শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

ইসলামে জিযয়াহ্‌র বিধান পর্ব ১





জিযয়াহ্ সম্পর্কে কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
‘তোমরা লড়াই কর আহলে কিতাবের সেসব লোকের সাথে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দীন গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিযয়াহ্‌ দেয়।’ [সূরা আত-তাওবাহ্ : ২৯]
জিযয়াহ্‌ সম্পর্কে কেউ কেউ বলে, মুসলিম উম্মাহর বশ্যতা-স্বীকারকারীদের উপর কুরআনের এ আয়াত যুলম করেছে; তাদের এ আপত্তি অসার ও অমূলক। এতে সন্দেহ নেই, ইসলাম জিযয়াহ্‌র বিনিময়ে যেসব দায়িত্ব ও অধিকারের যিম্মাদারী গ্রহণ করেছে, এ অভিযোগকারী সে সম্পর্কে অজ্ঞ ও গাফেল। মূলত সে পূর্বাপর অন্যান্য মতাদর্শের ন্যায় ইসলামকেও একটি মতাদর্শ জ্ঞান করেছে, অথচ অন্যান্য ধর্মে যিম্মীদের উপর যুলম ও অত্যাচার করার যে রীতি প্রচলিত ছিল, ইসলাম তা থেকে একেবারে মুক্ত। আমি দৃঢ় আশাবাদি, এ নিবন্ধ পাঠ করলে খুব সহজে একজন পাঠকের নিকট তা স্পষ্ট হবে, তাই কয়েকটি ধাপে বিন্যস্ত করে আমি জিযয়াহ্‌র আলোচনা আরম্ভ করছি।
প্রথমত : জিযয়াহ্‌র আভিধানিক অর্থ :
জিযয়াহ্‌ আরবি শব্দ, আরবি (ج ز ي) তিনটি অক্ষর দ্বারা গঠিত। নিজের উপর কৃত অনুগ্রহ, ইহসান ও দয়ার প্রতিদান দেয়ার সময় আরবরা : “جزى ، يجزي” ক্রিয়া ব্যবহার করে। আর الجزية مشتق على وزن فِعلة من المجازاة،   অর্থ : সে তোমাকে যে নিরাপত্তা দিয়েছে, তুমি তার বিনিময় দান কর। মুতাররিযী বলেন: الجزية শব্দের উৎপত্তি الإجزاء শব্দ থেকে, কারণ এ জিযয়াহ্‌ যিম্মিকে তার অন্যান্য সকল প্রকার দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে।[1]
দ্বিতীয়ত : ইসলাম পূর্বে জিযয়াহ্‌ :
পৃথিবীর বুকে ইসলাম যেমন নতুন নয়, তেমনি মুসলিমগণ তাদের অধীনদের উপর জিযয়াহ্‌ নতুন করে আরোপ করেন নি, বরং আদিকাল থেকেই বিজয়ী জাতি পরাজিত জাতির উপর জিযয়াহ্‌ আরোপ করে আসছে, মানব ইতিহাস তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী।
নিউটেস্টামেন্টে (বাইবেল) জিযয়াহ্‌ প্রথার প্রচলন :
মাসিহ সিমোনকে বলেন : ‘হে সিমোন! বাদশাহ যাদের কাছ থেকে কর বা জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করে, তারা কি বাদশাহর প্রজাভুক্ত, না পরদেশি? পিটার্‌স তাকে বললেন : তারা পরদেশি। যিশু তাকে বললেন: তবে তাদের সন্তানেরা স্বাধীন।’ [মথি ১৭ : ২৪-২৫]
নবীগণ যখন আল্লাহর ইচ্ছা ও তার সাহায্যে কোন দেশের উপর বিজয় লাভ করেছেন, তখন তারা পরাজিত জাতির উপর জিযয়াহ্‌ আরোপ করেছেন, এমনকি তাদেরকে দাসে পরিণত করেছেন, যেমন নবী যশোয়া বিজয় লাভ করে কিনআনীদের দাসে পরিণত করেছেন: ‘(ফিলিস্তিনের) ‘গেজের’-নিবাসী কিনআনীদেরকে তারা তাড়িয়ে দেন নি, বরং তারা আজ পর্যন্ত ‘এফ্রাইম’ -এর মধ্যে বসবাস করছে, তারা জিযয়াহ্‌ প্রদান করে দাসত্ব মেনে নিয়েছিল। [যশোয়া ১৬ : ১০] নবী যশোয়া তাদের উপর দাসত্ব এবং জিযয়াহ্‌ উভয় আরোপ করেন।
খ্রিষ্টধর্ম ইহুদি ধর্মে কোন পরিবর্তন আনে নি, বরং ইহুদি-ধর্মের পূর্ণতা দান করার জন্য ঈসা আলাইহিস সালাম আগমন করেছেন। [দেখুন, মথি ৫ : ১৭] তাই আমরা বলতে পারি, ইহুদি-ধর্মে প্রচলিত জিযয়াহ্‌ প্রথা খ্রিষ্টধর্মেও বিদ্যমান ছিল। অধিকন্তু মাসিহ তার অনুসারীদের নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তারা রোমানদের জিযয়াহ্‌ প্রদান করে, তিনি নিজে তা সবার আগে প্রদান করেছেন। যেমন তিনি সিমোনকে বলেছেন : ‘তুমি সমুদ্রে গিয়ে বড়শি ফেল এবং প্রথম যে মাছটি ধরা পড়ে তা হাতে নাও, মাছটির মুখ খুলে তুমি তার মধ্যে মুদ্রা পাবে, তা নিয়ে তুমি আমার ও তোমার পক্ষ থেকে তাদেরকে (রোমান) প্রদান কর।’ [মথি ১৭ : ২৪-২৭]
ইহুদিরা যখন (বাইবেলের ভাষ্যমতে) জিযয়াহ্‌ প্রদানের ব্যাপারে তার (মাসিহের) অভিমত জানতে চায়, তখন তিনি জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করা সিজারের অধিকার স্বীকার করেন। তার কাছে তাদের ছাত্রদের হেরোদের সাথে এ মর্মে প্রেরণ করে : ‘হে শিক্ষক, আমরা জানি আপনি সত্যবাদী, আর আপনি আল্লাহর দীন সম্পর্কে সত্য-শিক্ষা দেন, আপনি কারো পরোয়া করেন না, কারণ আপনি মানুষের চেহারার দিকে তাকান না। আপনি আমাদেরকে বলুন আপনার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে, সিজারকে জিযয়াহ্‌ প্রদান করা বৈধ কি না? … তিনি বললেন : এ-প্রতিকৃতি ও এ-লেখা কার? তারা বলল : সিজারের। তিনি বললেন : যা সিজারের, তা সিজারকে প্রদান কর, আর যা আল্লাহর, তা আল্লাহকে প্রদান কর।’ [মথি ২২ : ১৬-২১]
রোমানদের পক্ষ থেকে যারা জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করত, তাদের সাথে উঠাবসা করা ও তাদেরকে ভালবাসা মাসিহ কোনরূপ দোষণীয় মনে করেন নি। [মথি ১১ : ১৯] এমনকি তিনি কর-আদায়কারী মথিকে তার বার শিষ্যের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। [মথি ৯ : ৯]
নিউ-টেস্টামেন্টের মতে বাদশাহদেরকে জিযয়াহ্‌ প্রদান করা একটি বৈধ অধিকার; বরং এটাকে পবিত্র এবং  ধর্মীয় কাজ মনে করা হয়েছে। যেমন পল বলেন : ‘প্রত্যেকের উচিত বাদশাহর অধীনতা মেনে নেওয়া, … কারণ বাদশাহি ও ক্ষমতা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত। যে কেউ এ-বিধানকে অস্বীকার করে, সে আল্লাহ্‌ যা নিয়োগ করেছেন তার বিরোধিতা করে। আর যারা তেমন বিরোধিতা করে, তারা নিজেদের উপর শাস্তি অবধারিত করে। … কারণ, সে আল্লাহর প্রতিনিধি; যে খারাপ কর্ম করে, তার থেকে ক্রোধের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। সুতরাং তার অধীনতা মেনে নেয়া আবশ্যক, শুধু ক্রোধের ভয়ে নয়, বরং সদ্বিবেকের খাতিরেই তার অধীনতা মেনে নেয়া আবশ্যক। এ জন্য তোমরা তাকে জিযয়াহ্ও প্রদান করে থাক, কারণ তারা আল্লাহর নিযুক্ত সেবক, তাদের উপর প্রদত্ত কাজই তারা করে যায়। অতএব যার যা প্রাপ্য, তা তাকে দাও; যাকে জিযয়াহ্‌ দিতে হয়, তাকে জিযয়াহ্‌ প্রদান কর; যাকে কর দিতে হয়, তাকে কর প্রদান কর; যাকে ভয় করা উচিত তাকে ভয় কর; যাকে সম্মান করতে হয়, তাকে সম্মান কর।’ [রোমীয় ১৩ : ১-৭]
তৃতীয়ত : ইসলামে জিযয়াহ্‌র বিধান :
ইসলাম সহজ ও সরল একটি দীন, এ দীন সকলের অধিকার যথাযথ সংরক্ষণ করেছে এবং সবাইকে তার ন্যায্য অধিকার প্রদান করেছে, কি মুসলিম কি অমুসলিম কারো উপরই সে অনৈতিক কিছু চাপিয়ে দেয় নি, বরং পূর্বের দীনে বিদ্যমান কঠিন ও কষ্টকর বিধানগুলো সংস্কার ও পরিশুদ্ধ করে মানব জাতিকে উন্নত ও পরিমার্জিত করেছে। এটাই তার স্বাভাবিক রীতি ও বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের আলোকে ইসলাম জিযয়াহ্‌ প্রথার মধ্যেও সংশোধনী এনেছে, তা শুধু করের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে নি, যা পরাজিতরা বিজয়ীদের প্রদান করে, বরং তাকে একটি চুক্তিতে রূপান্তরিত করেছে, যা মুসলিম এবং তাদের অধীনতা স্বীকারকারী সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পাদিত হয়। এটা উভয়পক্ষের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি, যা রক্ষা করা এবং যার প্রতি সম্মান দেখানোর নির্দেশ আল্লাহ তা‘আলা দিয়েছেন, যারা তা ভঙ্গ করে ও তার অধিকার বিনষ্ট করে তাদের প্রতি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। ইসলামের দেয়া ‘আহলে যিম্মাহ’ পরিভাষার ফলে তা আরও স্পষ্ট হয়, কারণ এ যিম্মাহ ভঙ্গ করা হারাম, পূর্ণ করা ওয়াজিব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ যিম্মাহ সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। অধিকন্তু যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম, কেবল তাদের উপরই জিযয়াহ্‌ আরোপ করা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
‘তোমরা লড়াই কর আহলে কিতাবের সেসব লোকের সাথে যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম মনে করে না, আর সত্য দীন গ্রহণ করে না, যতক্ষণ না তারা স্বহস্তে নত হয়ে জিযয়াহ্‌ দেয়।’ [সূরা আত-তাওবাহ্ : ২৯]
ইমাম কুরতুবি বলেছেন : ‘আমাদের আলেমগণ বলেছেন : কুরআনের ভাষ্যমতে তাদের থেকেই জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করা হবে, যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম। এ ব্যাপারে সকল আলেম একমত যে, জিযয়াহ্‌ শুধু স্বাধীন সাবালক পুরুষ থেকে গ্রহণ করা হবে, অর্থাৎ যারা যুদ্ধ করতে সক্ষম। নারী, বাচ্চা, দাস, পাগল ও খুব বৃদ্ধ ব্যক্তি থেকে জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করা যাবে না।[2]’
ওমর রা. সেনা প্রধানদের নিকট এ মর্মে নির্দেশ জারি করেন : ‘নারী ও বাচ্চাদের উপর জিযয়াহ্‌ নির্ধারণ করবে না, যারা সাবালক হয়েছে একমাত্র তাদের উপরই জিযয়াহ্‌ নির্ধারণ করবে।[3]’
আবার জিযয়াহ্‌র পরিমাণও এতো বেশি ছিল না যে, পুরুষরা তা আদায় করতে অক্ষম, বরং তা খুবই কম ও সহজ ছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে যার পরিমাণ বাৎসরিক এক দিনারের বেশি ছিল না। উমাইয়া খিলাফতকালে যার পরিমাণ ছিল বাৎসরিক চার দিনার।
ইয়ামানে প্রেরিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিনিধি মু‘আয রা. প্রত্যেক সাবালক থেকে এক দিনার করে জিযয়াহ্‌ গ্রহণ করেন। তিনি বলেন : ‘ইয়ামানে প্রেরণকালে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেন : ত্রিশটি গরু থেকে একটি এক বছরের বাছুর এবং চল্লিশটি গরু থেকে একটি দুই বছরের বাছুর গ্রহণ করবে। (উল্লেখ্য, মুসলিমদের উপর নির্ধারিত যাকাতের পরিমাণও তাই) আর প্রত্যেক সাবালকের উপর এক দিনার অথবা তার সমপরিমাণ কাপড় জিযয়াহ্‌ আরোপ করার নির্দেশ দিয়েছেন’।[4]
ওমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে স্বর্ণকারদের উপর চার দিনার এবং রৌপ্যকারদের উপর চল্লিশ দিরহাম জিযয়াহ্‌ ধার্য ছিল, এর সাথে ছিল মুসলিমদের উপর সদকা করা এবং কমপক্ষে তিন দিন তাদের মেহমানদারি করা’।[5]

১ আল-জামেউ লি আহকামিল কুরআন : (৮/১১৪), আল-মুগরিব ফি তারতিবিল মু‘রিব : (১/১৪৩), দেখুন মুখতারুস সিহাহ : (১/৪৪)
[2] আল-জামে লি আহকামিল কুরআন : (৮/৭২)
[3] দেখুন : ইরওয়াউল গালিল, হাদিস নং : (১২৫৫)
[4] তিরমিযি : হাদিস নং : (৬২৩), আবু দাউদ : হাদিস নং : (১৫৭৬), নাসায়ি : হাদিস নং : (২৪৫০), সহিহ তিরমিযিতে আলবানি হাদিসটি সহিহ বলেছেন।
[5] মিশকাতুল মাসাবিহ : হাদিস নং : (৩৯৭০), আল-বানি হাদিসটি সহিহ বলেছেন।

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন