারী মুসলিম বলে পরিচিত ব্যক্তিকে আদেশ নিষেধ করতে যেয়ে তাকে তার ভ্রান্ত বা জাগতিক মতের নেতা বা সাথীদেরেক গালি দেওয়া কিভাবে বৈধ হবে? গালাগালি, কঠোরতা, হিংসা, ঘৃণা, গীবত, অহংকার ইত্যাদি দ্বারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাতে মূলত নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা হবে, কোন ইবাদত পালন করা হবে না। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।তারা আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিবে না কারণ ফলে তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞতা বশত আল্লাহকে গালি দিবে। (সূরা আনআম : ১০৮)
সম্মানিত পাঠক, দাওয়াত বা সৎকাজের নির্দেশনা ও অসৎকাজের নিষেধ-এর উদ্দেশ্য মানুষের উপরে মাতব্বরি করা বা মানুষের ভুল ধরা নয়। বরং মানুষদেরকে সৎপথে আহবান করা এবং যথাসম্ভব মানুষকে ভাল পথে আসতে সাহায্য করা। এজন্য সর্বোচ্চ বিনম্রতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় দায়ী ও আদেশ নিষেধকারী ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আর তার অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল বিনম্রতা। বিনম্রতা ও ধৈর্যের অনুপম আদার্শ দিয়ে তিনি জয় করেছিলেন অগণিত বেদুঈন আরবের কঠিন হৃদয়। অস্ত্র বা শক্তি দিয়ে তিনি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেননি। অনুপম চরিত্র ও ভালবাসাময় আদেশ নিষেধ বা দাওয়াত দিয়ে হৃদয়গুলিকে জয় করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মদিনার রাষ্ট্র। এরপর সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা করেছেন যুদ্ধের মাধ্যমে। মহান আল্লাহ হৃদয় জয়ের এ কাহিনী বিদ্ধৃত করে বলেছেন,
একটি হাদিসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন,আল্লাহর দয়ার অন্যতম প্রকাশ যে আপনি তাদের প্রতি বিনম্র-কোমল হৃদয় ছিলেন। যদি আপনি রূঢ় ও কঠোর চিত্ত হতেন তাহলে তারা আপনার আশপাশ থেকে সরে পড়ত। (সূরা আলে ইমরান : ১৫৯)
কতিপয় ইহুদি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বলল, আস-সামু আলাইকুম (আপনার উপর মরণ অভিশাপ)। আয়েশা রা. রাগন্বিত হয়ে বলেন, তোমাদের উপর মরণ, তোমাদেরকে আল্লাহ অভিশপ্ত করুন এবং তোমাদের উপর তার ক্রোধ অবতীর্ণ হোক। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আয়েশা শান্ত হও। তুমি অবশ্যই সর্বদা বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা অবলম্বন করবে। আল্লাহ সকল বিষয়ে বিনম্রতা ও বন্ধুভাবাপন্নতা ভালবাসেন। আর খবরদার! কখনই তুমি উগ্রতা ও অভদ্রতার নিকটবর্তী হবে না। আয়েশা রা. বলেন, তারা কী বলেছে আপনি কি তা শুনেননি? তিনি বলেন, আমি কি বলেছি তা কি তুমি শোন নি? আমি বলেছি, ওয়ালাইকুম অর্থাৎ তোমাদের উপরে। (বুখারি মুসলিম)
উত্তম দিয়ে মন্দ প্রতিহত করা
দাওয়াত বা দীন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে ধৈর্য, ক্ষমা ও উত্তম ব্যবহারের দ্বারা খারাপ আচরণের প্রতিরোধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ। আল্লাহ বলেন:মহান আল্লাহ বলেছেন:কথায় কে উত্তম ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা যে আল্লাহর দিকে আহবান করে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত। ভাল এবং মন্দ সমান হতে পারে না। (মন্দ ) প্রতিহত কর উৎকৃষ্টতর (আচারণ) দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত। এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরকেই যারা মহা সৌভাগ্যবান। (সূরা ফুসসিলাত : ৩৩-৩৫)
বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে। দাওয়াতের ক্ষেত্রে গালির পরিবর্তে গালি, নিন্দার প্রতিবাদে নিন্দা, রাগের প্রতিবাদে রাগ ইত্যাদি নিষিদ্ধ। এসব মন্দ আচরণের প্রতিরোধ করতে হবে উৎকৃষ্টতর আচরণ দিয়ে। অথচ আমরা অনেক সময় এই নির্দেশের বিপরীত কর্ম করি। কেউ প্রতিবাদ করলে বা খারাপ আচরণ করলে আমরা তার আচরণের চেয়ে নিকৃষ্টতর আচরণের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করি!!মন্দের মুকাবিলা কর যা উৎকৃষ্টতর তা দিয়ে, তারা যা বলে আমি সে সম্পর্কে বিশেষ অবহিত। (সূরা মুমিনুন : ৯৬)
সুন্দর ব্যবহার ও আচরণ
দায়ী বা সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধকারীকে অবশ্যই তাঁর নেতা রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মত মহোত্তম আচরণের অধিকারী হতে হবে। আরবিতে একে (خلق) বা আখলাক বলা হয়। বাংলায় সাধারণত একে চরিত্র বলা হয়। আর আরবিতে আখলাক শব্দ আরো প্রশস্ত। মানুষের সাথে মানুষের আচরণ ও ব্যবহারের সামগ্রিক অবস্থাকেই আরবিতে খুলুক বলা হয়। এজন্য খুলুক বা আখলাককে বাংলায় আচরণ বা ব্যবহার বলাই উত্তম।আল্লাহ তাআলা বলেন:
এ মহান আচরণের বিভিন্ন দিক রয়েছে। উপরে উল্লেখিত বিনম্রতা, বন্ধুভাবাপন্নতা, উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দ প্রতিহত করা ইত্যাদিও এই খুলুকে আজিম বা মহান আচরণের অংশ। তবে এর আরো বিভিন্ন দিক রয়েছে যা দায়ী ইলাল্লাহকে অর্জন করতে হবে। শুধু দাওয়াতের ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ব্যবহার বা আচরণ আল্লাহর পথে আহবানকারীর জীবনকে আলোকিত করবে এবং তার চারিধারে ফুলের সৌরভ ছড়াবে।আর নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্র ও ব্যবহারের উপর অধিষ্ঠিত। (সূরা আল কলম : ৪)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহান আচরণের বিভিন্ন দিক বিস্তারিত আলোচনা করতে পৃথক গ্রন্থ প্রয়োজন। এখানে কয়েকটি দিক উল্লেখ করা যায়:
- ১. সর্বাবস্থায় অশ্লীল কথা, অশালীন কথা, গালিগালাজ ও কটুক্তি বর্জন করা। বিভিন্ন হাদিসে বারংবার বলা হয়েছে,
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশালীন, অশ্লীল, অশোভনীয় কথা বলতেন না, গালি দিতেন না, কটুক্তি করতেন না। (বুখারি, মুসলিম ও অন্যান্য)।
- ২. বেশি কথা বলা, দম্ভভরে বা চিবিয়ে কথা বলা, অহঙ্কার করা,
বিতর্ক করা, মিথ্যা কথা বলা ইত্যাদি পরিহার করা। রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
তোমাদের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী অবস্থানের অধিকারী হবে তারা যারা তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম আচরণের অধিকারী। আর তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত এবং কিয়ামতের দিন আমার থেকে সবচেয়ে দূরে অবস্থান করবে তারা যারা বেশি কথা বলে, যারা কথা বলে জিতে যেতে চায়, বাজে কথা বলে এবং যারা অহঙ্কার করে। (তিরমিজি, হাদিসটি হাসান।)
নিজের মতটি হক হওয়া সত্ত্বেও যে ব্যক্তি বিতর্ক পরিত্যাগ করল আমি তার জন্য জান্নাতের পাদদেশে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। আর যে ব্যক্তি হাসি-মশকারার জন্যও মিথ্যা বলে না আমি তার জন্য জান্নাতের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। আর যার আচরণ-ব্যবহার সুন্দর আমি তার জন্য জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে একটি বাড়ির জিম্মাদারী গ্রহণ করলাম। (আবু দাউদ, হাসান, সহীহুল জামে।)
- ৩.
সকলের সাথে আনন্দিত চিত্তে, হাসিমুখে কথা বলা এবং কথার সময় পরিপূর্ণ
মনোযোগ ও আগ্রহ সহকারে তার কথা শোনা। যেন তার প্রতি ভালবাসা ও আন্তরিকতা
পূর্ণভাবে ফুটে উঠে। আমর ইবনুল আস রা. বলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজের নিকৃষ্টতম ব্যক্তির সাথেও পরিপূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তার দিকে পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে কথা বলতেন। এভাবে তিনি তার হৃদয় জয় করে নিতেন। তিনি আমার সাথেও কথা বলতেন পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে এবং আমার দিকে পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে। এমনকি আমার মনে হতো যেন আমিই সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ। (তাবরানি, হাসান।)
উত্তম আচরণ শুধু দাওয়াতের সফলতার চাবিকাঠিই নয়, উপরন্তু আখেরাতের সফলতার সর্বোত্তম উপায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
কিয়ামতের দাড়িপাল্লায় উত্তম আচরণের চেয়ে বেশি ভারি কোনো আমল আর রাখা হবে না। আর উত্তম আচরণের অধিকারী ব্যক্তি এ আচরণের দ্বারাই তাহাজ্জুদ ও নফল রোযা পালনকারীর মর্যাদা অর্জন করবে। (তিরমিজি, আহমদ, আবু দাউদ, হদিসের সূত্র সহীহ, সহীহুল জামে।)
সবর বা ধৈর্য
উপর্যুক্ত গুণগুলি অর্জন করতে ধৈর্যের অনুশীলন করতে হবে। পূর্বোল্লিখিত একটি আয়াতে আমরা দেখেছি যে, উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দ প্রতিহত করার গুণ শুধু ধৈর্যশীলগণই অর্জন করতে পারেন এবং তারাই মহা সৌভাগ্যবান। দাওয়াত ও ধৈর্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। আল্লাহ তায়ালা বলেন:সূরা আলে ইমরানের ১৮৬ আয়াত এবং সূরা আল-আসরেও অনুরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধৈর্যের মূল পরিচয় হল রাগের সময়। আল্লাহর পথে ডাকতে বা ভাল কাজের আদেশ ও খারাপ কাজের নিষেধ করতে গেলেই অনেক মানুষের নিকট থেকে বিরূপ কথা, গালমন্দ, নিন্দা ইত্যাদি শুনতে হবে এবং এতে কখনো প্রচণ্ড রাগ হবে এবং কখনো মন দু:খভরাক্রান্ত হবে। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদেরকে ধৈর্যের মাধ্যমে এর মুকাবিলা করতে হবে এবং উৎকৃষ্ট দিয়ে মন্দ প্রতিহত করতে হবে। কোরআন কারীমে বারংবার মুমিনদেরকে ধৈর্য অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ক্রোধের সময় ধৈর্য ধারণ করা এবং ক্রোধ সংবরণ করাকে মুমিনদের মৌলিক পরিচয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর পথে টিকে থাকার জন্য ধৈর্য ও সালাতের সাহায্য গ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।সালাত কায়েম কর, সৎকার্যে আদেশ কর, অসৎকার্যে নিষেধ কর এবং তোমার উপর যা নিপতিত হয় তাতে ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয় এগুলিই দৃঢ়সংকল্পের কাজ।(সূরা লুকমান : ১৭)
কাফিরদের নিন্দামন্দ, মিথ্যা-অপবাদ, বিরূপ কথা ও ষড়যন্ত্রের মুকাবিলায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ধৈর্য ধারণের নির্দেশ দিয়ে সূরা নাহলের ১২৭-১২৮ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:
ধৈর্য ধারণ কর, আর তোমার ধৈর্য তো আল্লাহর সাহায্য ছাড়া হবে না। আর তাদের দরুন দু:খ করবে না এবং তাদের ষড়যন্ত্রে মন:ক্ষুন্ন হবে না। আল্লাহ তাদের সঙ্গে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করেন এবং যারা সৎকর্ম পরায়ণ। ( সূরা নাহল : ১২৭-১২৮)
সালাত, তাসবিহ ও ইবাদত
ধৈর্য অর্জনের অত্যন্ত বড় অবলম্বন হলো সালাত ও দোয়া। কোরআনুল কারীমে একাধিক স্থানে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে শক্তি অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূরা হিজর-এর ৯৭-৯৯ আয়াতে আল্লাহ বলেন:আল্লাহর পথে ডাকতে গেলে বা সৎকার্যে আদেশ ও অসৎকার্যে নিষেধ করতে গেলে মানুষের বিরোধিতা, শত্রুতা ও নিন্দার কারণে কখনো ক্রোধে, কখনো বা বেদনায় অন্তর সঙ্কীর্ণ হয়ে যায়। এ মনোকষ্ট দূর করার প্রকৃত ধৈর্য ও মানুষিক স্থিতি অর্জন করার উপায় হলো বেশি বেশি আল্লাহর জিকর, ক্রন্দন ও প্রার্থনা করা। এভাবেই আমরা (Re-active)না হয়ে (Pro-active) হতে পারব। কারো আচরণের প্রতিক্রিয়া আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করবে না। আল্লাহর রেজামন্দির দিকে লক্ষ্য রেখে আমরা আচরণ করতে পারব। আমরা সত্যিকার অর্থে মহা- সৌভাগ্যবানদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারব। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন।আমি তো জানি, তারা যা বলে তাতে তোমার অন্তর সংকুচিত হয়। সুতরাং তোমার প্রতিপলকের তাসবিহ-তাহমিদ বা প্রশংসাময় পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং সাজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং একিন (মৃত্যু) আসা পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের ইবাদত কর। (সূরা হিজর : ৯৭-৯৯)
0 মন্তব্য(গুলি):
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন