ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
ইতিহাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

আযান যেভাবে শুরু হল…


আযান একটি আহ্বান, প্রতিদিন আমরা পাঁচবার শ্রবণ করি। তার ধ্বনি আমাদের অন্তরসমূহকে নাড়া দেয়। আমাদের জীবন্ত করে তুলে, অলসতা দূর করে, উদ্দামতা আনয়ন করে। নিশ্চয় এটা ইসলামের নিদর্শন, তাওহীদের আলামত। আল্লাহ কি চান ? এ প্রশ্নের উত্তর যে জানতে চায়, সে যেন আযানের অর্থ নিয়ে চিন্তা করে। এটা সত্যের আহবান। এ হচ্ছে মুসলমানদের আযান !
আমরা এর ঘটনা জানি ? আমরা জানি কিভাবে আমাদের কাছে এসেছে এ আযান ? কিভাবে মুসলমান এর সন্ধান পেয়েছে ? এবং কিভাবে পৌঁছতে পেরেছে মুসলমানগণ আযান পর্যন্ত ? এ এমন কতগুলো প্রশ্ন যা আযান প্রেমিক প্রত্যেকটি মানুষের জানা জরুরী। এ আযানের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে অন্য জাতির চেয়ে আলাদা বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছেন। এর জন্য তিনি আমাদেরকে মনোনিত করেছেন, একে তিনি আমাদের আলামত বানিয়েছেন।

ইসলামের শুরুতে সালাতের সময় হলে মুসলমানেরা নিজের পক্ষ থেকে মসজিদে এসে উপস্থিত হত। আযান, আহবান বা অন্য কোন মাধ্যমে ডাকাডাকি ছাড়াই। ইবনে ওমর রাদিআলাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন :
“মুসলমানগণ যখন মদীনায় আগমন করে জড়ো হতেন, সালাতের সময়ের প্রতীক্ষা করতেন। তখন সালাতের জন্য ডাকাডাকি হতো না। একদিন তারা এ নিয়ে আলোচনা করলেন। কেউ বলল : তোমরা নাসারাদের ন্যায় ঘণ্টার অনুসরণ কর। কেউ বলল না, বরং হর্ন গ্রহণ কর, ইহুদিদের শিঙ্গার ন্যায়। ওমর রাদিআলাহু আনহু বললেন : একজন লোক পাঠান, সে সালাত সালাত বলে ঘোষণা দেবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “ হে বেলাল, তুমি দাঁড়াও, অতঃপর সালাতের ঘোষণা দাও।” {বোখারি : (৫৭৯), মুসলিম : (৩৭৭) }
ইবনে খুজাইমা রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় গ্রন্থে এ শিরোনামে এক অধ্যায়ের সূচনা করেছেন : “এ অধ্যায়ের দলিলের বর্ণনা যে, আযানের প্রচলন হয়েছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনায় হিজরতের পর। তিনি মক্কায় সালাত আদায় করতেন আযান ও ইকামাত ছাড়াই।” সহিহ ইবনে খুজাইমা : (১/১৮৯)
ইবনে ইসহাক রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন : “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করেন, তখন লোকেরা কোন আহবান ছাড়াই তার নিকট সময় মত সালাতের জন্য উপস্থিত হতো।” শায়খ আলবানী বলেছেন : এর সনদটি হাসান। দেখুন : ফিকহুস সীরাহ : (১/১৮১)
তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক মহান চিন্তা ছিল, মানুষদের কিভাবে সালাতের জন্য উপস্থিত করা হবে ? অবশেষে আল্লাহর বিধান চলে আসে। আবু উমাইর বিন আনাস তার কোন আনসারী চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন :
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সালাতের বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করলেন, এ জন্য তিনি কিভাবে মানুষদের জমায়েত করবেন ? তাকে বলা হলো : যখন সালাতের সময় হবে একটি পতাকা উত্তোলন করবেন, এ পতাকা দেখে একে অপরকে আহবান করবে। এ উত্তরে তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। অতঃপর তার কাছে হর্ন বাজানোর কথা বলা হলো। পূর্বের উল্লিখিত বোখারির বর্ণনায় যেরূপ রয়েছে। জিয়াদ বললেন : ইহুদিদের হর্ন। এ উত্তরেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি বললেন : এটা ইহুদীদের কর্ম । অতঃপর তাকে ঘণ্টার কথা বলা হলো। তিনি বললেন : এটা নাসারাদের কর্ম।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ চিন্তায় গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ বিন আবদে রাব্বিহি বাড়ি ফিরলেন, তাকে স্বপ্নে আযান দেখানো হলো। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে গমন করলেন এবং তাকে আযান বিষয়ে স্বপ্ন সম্পর্কে সংবাদ দিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন : হে আল্লাহর রাসূল, অর্ধ ঘুম ও নিদ্রাবস্থায় ছিলাম, আমার কাছে এক আগমনকারী আসল অতঃপর আমাকে আযান দেখালো। তিনি বলেন : ওমরও তার পূর্বে এ স্বপ্ন দেখেছে, তিনি তা বিশ দিন গোপন রাখেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানান। তিনি বললেন : “তুমি আমাকে কেন সংবাদ দাওনি ?” বললেন : আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ আমার আগে বলে ফেলেছে, তাই আমার বলতে লজ্জা বোধ হলো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “ হে বেলাল, দাঁড়াও, দেখ আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ কি বলে, তুমি তার অনুসরণ কর।” তিনি বললেন : অতঃপর বেলাল আযান দিল। আবু বিশর বলেন : আবু উমাইর আমাকে বলেছে, আনসারগণের ধারণা, সেদিন যদি আব্দুলাহ বিন জায়েদ অসুস্থ না হতেন, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম তাকেই মুয়ায্যিন বানাতেন।” আবু দাউদ : (৪৯৮), সহীহ আবু দাউদ লিল আলবানী: (৪৬৮)
এ স্বপ্নের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রভূত আনন্দিত হন এবং আল্লাহর প্রশংসা করেন, যেরূপ অন্যান্য বর্ণনায় এসেছে। ওমর রাদিআলাহু আনহু যখন বেলালের মুখে আযানের ধ্বনি শুনলেন, চাদর হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে উপস্থিত হলেন। আর বললেন : হে রাসূল, যে আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ, সে যেরূপ বলেছে আমিও অনুরূপ দেখেছি। তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “সকল প্রশংসা আল্লাহর।” আবু দাউদ : (৪৯৯), শায়খ আলবানী হাদীসটি সহিহ বলেছেন : সহিহ আবু দাউদ : (৪৬৯)
অন্য বর্ণনায় হুবহু আযানের শব্দও বর্ণনা করা হয়েছে। মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহ বিন জায়েদ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন : “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হর্ণের ব্যাপারে চিন্তা করছিলেন এবং ঘন্টার নির্দেশ দিয়েছেন। আমি তার কাছ থেকে চলে গেলাম। অতঃপর আব্দুল্লাহকে সপ্নে দেখানো হলো। তিনি বলেন : আমি এক ব্যক্তিকে দেখলাম দুটি হলুদ জামা গায়ে একটি ঘণ্টা নিয়ে দাঁড়ানো। আমি তাকে বললাম : হে আল্লাহর বান্দা, তুমি কি ঘণ্টা বিক্রি করবে? সে বলল: তুমি এর দ্বারা কি করবে ? আমি বললাম : সালাতের জন্য আহবান করবো। সে বলল : আমি কি তোমাকে এর চেয়ে উত্তম জিনিসের কথা বলবো না ? আমি বললাম : তা আবার কি ? সে বলল : তুমি বলবে : {আযানের শব্দাবলি}

তিনি বলেন : আব্দুল্লাহ বের হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসলেন, অতঃপর স্বপ্ন সম্পর্কে অবহিত করলেন। বললেন : হে আল্লাহর রাসূল, আমি দেখলাম হলুদ জামা গায়ে এক ব্যক্তি একটি ঘণ্টা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর তাকে সপ্নের বিবরণ শোনালেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন : “ তোমাদের ভাই একটি স্বপ্ন দেখেছে, তুমি বেলালের সাথে মসজিদে যাও, তার কাছে গিয়ে বল, এবং বেলাল যেন এ শব্দ দ্বারা আহবান করে, কারণ তার আওয়াজ তোমার চেয়ে উচ্চ।” তিনি বলেন : আমি বেলালের সাথে মসজিদে গেলাম, অতঃপর আমি তার কাছে বলতে লাগলাম, সে তার মাধ্যমে সালাতের আহবান জানাতে লাগল।
সে বলল : ওমর ইবনে খাত্তাব আওয়াজ শোনে বের হয়ে আসলেন, বললেন : হে আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর শপথ, সে যেরূপ দেখেছে আমিও অনুরূপ দেখেছি। অতঃপর আবু উবাইদ বলেন, আবু বকর হিকমী আমাকে বলেছে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে জায়েদ আনসারী এ সম্পকের্ বলেছেন :
অর্থ : {আযানের জন্য আমি আল্লাহর অনেক প্রশংসা করছি, যিনি বড়ত্বের ও সম্মানের অধিকারী। যখন আমার কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এ নিয়ে সুসংবাদ দাতা আসল, তিনি আমাকে এর মাধ্যমে সুসংবাদ দাতা হিসিবে সম্মানিত করেন। লাগাতার তিন রাতে তিনি আমার কাছে আসেন, যখনই তিনি আসেন আমার সম্মান বৃদ্ধি করেন।}”
ইবনে মাজাহ : (৭০৬), শায়খ আলবানী হাদীসটি হাসান বলেছেন : সহিহ ইবনে মাজাহ : (৫৮০),

আর (আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম) এর সংযোজন হয়েছে বেলাল রাদিআল্লাহু আনহু এর পক্ষ থেকে।অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুমতি প্রদান করেন।
বেলাল রাদিআলাহু আনহু থেকে বর্ণিত, “তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সালাতের সংবাদ দিতে আসেন, অতঃপর তাকে বলা হয়, তিনি ঘুমন্ত। ফলে তিনি বলেন :
(আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম , আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম)

এরপর থেকে ফজরের আযানে এটা প্রচলিত হয়।” ইবনে মাজাহ : (৭১৬), শায়খ আলবানী হাদীসটি সহিহ বলেছেন : সহিহ ইবনে মাজাহ : (৫৮৬)
এর মাধ্যমেই আমরা আযানের ঘটনা জানতে পারলাম, যা এখনো আমাদের কর্ণসমূহ আন্দোলিত করে। এটা মহান নিআমত, আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই, তিনি এর শোকর আদায় করার তাওফীক দান করুন। এবং আযান যেন আমাদের জন্য সংরক্ষণ করেন, যেন আমরা এর মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিম জয় করতে সক্ষম হই। সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য নিবেদিত।

একটি মোমবাতির কাহিনী

মোমের আলোয় কাজ করছিলেন খলিফা উমর রাযিআল্লাহু আনহু । এমন সময় সেখানে আসলেন তার দুই আত্মীয় । খলিফা তাড়াতাড়ি ফুঁ দিয়ে মোমবাতিটি নিভিয়ে দিলেন । অন্য আরেকটি মোমবাতি ধরিয়ে অতিথিদের বসতে দিয়ে তাদের খোজখবর নিলেন ।

কৌতুহল চাপতে না পেরে একজন জানতে চাইলেন , আমাদের দেখে কেন আপনি আগের মোমবাতি নেভালেন আর নতুন একটি জ্বালালেন ? খলিফা জবাব দিলেন : আগের মোমবাতি ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি থেকে কেনা । তোমরা যেহেতু আমার আত্মীয় , তাই তোমাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত অনেক আলাপ হবে । আমার নিজের কাজে জনগণের আমানত থেকে আমি কিছু খরচ করতে পারি না । তাহলে আল্লাহর দরবারে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে । তাই নিজের টাকায় কেনা মোমবাতিটি তোমাদের দেখে জ্বালালাম ।
এই জবাবে আত্মীয়রা হতভম্ব হলেন । তারা এসেছিলেন আত্মীয়তার খাতিরে বিশেষ কোন সুবিধা পাওয়া যায় কি না , সেই অনুরোধ করতে । কিন্ত্ত সামান্য মোমবাতি নিয়ে খলিফার এত বিবেচনা ও সতর্কতা দেখে নিজেদের প্রস্তাব জানাতে তারা আর সাহসই করলেন না ।

আরেকবার খলিফার কাছে এক লোক অবৈধ সুবিধা চায় । খলিফার সামনে রাখা কিছু কাঠে তখন আগুন জ্বলছিল। খলিফা বললেন , ঠিক আছে । তুমি এই আগুনের ভিতর তোমার হাত কিছু সময়ের জন্য রাখো ; তারপর তোমার অনুরোধ আমি বিবেচনা করবো । লোকটি ভয় পেয়ে বললো , হে খলিফা ; এই আগুনে হাত ঢুকালে আমার হাত তো জ্বলে যাবে । খলিফা বললেন , তুমি দুনিয়ার এই সামান্য আগুনকে ভয় পাচ্ছ অথচ আমাকে তুমি দোযখের অনন্ত আগুনের ভিতরে নিয়ে যেতে চাও ? তদবিরকারী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে যায়।

কোরআনে ভবিষ্যৎবাণী – হারুন হায়াহিয়া

মক্কা বিজয়ঃ
এমন কিছু গুর
ত্বপূর্ণ ঘটনার কথা কোরআন আগেই প্রকাশ করে যেগুলো পরে ভবিষ্যতে সত্যি সত্যি ঘটেছিল এটিও কোরআনের অলৌকিকত্বের একটি দিক। উদাহরণ স্বরূপ সূরা ফাতহ্ এর ২৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের এই সুসংবাদ দেন যে তখনকার দিনে পৌত্তলিকদের দখলকৃত মক্কা অচিরেই মুসলমানেরা জয় করে নেবে :
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বাস্তবায়িত করে দেখিয়েছেন স্বপ্নটি যথাযথভাবে। অবশ্যই তোমরা আল্লাহর ই‪ছায় মসজিদে হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে, তখন তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ মাথা মুড়াতে থাকবে এবং কেউ কেউ চুল কাটতে থাকবে। তোমাদের কোন প্রকার ভয় থাকবে না । আল্লাহ জানেন যা তোমরা জান না। আর তিনি তোমাদেরকে এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত পূর্বে এক আশু বিজয় দিলেন।“(কোরআন, ৪৮ : ২৭)

আরো গভীরভাবে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, আয়াতটি কিন্তু মক্কা বিজয়ের পূর্বে আরেকটি বিজয়ের সংবাদ ঘোষণা করে। বাস্তবিকই মুসলমানরা আয়াতটির ঘোষণার মতোই মক্কা বিজয়ের পূর্বে প্রথমে ইহূদিদের দখলকৃত খাইবার দুর্গ দখল করে নেয় এবং তারপর মক্কায় প্রবেশ করে।যে ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে ঘটবে, আগে ভাগেই এদের ঘোষণা করা কোরআনের প্রাজ্ঞতার এক টুকরা উদাহরণ মাত্র। কোরআনের কথা যে অসীম জ্ঞানবান আল্লাহরই বাণী এই সাক্ষ্যও দি‪চ্ছে এই ব্যাপারটি।
বাইজেন্টাইনের পরাজয়ের কথা ভবিষ্যতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য ঘটনার মতো একটি যা কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছিল যেগুলো সে সময়কার মানুষের পক্ষে কোন ভাবেই জানা সম্ভব ছিল না। এই ঘটনার সবচাইতে কৌতহলের ব্যাপারটি এই যে রোমানরা পৃথিবীর সবচাইতে নিম্নতম অঞ্চলে পরাজয় বরণ করে ছিল পরবর্তী পাতায় ব্যাপারটি বিস্তারিত বর্ণনা করা হবে। এটি মজার যে এখানে “সর্বনিম্ন পয়েন্টের” কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সে আমলের প্রযুক্তি দিয়ে এমন একটি মাপযোখ করে পৃথিবীর নিম্নতম অঞ্চল নির্ধারণ একেবারে স্পষ্টভাবেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। এসবই মানব জাতির উদ্দেশ্যে মহাজ্ঞানী আল্লাহ সোবহানাল্লাহ তাআলার প্রকাশিত বাণী।
বাইজেন্টাইনদের বিজয়ঃ
কোরআন নাযিলের আরেকটি আশ্চর্য ঘটনা এই যে সূরা রূমের প্রথম আয়াতে বাইজেন্টাইন সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করা হয়েছে। পরবর্তী রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের একটি অংশই হলো বাইজেন্টাইন।উক্ত আয়াতগুলোতে উল্লেখ করা হয় যে, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য একটি পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু শীঘ্রই জয়ের মুখ দেখবে।
“আলিফ-লাম-মীম রোমকরা পরাজিত হয়েছে, এক নিম্নতমস্থানে এবং তারা তাদের এ পরাজয়ের পর অতি সত্বর জয়লাভ করবে, তিন থেকে নয় বছরের মধ্যে। পূর্বের ও পরের ফয়সালা আল্লাহরই। আর সেদিন মুমিনরা আনন্দিত হবে।”(কোরআন, ৩০:১-৪)

পৌত্তলিক পারস্যদের হাতে বাইজেন্টাইন খৃষ্টানদের গুর
তর পরাজয় বরণ করার ৭ বছর পরে, ৬২০ সনে উক্ত আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল। বাইজেন্টাইনরা খুব অল্প সময়ের মাঝেই বিজয় ছিনিয়ে নেবে।আয়াতগুলোতে তাই বর্ণিত হয়েছিল। সত্যি বলতে কি, বাইজেন্টাইনরা কেবল মারাত্মক পরাজয়ই বরণ করেনি, এমনকি এটির টিকে থাকাই যেখানে অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছিল সেখানে জিতার কথা বাদই দিতে হয়। কেবল পারস্যরাই নয়, মারাত্মক ভীতির কারণ হিসেবে আরও বিদ্যমান ছিল আভারস আর লম্বার্ডরা। আভারস্ কন্সটান্টিনোপোলের দেয়াল পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস গির্জাসমূহের স্বর্ণ, রৌপ্যগুলো গলিয়ে মুদ্রা বানিয়ে তার বাহিনীদের খরচ মেটানোর আদেশ দিলেন। এগুলোও যখন অপর্যাপ্ত মনে হলো তখন এমনকি ব্রোঞ্জের মূর্তিগুলো গলিয়ে মূদ্রা বানানো হলো। বহু গভর্ণর হেরাক্লিয়াসের বির
দ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল আর তার সাম্রাজ্য ছিল পতনের মুখে। আগের বাইজেন্টাইনের অধীনস্ত রাষ্ট্র, যেমন, মেসোপটেমিয়া, সিলিসিয়া, সিরিয়া, পেলেস্টাইন, মিসর, আর্মেনিয়া তখন মূর্তিপূজক পারস্যদের অধীনস্ত হয়ে গিয়েছিল।
স্বল্প কথায় সকলেই মনে করছিল যে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। ঠিক সেই মুহূর্তে সূরা রূমের প্রথম কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়, যাতে ঘোষিত হয়েছিল যে, কয়েক বছরের মাথায় বাইজেন্টাইনরা বিজয় ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু বিজয় তখন এমনি অসম্ভব ছিল যে, বহু-ঈশ্বরবাদী আরবরা আয়াত কয়টি নিয়ে পরিহাস শুরু করে দিল। তারা ভেবেছিল যে কোরআনের এই বিজয়ের ঘটনা কখনও সত্যি হবে না।
সূরা রূমের প্রথম আয়াতখানা নাযিলের সাত বছর পরে ৬২৭ সনের ডিসেম্বরে বাইজেন্টাইন আর পারস্যদের মাঝে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধ শুর
 হল নিনেভেহতে। এই সময় আশাতীতভাবে বাইজেন্টাইনরা পারস্যদের পরাজিত করল। কয়েক মাস পরে পারস্যরা বাইজেন্টাইনদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হল, যারই ফলে তাদেরকে নিজেদের দখল করা অংশগুলো হতে হটতে বাধ্য হয়েছিল।অবশেষে আল্লাহ তাআলার ঘোষণাকৃত ”রোমকদের বিজয়” বাণীটি অলৌকিকভাবে সত্য হয়ে গিয়েছিল।
উক্ত আয়াতটির আরেকটি অলৌকিক বিষয় হলো ভৌগলিক বিষয় সম্বন্ধে একটি ঘোষণা যা তখনকার মানুষের পক্ষে জানতে পারা সম্ভব ছিল না।সূরা রূমের তৃতীয় আয়াতে আমরা অবগত হই যে, রোমানরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্ন এলাকায় পরাজিত হয়েছে। “আদনা আল আরব” এই অভিব্যক্তিটি বহু অনুবাদে “পাশ্ববর্তী স্থান” হিসেবে অনূদিত হয়েছে। কিন্তু এটি মূল বক্তব্যের আক্ষরিক অর্থ না হয়ে বরং আলঙ্করিক অর্থ প্রকাশ করেছে।আরবীতে “আদনা” শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে “দেনি” শব্দ থেকে যার মানে হলো “নীচু”, আর “আরদ্” শব্দের অর্থ পৃথিবী। তাই “আদনা আল আরদ্” এর প্রকাশ ভঙ্গীটির অর্থ হলো “পৃথিবীর নিম্নতম এলাকা”।
সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় হলো বাইজেন্টাইন আর পারস্যের যে যুদ্ধে বাইজেন্টাইনদের পরাজয় হয় আর ফলে তারা জের
জালেমের উপর অধিকার হারিয়ে ফেলে সেই যুদ্ধেরই একটি অতি সংকটপূর্ণ পর্যায় সত্যি ঘটেছিল পৃথিবীর একটি নিম্নতম এলাকায়। বিশেষ এই এলাকাটি হলো মৃত সাগরের বেসিন বা গহ্বরে যা কিনা সিরিয়া, পেলেস্টাইন আর জর্দানের ভূ-ভাগের ছেদন বিন্দুতে বিদ্যমান।সমুদ্র পৃষ্ঠের ৩৯৫ মিটার নিম্নের এই মৃত সাগরটি আসলেই ভূ-পৃষ্ঠের সর্বনিম্নাঞ্চল। তার মানে হলো যে কোরআনে যেমন উক্ত রয়েছে ঠিক তেমনভাবেই বাইজেন্টাইনরা বিশ্বের সর্বনিম্ন এলাকায় হেরে গিয়েছিল।
মজার ব্যাপারটি হলো এই যে, কেবল মাত্র আধুনিককালের পরিমাপক প্রযুক্তি দিয়েই মৃত সাগরের গভীরতা মাপা যেতে পারে। এর আগে পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন এলাকাটি কোথায় বা কোনটি তা জানা সম্ভব ছিল না। কিন্তু কোরআনে উক্ত হয়েছে যে এ এটি পৃথিবীর সর্বনিম্ন এলাকা। এ ব্যাপারটি আবারো সাক্ষ্য দি‪চ্ছে যে কোরআন মহান সৃষ্টি কর্তার প্রেরিত গ্রন্থ।

কোরআনের ঐতিহাসিক অলৌকিকতা -হারুন ইয়াহিয়া

কোরআনে “হামান” শব্দ:
প্রাচীন মিসর সম্পর্কে কোরআনের কিছু তথ্য বহুল ঐতিহাসিক বিষয় উন্মোচিত করে যেগুলো কিনা সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অনুদঘাটিত ছিল। এই বিষয়গুলো আমাদের আরো নির্দেশ করছে যে এ কোরআন এক নিশ্চিৎ মহাবিজ্ঞের পক্ষ থেকে নাযিল হয়েছে।কোরআনে ফেরাউনের পাশাপাশি হামান নামক একটি চরিত্রের উল্লেখ রয়েছে। ফেরাউনের একজন কাছের মানুষ হিসেবে এ নামটি কোরআন শরীফের ছয়টি ভিন্ন অংশে উক্ত হয়েছে।আশ্চর্যের বিষয় যে, তাওরাতের যে অংশে মূসার জীবনী রয়েছে, তাতে এ নামটি কখনো উল্লেখ করা হয়নি। তবে ওল্ড টেষ্টামেন্টের সর্বশেষ অধ্যায়ে ব্যাবিলনের এক রাজার সাহায্যকারী হিসেবে এ নামটি পাওয়া যায়, যে রাজা কি-না মূসার সময়ের ১১০০ বছর পরে ইসরাঈলীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছিল।

কিছু অমুসলিম, যারা দাবী করে যে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) তাওরাত এবং বাইবেল থেকে নকল করে কোরআন শরীফ সাজিয়েছেন, তারা জোর গলায় বলে যে, এ প্রক্রিয়ার সময় নবী (দঃ) কিছু কিছু বিষয়ে ত্রু
টি সহকারে কোরআনে এনেছেন।কিন্তু ২০০ বছর আগে যখন মিসরীয় প্রাচীন সংকেত লিপি হাইআরোগ্লিফিক উদঘাটন করে বুঝা গেল আর প্রাচীন লিপিগুলোয় হামান শব্দটির উল্লেখ রয়েছে জানা গেল তখন এই দাবির অসারতা প্রমাণিত হলো।এই আবিষ্কারের আগে প্রাচীন মিসরীয় লিখা আর অভিলিখন (শিলার গায়ে লিখা) বুঝা যেতো না।হাইআরোগ্লিফিক বা সংকেত লিখনে লিখা প্রাচীন মিসরীয় ভাষা যুগ যুগ টিকে ছিল। তবে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দিতে খৃষ্টান ধর্ম প্রচার আর অন্যান্য সংস্কৃতির প্রসারের ফলে মিসরীয়রা প্রাচীন বিশ্বাস আর হাইআরোগ্লিফিক বা সংকেত লিপি ভুলে যায়। সংকেত লিখনের সর্বশেষ জানা উদাহরণটি ৩৯৪ সনের একটি অভিলিখন ছিল। এরপর এ ভাষাটি স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছিল, আর কেউ তা লিখতে বা বুঝতে পারতো না। ২০০ বছর আগে পর্যন্ত এ অবস্থাটি বিদ্যমান ছিল।১৭৯৯ সনে “Rosetta Stone” নামের একটি ট্যাবলেট বা লিপিফলক আবিষ্কারের ফলে প্রাচীন মিসরীয় সংকেতলিপি বা হাইআরোগ্লিফিক এর রহস্যের সন্ধান পাওয়া গেল ; ফলকটি ছিল খ্রীষ্টের জন্মের ১৯৬ বছর আগের। এই অভিলিখন খানির গুর
ত্ব এমনি ছিল যে, এটি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে লিখা ছিল ; উপায়গুলো ছিল হাইআরোগ্লিফিক, ডেমোটিক (প্রাচীন মিসরীয় হাইআরেটিক লিখনের সহজরূপ) আর গ্রীক । গ্রীক লিখনটির সাহায্য নিয়ে প্রাচীন মিসরীয় সংকেত লিখনগুলোর অর্থ বের করা হলো ।
Jean-Francoise Chamollion নামের একজন ফরাসী লোকের সহায়তায় লিপিখানির অনুবাদ সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। এভাবে এই ভুলে যাওয়া ভাষা এবং এর সঙ্গে জড়িত কিছু ঘটনার প্রকাশ ঘটল।এমন করে প্রাচীন মিসরের সভ্যতা, ধর্ম আর সমাজ জীবনের বিশাল এক জ্ঞানের খোঁজ পাওয়া গেল। হাইআরোগ্লিফিক এর সংকেতগুলোর গূঢ়ার্থ বুঝতে পারায় গুরু
ত্বপূর্ণ জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া গেল ,বাস্তবিকই ”হামান” শব্দটি মিসরীয় সংকেতলিপিতে লিখা ছিল। ভিয়েনার Hof Museum এ নামটির উল্লেখ রয়েছে।সমগ্র অভিলিখনগুলোর সংগ্রহের উপর নির্ভর করে তৈরী অভিধান People in the New Kingdom এ হামানকে “পাথর চূর্ণকারীদের নেতা” হিসেবে পরিচয় দেয়া হয়েছে।ফলাফলটি একটি অত্যন্ত গুর
ত্বপূর্ণ সত্যের উন্মোচন করে দিল। কোরআন বিরোধীদের মিথ্যা দাবীর বিপরীতে দেখা গেল এই সেই ব্যক্তি হামান, যে কিনা মূসার (আঃ) সময়কালে ফেরাউনের একজন অতি কাছের মানুষ হিসেবে মিসরে বসবাস করে আসছিল। কোরআনে যেমন বলা হয়েছে ঠিক তেমনি, হামান নির্মাণ কাজে নিয়োজিত ছিল।অধিকন্তু কোরআনের একটি আয়াতে একটি ঘটনায় যেমন উক্ত আছে যে ফেরাউন হামানকে একটি টাওয়ার নির্মাণের কথা বলছে, সেটি প্রত্নতত্ত্ববিদদের প্রাপ্ত তথ্যাবলীগুলোর সঙ্গে একদম মিলে যায় :


“ফেরাউন বলল : হে সভাসদবৃন্দ ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন উপাস্য আছে বলে আমি মনে করি না। হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও, তারপর আমার জন্য একটি সুউ‪চ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মূসার মা’বুদের প্রতি উঁকি মেরে দেখতে পারি। তবে আমারতো ধারণা যে, সে অবশ্যই মিথ্যাবাদী।“
(কোরআন, ২৮ : ৩৮)
পরিশেষে, হামানের অস্তিত্ত্বের বিষয়টি কোরআন বিরোধীদের বানোয়াট জাল দাবিকেই শুধু গুর
ত্বহীন বলে প্রমাণ করেনি, বরং আবারো একবার প্রমাণ করে দিল যে, কোরআন এসেছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর তরফ থেকে। একরকম অলৌকিকভাবেই কোরআন সেই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছে যা নবীর (দঃ) সময়ে ঘটেনি কিংবা জানা ছিল না।
কোরআনে মিসরের শাসকগণের উপাধি:
মিসরের প্রাচীন ইতিহাস ঘেঁটে এ তথ্যই বেরিয়ে আসে যে, সে অঞ্চলে মুসা (আঃ) ই একমাত্র নবী হয়ে আসেননি। মুসার (আঃ) সময়ের বহু আগে ইউসুফ (আঃ) মিসরে বসবাস করে গেছেন।মুসা (আঃ) এবং ইউসুফ (আঃ) এ দুজনের ঘটনাবলী পড়তে গিয়ে আমরা কিছূ সাদৃশ্যের বা তুলনার মুখোমুখি হই। কোরআনে ইউসুফ (আঃ) এর সময়কার মিসরের শাসকদের সম্বোধন করতে গিয়ে মালিক শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

“মালিক (বাদশাহ) বলল : ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো, আমি তাকে আমার একান্ত সহচর করে রাখব।তারপর সে যখন তার সাথে কথা বলল তখন সে বলল ঃ নিশ্চয়ই আজ আপনি আমাদের কাছে অতিশয় মর্যাদাবান ও বিশ্বস্ত।“ (কোরআন, ১২ : ৫৪)
কিন্তু মুসার (আঃ) সময়ে শাসকদের ডাকা হতো “ফেরাউন ” ।
“আর আমি তো মূসাকে নয়টি প্রকাশ্য মু’জিযা দিয়েছিলাম, আপনি বনী ইসরাঈলকে জিজ্ঞেস করু
ন ; যখন সে তাদের কাছে এসেছিল তখন ফেরআউন তাকে বলেছিল : “হে মূসা!আমি তো মনে করি, অবশ্যই তুমি যাদুগ্রস্ত।“
(কোরআন, ১৭ : ১০১)
আজ যে সমস্ত ঐতিহাসিক রেকর্ড পাওয়া যা‪চ্ছে তাতে শাসকগণের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণের কারণ খুঁজে পাওয়া যা‪চ্ছে। পূর্বে প্রাচীন মিসরে রাজপ্রাসাদকে ”ফেরাউন” বলা হতো আর এখান থেকেই এসেছে এই শব্দটি। প্রাচীন রাজবংশের শাসকগণ তাদের উপাধি হিসেবে এই নামটি ব্যবহার করেননি। মিসরের ইতিহাসে ”নূতন রাজ্য” যুগের পূর্ব পর্যন্ত রাজাদের উপাধি হিসেবে এ নামটি শুরু হয়নি। এই সময়কালটি ১৮ তম রাজবংশের সঙ্গে শুরু
 হয় আর বিংশতম রাজবংশ থেকে রাজাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে এই ”ফেরাউন” শব্দটি টাইটেল হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
এখানে আরেকবার কোরআনের অলৌকিকত্ব প্রমাণের আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় : ইউসুফ (আঃ) প্রাচীন রাজত্বে বর্তমান ছিলেন যে যুগে রাজাদের ”ফেরাউন” নয় বরং ”মালিক” বলে সম্বোধন করা হতো। উল্টো যেহেতু মুসা (আঃ) নূতন রাজ্যের যুগে বর্তমান ছিলেন, তাই তখনকার শাসকদের ”ফেরাউন” নামে ডাকা হতো।সন্দেহ নেই যে এমন পৃথক করে বলার জন্য একজনকে মিসরের ইতিহাস জানতে হবে। কিন্রু চতুর্থ শতকের মাঝেই মিসরের ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায় মানুষ ; কারণ মানুষ আর মিসরের ভাষা (হাইআরোগ্লিফিক) বুঝতে পারেনি ; দীর্ঘদিন পর মিসরের ইতিহাস পুণরায় উনিশ শতকে উদ্ধার করা হয়। সুতরাং কোরআন নাযিল হওয়ার সময় মিসরের ইতিহাস সম্পর্কে কোন পুংখানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব ছিল না। অগণিত সাক্ষ্য-প্রমাণের মাঝে এটিও প্রমাণ করে যে কোরআন আল্লাহর বাণী।

ঈদে মিলাদুন্নবি কিভাবে এল?? পর্ব ২

  • সংকলন : প্রফেসর ড. খন্দকার আ.ন.ম আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর
  • সম্পাদক : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। সালাত ও সালাম মহান রাসূল, আল্লাহর হাবীব ও মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, তাঁর পরিবারবর্গ ও সঙ্গীদের উপর। আজকের বিশ্বে মুসলিম উম্মার অন্যতম উৎসবের দিন হচ্ছে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’। সারা বিশ্বের বহু মুসলিম অত্যন্ত জাঁকজমক, ভক্তি ও মর্যাদার সাথে আরবী বৎসরের ৩য় মাস রবিউল আউআল মাসের ১২ তারিখে এই ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ বা নবীর জন্মের ঈদ পালন করেন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলিমই এই ‘‘ঈদের’’ উৎপত্তি ও বিকাশের ইতিহাসের সাথে পরিচিত নন। যে সকল ব্যক্তিত্ব এই উৎসব মুসলিম উম্মার মধ্যে প্রচলন করেছিলেন তাঁদের পরিচয়ও আমাদের অধিকাংশের অজানা রয়েছে। এই নিবন্ধে আমি উপরোক্ত বিষয়গুলি আলোচনার চেষ্টা করব।


  • পূর্বকথা:রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মবার, জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে হাদীস ও ঐতিহাসিকদের মতামত জানতে পেরেছি। তাঁর জন্মদিন সম্পর্কে ইসলামের প্রথম যুগগুলির আলেম ও ঐতিহাসিকদের মতামতের বিভিন্নতা থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারছি যে, প্রথম যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন বা উদযাপন করার প্রচলন ছিল না। কারণ তাহলে এধরণের মতবিরোধের কোন সুযোগ থাকত না। মুহাদ্দিস, ফকিহ ও ঐতিহাসিকদের গবেষণা আমাদের এই অনুমানকে সত্য প্রমাণিত করছে।আমরা জানি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন বা রবিউল আউয়াল মাসে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ পালনের বৈধতা ও অবৈধতা নিয়ে আলেম সমাজে অনেক মতবিরোধ হয়েছে, তবে মীলাদুন্নবী উদযাপনের পক্ষের ও বিপক্ষের সকল আলেম ও গবেষক একমত যে, ইসলামের প্রথম শতাব্দিগুলিতে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন পালন করা বা উদযাপন করার কোন প্রচলন ছিল না। নবম হিজরী শতকের অন্যতম আলেম ও ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে হাজর আল-আসকালানী (মৃত্যু: ৮৫২হি: ১৪৪৯খ্রি:) লিখেছেন:
    ‘‘মাওলিদ পালন মূলত: বিদ‘আত। ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন শতাব্দীর সালফে সালেহীনদের কোন একজনও এ কাজ করেন নি।’’
    নবম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রখ্যাত মুদাদ্দিস ও ঐতিহাসিক আল্লামা আবুল খাইর মুহাম্মাদ ইবন আব্দুর রহমান আস-সাখাবী (মৃত্যু: ৯০২হি: ১৪৯৭খ্রি:) লিখেছেন:
    ‘‘ইসলামের সম্মানিত প্রথম তিন যুগের সালফে সালেহীনদের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের) কোন একজন থেকেও মাওলিদ পালনের কোন ঘটনা খুজে পাওয়া যায় না। মাওলিদ পালন বা উদযাপন পরবর্তী যুগে উদ্ভাবিত হয়েছে। এরপর থেকে সকল দেশের ও সকল বড় বড় শহরের মুসলিমগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মমাস পালন করে আসছেন। এ উপলক্ষ্যে তারা অত্যন্ত সুন্দর জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবময় খানাপিনার মাহফিলের আয়োজন করেন, এ মাসের রাত্রে তাঁরা বিভিন্ন রকমের দান-সদকা করেন, আনন্দপ্রকাশ করেন এবং জনকল্যাণমূলক কর্ম বেশী করে করেন। এ সময়ে তাঁরা তাঁর জন্মকাহিনী পাঠ করতে মনোনিবেশ করেন।’’

    লাহোরের প্রখ্যাত আলেম সাইয়েদ দিলদার আলী (১৯৩৫খ্রি:) মীলাদের সপক্ষে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন:
    ‘‘মীলাদের কোন আসল বা সুত্র প্রথম তিন যুগের (সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণ) কোন সালফে সালেহীন থেকে বর্ণিত হয় নি; বরং তাঁদের যুগের পরে এর উদ্ভাবন ঘটেছে।’’
    আলেমদের এই ঐক্যমতের কারণ হলো, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতাব্দীতে সংকলিত অর্ধশতাধিক সনদভিত্তিক হাদীসের গ্রন্থ, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কর্ম, আচার-আচরণ, কথা, অনুমোদন, আকৃতি, প্রকৃতি ইত্যাদি সংকলিত রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের মতামত ও কর্ম সংকলিত হয়েছে সে সকল গ্রন্থের একটিও সহীহ বা দুর্বল হাদীসে দেখা যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় বা তাঁর মৃত্যুর পরে কোন সাহাবী সামাজিকভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর জন্ম উদযাপন, জন্ম আলোচনা বা জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট কোন দিনে বা অনির্দিষ্টভাবে বৎসরের কোন সময়ে কোন অনুষ্ঠান করেছেন।
    সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামই ছিলেন তাঁদের সকল আলোচনা, সকল চিন্তা চেতনার প্রাণ, সকল কর্মকান্ডের মূল। তাঁরা রাহমাতুল্লিল আলামীনের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছেন, তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা আলোচনা করে তাঁর ভালবাসায় চোখের পানিতে বুক ভিজিয়েছেন। তাঁর আকৃতি, প্রকৃতি, পোষাক আশাকের কথা আলোচনা করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। কিন্তু তাঁরা কখনো তাঁর জন্মদিন পালন করেন নি। এমনকি তাঁর জন্মমুহুর্তের ঘটনাবলী আলোচনার জন্যও তাঁরা কখনো বসেন নি বা কোন দান-সাদকা, তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমেও কখনো তাঁর জন্ম উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করেন নি। তাঁদের পরে তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের অবস্থাও তাই ছিল।
    বস্ত্তত: কারো জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করার বিষয়টি আরবের মানুষের কাছে একেবারেই অজ্ঞাত ছিল। জন্মদিন পালন ‘‘আ‘জামী’’ বা অনারবীয় সংস্কৃতির অংশ। প্রথম যুগের মুসলিমগণ তা জানতেন না। পারস্যের মাজুস (অগ্নি উপাসক) ও বাইযান্টাইন খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল জন্মদিন, মৃত্যুদিন ইত্যাদি পালন করা। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে পারস্য, সিরিয়া, মিসর ও এশিয়া মাইনরের যে সকল মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসেন তাঁরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাহাবীদের অনুসরণ অনুকরণ করতেন এবং তাঁদের জীবনাচারণে আরবীয় রীতিনীতিরই প্রাধান্য ছিল। হিজরী তৃতীয় শতাব্দী থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে অনারব পারসিয়ান ও তুর্কী মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে মুসলিম সাম্রাজ্যে বিভিন্ন নতুন নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতির প্রচলন ঘটে, তন্মধ্যে পবিত্র ঈদে মীলাদুন্নবী অন্যতম।
  • খ) ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন: প্রাথমিক প্রবর্তন ও সীমিত উদযাপন:আমরা জানতে পারলাম প্রথম যুগগুলোর পরে মীলাদ অনুষ্ঠান বা ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের শুরু হয়েছে। কিন্তু কবে থেকে? কে শুরু করলেন? আসুন আমরা তাদের সাথে পরিচিত হই এবং কিভাবে তাঁরা এই অনুষ্ঠান পালন করতেন তা জানার চেষ্টা করি।ইতিহাসের আলোকে যতটুকু জানতে পেরেছি, দুই ঈদের বাইরে কোন দিবসকে সামাজিক ভাবে উদযাপন শুরু হয় হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিয়াদের উদ্দোগে। সর্বপ্রথম ৩৫২ হিজরীতে (৯৬৩খ্রি:) বাগদাদের আববাসী খলীফার প্রধান প্রশাসক ও রাষ্ট্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক বনী বুয়াইহির শিয়া শাসক মুইজ্জুদ্দৌলা ১০ই মুহাররাম আশুরাকে শোক দিবস ও জিলহজ্জ মাসের ৮ তারিখ গাদীর খুম দিবস উৎসব দিবস হিসাবে পালন করার নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে এই দুই দিবস সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। যদিও শুধুমাত্র শিয়ারাই এই দুই দিবস পালনে অংশ গ্রহণ করেন, তবুও তা সামাজিক রূপ গ্রহণ করে। কারণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রথম বৎসরে এই উদযাপনে বাধা দিতে পারেন নি। পরবর্তী যুগে যতদিন শিয়াদের প্রতিপত্তি ছিল এই দুই দিবস উদযাপন করা হয়, যদিও তা মাঝে মাঝে শিয়া-সুন্নী ভয়ঙ্কর সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন করার ক্ষেত্রেও শিয়াগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। উবাইদ বংশের রাফেযী ইসমাঈলী শিয়াগণ ফাতেমী বংশের নামে আফ্রিকার উত্তরাংশে রাজত্ব স্থাপন করেন। ৩৫৮ হিজরীতে (৯৬৯ খ্রি:) তারা মিশর দখল করে তাকে ফাতেমী রাষ্ট্রের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন এবং পরবতী ২ শতাব্দীরও অধিককাল মিশরে তাদের শাসন ও কর্তৃত্ব বজায় থাকে। গাজী সালাহুদ্দীন আইঊবীরমিশরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের মাধ্যমে ৫৬৭ হিজরীতে (১১৭২খ্রি:) মিশরের ফাতেমী শিয়া রাজবংশের সমাপ্তি ঘটে। এই দুই শতাব্দীর শাসনকালে মিশরের ইসমাঈলী শিয়া শাসকগণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২ ঈদ ছাড়াও আরো বিভিন্ন দিন পালন করতেন, তন্মধ্যে অধিকাংশই ছিল জন্মদিন। তাঁরা অত্যন্ত আনন্দ, উৎসব ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ৫টি জন্মদিন পালন করতেন:
    ১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন,
    ২) আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন,
    ৩) ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্মদিন,
    ৪) হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন
    ৫) হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিন।এ ছাড়াও তারা তাদের জীবিত খলীফার জন্মদিন পালন করতেন এবং ‘‘মীলাদ’’ নামে ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিন (বড়দিন বা ক্রীসমাস), যা মিশরের খ্রিষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ছিল তা আনন্দপ্রকাশ, মিষ্টি ও উপহার বিতরণের মধ্য দিয়ে উদযাপন করতেন।
  • গ) ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রাথমিক উদযাপন: যুগ ও প্রবর্তক পরিচিতি: ‎‎হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিশরে এই উদযাপন শুরু হয়। এ যুগকে আববাসীয় খেলাফতের দুর্বলতার যুগ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ঐতিহাসিকগণ। আববাসীয় খেলাফতের প্রথম অধ্যায় শেষ হয় ২৩২ হি: (৮৪৭খ্রি:) ৯ম আববাসী খলিফা ওয়াসিক বিল্লাহের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এরপর সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবনতির সূচনা হয়। কারণ কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশাল সাম্রাজ্য বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে যায়। এসকল রাষ্টের মধ্যে অবিরত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতে থাকে। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে বিভিন্ন এলাকায় সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা লুটতরাজ চালানোর সুযোগ পায়। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যহত হয়। বিশেষ করে ৩৩৪ হি: (৯৪৫খ্রি:) থেকে বাগদাদে শীয়া মতাবলম্বী বনূ বুয়াইহ শাসকগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যান, ফলে ইসলামী জ্ঞানচর্চা, হাদীস ও সুন্নাতের অনুসরণ ব্যহত হয়। রাফেযী শিয়া মতবাদের প্রসার ঘটতে থাকে। অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নী জনগণ শিয়াদের বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিয়া-সুন্নী সংঘর্ষ ও গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করত। এ সকল সংঘর্ষ মূলত: দেশের সার্বিক অবস্থার আরো অবনতি ঘটাত। আভ্যন্তরীন অশান্তি ও অনৈক্য বহির্শত্রুর আগ্রাসনের কারণ হয়। এশিয়া মাইনর, আর্মেনীয়া, ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন খ্রিষ্টান শাসক সুযোগমত ইসলামী সম্রাজ্যের অভ্যন্তরে আগ্রাসন চালাতে থাকেন। এছাড়া ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার ও উস্কানীমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে জ্ঞানচর্চা, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিকাশ ব্যহত হয়। অপরদিকে সমাজের মানুষের মধ্যে বিলাসিতা ও পাপাচারের প্রসার ঘটতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে ইসলাম বিরোধী আচার আচরণ, কুসংস্কার, ধর্মীয় বিকৃতি ছড়িয়ে পড়ে।এই যুগের বিচ্ছিন্ন ইসলামী সম্রাজ্যের একটি বিশেষ অংশ ও ইসলামী সভ্যতার অনত্যম কেন্দ্র মিশরে ফাতেমী খলীফা আল-মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ সর্বপ্রথম ঈদে মীলাদুন্নবী, অন্যান্য জন্মদিন পালন ও সে উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবের শুরু করেন। তিনি ৩৫৮ হিজরীতে মিসর অধিকার করেন এবং কায়রো শহরের পত্তন করেন। তিনি সিরিয়া ও হেজাজের বিভিন্ন অঞ্চল ও তাঁর অধীনে আনেন। ৩৬২ হিজরীতে (৯৭২খ্রি:) মুয়িজ্জ কায়রো প্রবেশ করেন এবং কায়রোকেই তাঁর রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করেন। ৩৬৫ হিজরীতে তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তাঁর শাসনামলে মিশরে শিয়া শাসকদের যে সকল উৎসবাদি প্রচলিত হয় তার অন্যতম ছিল ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব।আল মুয়িজ্জ এর প্রচলিত এই ঈদে মীলাদুন্নবী ও অন্যান্য জন্মদিন পালন ও উদযাপন পরবর্তী প্রায় ১০০ বৎসর কায়রোতে শিয়াদের মধ্যে এই উৎসব চালু থাকে। ৪৮৭ হি: (১০৯৪ খ্রি:) ফাতেমী খলীফা আল-মুসতানসিরের মৃত্যু হলে সেনাপতি আল-আফযাল ইবন বদর আল-জামালীর সহযোগিতায় মুস্তানসিরের ছোট ছেলে ২১ বৎসর বয়স্ক আল-মুস্তা‘লী খলীফা হন। সেনাপতি আফযাল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে পড়েন। তিনি ৪৮৮ হিজরীতে ফাতেমীদের প্রচলিত ঈদে মীলাদুন্নবী উৎসব ও অন্যান্য জন্মদিনের উৎসব বন্ধ করে দেন। পরবর্তী কোন কোন ফাতেমী শাসক পুনরায় এ সকল উৎসব সীমিত পরিসরে চালু করেন, তবে ক্রমান্বয়ে ফাতেমীদের প্রতিপত্তি সঙ্কুচিত হতে থাকে এবং এ সকল উৎসব জৌলুস হারিয়ে ফেলে।
  • ঘ) ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রাথমিক উদযাপন: অনুষ্ঠান পরিচিতি ‎‎আহমদ ইবন আলী আল-কালকাশান্দী (৮২১হি:) লিখেছেন:
    ‘‘রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে ফাতেমী শিয়া শাসক মীলাদুন্নবী উদযাপন করতেন। তাদের নিয়ম ছিল যে, এ উপলক্ষে বিপুল পরিমাণে উন্নত মানের মিষ্টান্ন তৈরী করা হত। এই মিষ্টান্ন ৩০০ পিতলের খাঞ্চায় ভরা হতো। মীলাদের রাত্রিতে এই মিষ্টান্ন সকল তালিকাভুক্ত রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলদের মধ্যে বিতরণ করা হতো, যেমন প্রধান বিচারক, প্রধান শিয়া মত প্রচারক, দরবারের কারীগণ, বিভিন্ন মসজিদের খতীব ও প্রধানগণ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানদির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ। এ উপলক্ষে খলীফা প্রাসাদের সামনের ব্যালকনীতে বসতেন। আসরের নামাযের পরে বিচারপতি বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তাদের সংগে আজহার মসজিদের গমন করতেন এবং সেখানে এক খতম কুরআন তিলাওয়াত পরিমাণ সময় বসতেন। মসজিদ ও প্রাসাদের মধ্যবর্তী স্থানে অভ্যাগত পদস্থ মেহমানগণ বসে খলীফাকে সালাম প্রদানের জন্য অপেক্ষা করতেন। এ সময়ে ব্যালকনির জানালা খুলে হাত নেড়ে খলিফা তাদের সালাম গ্রহণ করতেন। এরপর কারীগণ কুরআন তিলাওয়াত করতেন এবং বক্তাগণ বক্তৃতা প্রদান করতেন। বক্তৃতা অনুষ্ঠান শেষ হলে খলীফার সহচরগণ হাত নেড়ে সমবেতদের বিদায়ী সালাম জানাতেন। খিড়কী বন্ধ করা হতো এবং উপস্থিত সকলে নিজ নিজ ঘরে ফিরতেন। এভাবেই তারা আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্মদিনও পালন করত…।’’
    আহমদ ইবন আলী আল-মাকরীযী (৮৪৫হি:) এ সকল জন্মদিন উৎসবের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন:
    ‘‘এ সকল জন্মদিনের উৎসব ছিল তাদের খুবই বড় ও মর্যাদাময় উৎসব সময়। এ সময়ে মানুষেরা সোনা ও রূপার স্মারক তৈরী করত, বিভিন্ন ধরণের খাবার, মিষ্টান্ন ইত্যাদি তৈরী করে বিতরণ করা হতো।’

হিজরী ৪র্থ শতাব্দী থেকেই ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের শুরু হয়। তবে এখানে লক্ষণীয় যে, কায়রো এই উৎসব ইসলামী বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। সম্ভবত: ইসমাঈলীয় ফাতেমী শিয়াদের প্রতি সাধারণ মুসলিম সমাজের প্রকট ঘৃণার ফলেই তাদের এই উৎসবসমূহ অন্যান্য সুন্নী এলাকায় জনপ্রিয়তা পায় নি বা সামাজিক উৎসবের রূপ গ্রহণ করে নি। তবে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় ৬ষ্ঠ হিজরীর দ্বিতীয়ার্ধ (৫৫০-৬০০) থেকেই মিশর, সিরিয়া বা ইরাকের ২/১ জন ধার্মিক মানুষ প্রতি বৎসর রবিউল আউআল মাসের প্রথমাংশে বা ৮ বা ১২ তারিখে খানাপিনার মাজলিস ও আনন্দ প্রকাশের মাধ্যমে ‘‘ঈদে মীলাদুন্নবী’’ পালন করতে শুরু করেন।
তবে যিনি ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসাবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ এবং যিনি ঈদে মীলাদুন্নবীকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসাবে প্রতিষ্ঠা দানের কৃতিত্বের দাবিদার তিনি হচ্ছেন ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের শাসক আবু সাঈদ কূকবুরী (মৃত্যু: ৬৩০হি:)। পরবতী পৃষ্ঠাগুলিতে আমরা তার জীবনী ও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনে তাঁর পদ্ধতি আলোচনা করব। কিন্তু তার আগে আমরা যে যুগের প্রেক্ষাপটে তিনি এই উৎসবের প্রচলন করেন তা আলোচনা করব।
  • ক) যুগ পরিচিতি: হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতক:
    ৪র্থ হিজরী শতকে ইসলামী জগতের অবস্থা কি ছিল তা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। পরবর্তী সময়ে অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে ৭ম হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়কাল ছিল মুসলিম উম্মার জন্য দুর্দিন ও মুসলিম ইতিহাসের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। এ সময়ে আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বাইরের শত্রুর আক্রমণে বিধ্বস্ত হয় বিশাল মুসলিম রাজত্বের অধিকাংশ এলাকা।৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দী মাঝামাঝি এসে আমরা দেখতে পাই যে, এ সকল অভ্যন্তরীণ সমস্যার পাশাপাশি আরো একটি কঠিন সমস্যা মুসলিম উম্মাহর সামনে এসেছে, তা হলো বাইরের শত্রুর আক্রমণ, বিশেষ করে পশ্চিম থেকে ইউরোপীয় ক্রুসেডারদের আক্রমণ এবং পূর্ব থেকে তাতার ও মোগলদের আক্রমণ।
    ক্রুসেড যুদ্ধের শুরু হয় হিজরী ৫ম শতাব্দীর (খ্রীষ্টিয় একাদশ শতাব্দীর) শেষদিকে। ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপে খ্রিষ্টান ধর্মযাজকগণ বিভিন্নভাবে ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী প্রচারণা করতে থাকেন। তারা বলতে থাকে যে, মুসলিমগণ মূর্তিপূজা করেন, তাঁরা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পুজা করেন, নরমাংশ ভক্ষণ করেন, যিশুখ্রিষ্টের অবমাননা করেন ইত্যাদি কথা সারা ইউরোপে প্রচারিত হতে থাকে। পাশাপাশি মুসলিমদের স্পেন বিজয় ও পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশ বিজয় ইউরোপের খ্রিষ্টান শাসকদেরকে ভীত করে তোলে। তাঁরা তাঁদের অভ্যন্তরের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদ ও শত্রুতা ভুলে পোপের নেতৃত্বে প্যালেষ্টাইনের পবিত্রভূমি উদ্ধারের নামে লক্ষ লক্ষ সৈনিকের ঐক্যবদ্ধ ইউরোপীয় বাহিনী নিয়ে মুসলিম সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ চালাতে থাকেন। ৪৯১ ও ৪৯২ হিজরী সালে (১০৯৭ ও ১০৯৮ খ্রি:) প্রথম ক্রুসেড বাহিনীর দশ লক্ষাধিক নিয়মিত সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবক এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া এলাকায় বিভিন্ন মুসলিম দেশে হামলা করেন। এই হামলায় প্রায় ২০ সহস্রাধিক মুসলিম সাধারণ নাগরিক নিহত হন। ক্রুসেড বাহিনী নির্বিচারে নারীপুরুষ ও শিশুদের হত্যা করেন। তাঁরা ক্ষেতখামার ও ফসলাদিও ধ্বংস করেন। এই হামলার মাধ্যমে এশিয়া মাইনর ও সিরিয়া-প্যালেষ্টাইনের বিভিন্ন রাজ্য খ্রিষ্টানরা দখল করে এবং কয়েকটি খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
    পরবর্তী ২০০ বৎসরের ইতিহাস ইউরোপীয় খ্রিষ্টান বাহিনীর উপর্যুপরি হামলা ও মুসলিম প্রতিরোধের ইতিহাস। এ সময়ে খ্রিষ্টানগণ মিসর, সিরিয়া ও ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিধাবিভক্ত মুসলিম শাসকগণ বিভিন্নভাবে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং সর্বশেষ ৬ষ্ঠ হিজরী শতাব্দীর শেষদিকে সালাহুদ্দীন আইউবী অধিকাংশ খ্রিষ্টান রাজ্যের পতন ঘটান এবং প্যালেষ্টাইন ও অধিকাংশ আরব এলাকা থেকে ক্রুসেডিয়ারদের বিতাড়িত করেন। এরপরেও মিশর, সিরিয়া ও লেবানন এলাকায় ক্রুসেডারদের কয়েকটি ছোট ছোট খ্রিষ্টান রাজ্য রয়ে যায়। তদুপরি ইউরোপ থেকে মাঝেমাঝে ক্রুসেড বাহিনীর আগমন ও বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলে আক্রমণ অব্যহত থাকে। যে সময়ে মুসলিমরা দখলদার ক্রুসেড বাহিনীর কবল থেকে বিভিন্ন মুসলিম অঞ্চলকে মুক্ত করছেন, সে সময়ে, ৭ম হিজরী শতকের (১৩শ খ্রীষ্টিয় শতকের) শুরুতে মুসলিম সম্রাজ্যের পূর্বদিক থেকে তাতারদের বর্বর হামলা শুরু হয়। চেঙ্গিশ খানের নেতৃত্বে তাতার বাহিনী সর্বপ্রথম ৬০৬ হিজরীর দিকে (১২০৯ খ্রি:) মুসলিম রাজত্বের পূর্বাঞ্চলে হামলা চালাতে শুরু করে। শীঘ্রই তারা বিভিন্ন মুসলিম জনপদে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করতে থাকে। মানব ইতিহাসের বর্বরতম হামলায় তারা এসকল জনপদের সকল প্রাণীকে নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। বস্ত্তত: তাতাররা মধ্য এশিয়া, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ মুসলিম জনপদ শাব্দিক অর্থেই বিরাণ করে দেয়। পরবর্তী শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮হি:) বলেন:
    ‘‘তাতাররা এসকল জনপদে কত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে এ প্রশ্ন অবান্তর ও অর্থহীন, বরং প্রশ্ন করতে হবে: তারা কতজনকে না মেরে বাঁচিয়ে রেখেছিল।’’
    ৬৫৬ হিজরীতে (১২৫৮খ্রি:) হালাকু খানের নেতৃত্বে তাতাররা মুসলিম সাম্রাজ্যের প্রাণকেন্দ্র ও রাজধানী বাগদাদ ধ্বংস করে। ৪০ দিনব্যপি গণহত্যায় তারা বাগদাদের প্রায় ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। পরবর্তী শতাব্দীর ঐতিহাসিক আল্লামা যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮হি:) লিখেছেন:
    ‘‘হালাকু মৃতদেহ গণনা করতে নির্দেশ দেয়। গণনায় মৃতদেহের সংখ্যা হয় ১৮ লক্ষের কিছু বেশী। তখন (নিহতের সংখ্যায় তৃপ্ত হয়ে) হালাকু হত্যাকান্ড থামানোর ও নিরাপত্তা ঘোষণার নির্দেশ দেয়।’’
    বাইরের শত্রুর পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ কলহ ও দুর্বলতা এ যুগে মুসলিম সমাজগুলোকে বিপর্যস্ত করে তোলে। কোন কোন আঞ্চলিক শাসক নিজের এলাকায় কিছু শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনতে পারলেও সার্বিকভাবে বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যের আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে।
    পরবতী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪হি:), যিনি নিকট থেকে এ যুগের ঘটনাবলী জেনেছেন, তাতারদের নারকীয় বর্বরতার বর্ণনা দেওয়ার একপর্যায়ে লিখেন: ৬১৭হিজরী (১২২০খ্রি:) চেঙ্গিশ খান ও তার বাহিনীর বর্বর হামলা সমস্ত মুসলিম বিশ্বকে গ্রাস করে। ১ বৎসরের মধ্যে তারা প্রায় সমগ্র মুসলিম জনপদ দখল করে নেয় (বাগদাদ ও পার্শ্ববতী এলাকা বাদ ছিল)। … তারা এ বছরে বিভিন্ন বড়বড় শহরে মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অগণিত মানুষকে হত্যা করে। মোটের উপর তারা যে দেশেই প্রবেশ করেছে সেখানকার সকল সক্ষম পুরুষ ও অনেক মহিলা ও শিশুকে হত্যা করেছে। গর্ভবতী মহিলাদেরকে হত্যা করে তাদের পেট ফেড়ে গর্ভস্থ শিশুকে বের করে হত্যা করেছে। যে সকল দ্রব্য তাদের প্রয়োজন তা তারা লুটপাট করেছে। আর যা তাদের দরকার নেই তা তারা পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। ঘরবাড়ী সবই তারা ধ্বংস করেছে বা পুড়িয়ে দিয়েছে। … মানব সভ্যতার শুরু থেকে এ পর্যন্ত এত ভয়াবহ বিপর্যয় ও বিপদ কখনো মানুষ দেখেনি .. ইতিহাসে এতবড় বর্বরতার কোন বিবরণ আর পাওয়া যায় না।
    এভাবে তাতারদের আগ্রাসন, ক্রুসেড হামলা, সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলার অবনতি সমগ্র মুসলিম জাহানকে এমনভাবে গ্রাস করে যে, ৬২৮ হিজরীর (১২৩১খ্রি:) পরে অনেক বছর মুসলিমরা ইসলামের পঞ্চম রোকন হজ্জ পালন করতে পারে নি। ঐতিহাসিক ইবনে কাসীর লিখছেন: ‘‘৬২৮ হিজরীতে মানুষেরা হজ্জ আদায় করেন। এরপরে যুদ্ধবিগ্রহ, তাতার ও ক্রুসেডিয়ারদের ভয়ে আর কেউ হজ্জে যেতে পারেন নি। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।’’

    ইসলামী অনুশাসনের অবহেলা, পাপ-অনাচারের প্রসার, প্রশাসনিক দুর্বলতা, জুলুম অত্যাচারের সয়লাবের কারণে মুসলিমদের মধ্যে নেমে আসে ঈমানী দূর্বলতা। তাতারভীতি তাদেরকে গ্রাস করে। আল্লামা ইবনে কাসীর লিখেছেন:
    ‘‘তাতারভীতি মানুষদেরকে এমনভাবে গ্রাস করেছিল যে, একজন তাতার সৈনিক একটি বাজারে প্রবেশ করে, যেখানে শতাধিক মানুষ ছিল, তাতার সৈন্যটি একজন একজন করে সকল মানুষকে হত্যা করে বাজারটি লুট করে, খুনের এই হোলি খেলার মধ্যে একজন পুরুষও ঐ তাতারটিকে বাধা দিতে আগিয়ে আসতে সাহস পায়নি।’’
    এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, হিজরী ৬ষ্ট ও ৭ম শতকের মুসলিম সমাজে চরম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অশান্তি বিরাজ করছিল, যা ধমীয়, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও স্থবিরতা ও অবক্ষয় নিয়ে আসে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে সাংস্কৃতিক ও শিক্ষার অঙ্গনে স্থবিরতা আসে। মুসলিম সাম্রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন খ্রিষ্টান রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে মুসলিমগণ বিভিন্ন খ্রিষ্টান ধর্মীয় ও সামাজিক আচার আচরণ দ্বারা প্রভাবিত হন। অপরদিকে পূর্বাঞ্চলীয় তাতার ও অন্যান্য কাফির সম্প্রদায়ের মানুষেরা মুসলিম সম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকা দখল করে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাদের আচার আচরণ ও বিশ্বাস-কুসংস্কার মুসলিম সমাজে প্রবেশ করে। সর্বপোরি শিক্ষার ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসার ফলে সমাজের মধ্যে অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও বিভিন্ন ধরণের কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক ভাবে।
    সবকিছুর মধ্যেও কিছু কিছু রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও তৎকালীন আলেম সমাজের চেষ্টায় ইলমের প্রসার ও ইসলামী মূল্যবোধের দিকে আহবানের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। তবে বিশাল মুসলিম সমাজের প্রয়োজনের তুলনার আলেম ও সংস্কারকদের সংখ্যা কমে যেতে থাকে। এছাড়া সার্বিক সামাজিক অস্থিরতা, অজ্ঞতা ও অবক্ষয়ের ফলে সমাজে আলেমদের আবেদন কমতে থাকে। ফলে বিভিন্ন ধরণের ইসলাম বিরোধী কর্ম সমাজে প্রবেশ করে। সমাজের সাধারণ মানুষই নয় ধার্মিক মানুষেরাও এমন অনেক কাজ করতে থাকেন যা শরী‘আত সঙ্গত নয় এবং ইসলামের প্রথম যুগে কোন ধার্মিক মানুষের কাজ ছিল না। যেমন তৎকালীন সময়ে সূফীদের মধ্যে ‘‘সামা’’ বা গান বাজনার প্রসারের একটি উদাহারণের মাধ্যমে এই অবস্থা ব্যাখ্যা করতে চাই, কারণ মীলাদ অনুষ্ঠানের কর্মকান্ড বুঝতে তা আমাদের সাহায্য করবে।
    ইসলামের প্রথম যুগগুলিতে ‘‘সামা’’ বা শ্রবণ বলতে শুধুমাত্র কুরআন শ্রবণ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনী, কর্ম ও বাণী শ্রবণকেই বোঝান হত। এগুলিই তাঁদের মনে আল্লাহর ভালবাসা ও নবীর ভালবাসার জোয়ার সৃষ্টি করত। কোন মুসলিম কখনই আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য বা হৃদয়ে আল্লাহর ভালবাসা তৈরীর দোহাই দিয়ে গান শুনতেন না। সমাজের বিলাসী বা অধার্মিক মানুষদের মধ্যে বিনোদন হিসাবে গানবাজনার প্রচলন ছিল, কিন্তু আলেমগণ তা হারাম জানতেন। কখনই এ সকল কর্ম আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম বলে গণ্য হয় নি। তাঁরা সকলেই মূলত: কুরআন সুন্নাহর গভীর জ্ঞান অর্জন করা ও অর্জিত জ্ঞানের আলোকে জীবন পরিচালনার উপর গুরুত্ব প্রদান করতেন।
    কিন্তু পরবর্তী কালে মুসলিম বিশ্বের সার্বিক অস্থিরতা, ফিকহ, হাদীস ও অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান চর্চার অভাব, বিজাতীয় প্রভাব ইত্যাদি কারণে কিছু কিছু মানুষের মধ্যে বিভিন্ন অনাচার প্রবেশ করে। এদের মধ্যে ক্রমে ক্রমে গান বাজনা, নর্তন কুর্দন ইত্যাদি অনাচার ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গান বাজনা এক পর্যায়ে ধার্মিক মানুষদের ধর্মকর্মের অংশ হয়ে যায়। তারা একে ‘‘সামা’’ বা শ্রবণ বলতেন। তারা গানের তালে তালে নাচতে থাকতেন এবং অনেকেই আবেগে নিজের পরিধেয় কাপড় চোপড় ছিড়ে ফেলতেন। কেহ বাজনা সহ, কেহবা বাজনা ব্যতিরেকে গান গেয়ে ও নেচে নিয়মিত ‘সামা’র মাজলিস করতেন। কারণ তাদের ধারণা ছিল যে, এ সকল গান গজল আল্লাহ ভক্তদের মনে আল্লাহর ভালবাসার জোয়ার সৃষ্টি করত। তাঁরা ‘সামা’কে আল্লাহ প্রাপ্তির ও আল্লাহ প্রেম অর্জনের অন্যতম মাধ্যম মনে করতেন। আর এটা জানা কথা যে, সমাজে যখন কোন কাজ ব্যাপক ভাবে প্রচলিত হয়ে যায়, বিশেষত: ধার্মিক ও ভাল মানুষদের মধ্যে, তখন অনেক আলেম এসকল কর্মের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি প্রদান করেন এবং এগুলোকে জায়েয বা ইসলাম সম্মত বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। গান বাজনার ক্ষেত্রেও এই অবস্থা হয়। কোন কোন আলেম সূফীদের প্রতি সম্মান হেতু এবং হৃদয়ে গানের ফলে যে আল্লাহর ভালবাসার তথাকথিত আবেশ ও আনন্দ পাওয়া যায় তার দিকে লক্ষ্য করে এগুলোর পক্ষে মিথ্যা ওকালতি করেছেন। যেমন, প্রখ্যাত দার্শনিক গাযালী (৫০৫হি:)। তিনি তাঁর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘‘এহইয়াউ উলুমিদ্দীন’’ গ্রন্থে সুদীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে গান বাজন ও নর্তন কুর্দনের পক্ষে যুক্তি প্রমান পেশ করার চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এসকল কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ও সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগে প্রচলিত বা পরিচিত ছিল না।

    অপরদিকে সত্যনিষ্ঠ আলেম সমাজের বহুল প্রচলনকে মেনে নিতে পারেন নি। তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগ ও সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীদের যুগকেই প্রামাণ্য বলে মনে করেছেন, এ সকল যুগে যেহেতু গান বাজনা, নর্তন কুর্দন ইত্যাদি কখনই আল্লাহর পথের পথিকদের কর্ম ছিল না, বরং সমাজের পাপী অশ্লীলতায় লিপ্ত লোকেদের কর্ম ছিল, তাই সূফী ও জাহেলদের মধ্যে বহুল প্রচলন সত্বেও তাঁরা এগুলিকে মেনে নেন নি, বরং তা রোধ করার চেষ্টা করেছেন। তবে পূর্বোক্ত ইসলামী বিশ্বের সার্বিক অবস্থা সামনে নিলে সে যুগের আলেমদের সংস্কারমূলক কাজের সীমাবদ্ধতা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। তাঁরা বাষ্ট্রীয় সমর্থন থেকে বঞ্চিত ছিলেন। সমাজে অজ্ঞতার প্রভাব ছিল বেশী। তা সত্বেও তাঁরা সেই যুগে ইসলামের আলোর মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন, সমাজের মানুষদেরকে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। তাঁরাই ছিলেন দ্বীনের সঠিক মশাল। আল্লাহ তাদেরকে রহমত করুন।
  • খ) প্রবর্তক: ব্যক্তি ও জীবন:
    আগেই বলেছি যে, মিশরের শিয়া শাসকগণ প্রথম ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তন করেন। ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ দিকে মিশরের বাইরেও কোন কোন ধর্মপ্রান মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রতি বৎসর রবিউল আউয়াল মাসের প্রথম দিকে ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে শুরু করেন। তবে ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর মাধ্যমেই এই উৎসবকে সুন্নী জগতে এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বে জনপ্রিয় উৎসবে পরিণত হয়। এজন্য বিভিন্ন সীরাতুন্নবী বিশেষজ্ঞ ও ঐতিহাসিকগণ তাঁকেই ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রবর্তক হিসাবে উল্লেখ করেছেন; কারণ তিনিই প্রথম এই উৎসবকে বৃহৎ আকারে পালন করতে শুরু করেন এবং সাধারণের মধ্যে এই উৎসবের প্রচলন ঘটান। আল্লামা মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালেহী শামী (মৃত্যু: ৯৪২হি: ১৫৩৬খ্রি:) তার প্রখ্যাত সীরাতুন্নবী গ্রন্থে- (সীরাহ শামীয়া) ঈদেমীলাদুন্নবী পালনের আহবান জানাতে যেয়ে আলোচনার প্রথম দিকে লিখছেন:
    ‘‘সর্বপ্রথম যে বাদশাহ এই উৎসব উদ্ভাবন করেন তিন হলেন, ইরবিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরী…’’
    আল্লামা যাহাবী কুকবূরীর পরিচিতি প্রদান করতে গিয়ে লিখছেন:
    ‘‘ধার্মিক সুলতান সম্মানিত বাদশাহ মুযাফ্ফরুদ্দীন আবু সাঈদ কূকুবুরী ইবনে আলী ইবনে বাকতাকীন ইবনে মুহাম্মাদ আল-তুরকমানী’’ । তাঁরা তুকী বংশোদ্ভুত। তাঁর নামটিও তুর্কী। তুকী ভাষায় কূকুবুরী শব্দের অর্থ ‘‘নীল নেকড়ে’’।
    তাঁর পিতা আলী ইবনে বাকতাকীন ছিলেন ইরাকের ইরবিল অঞ্চলের শাসক। তিনি অত্যন্ত সাহসী ও বীর যোদ্ধা ছিলেন। ক্রুসেড যোদ্ধাদের থেকে অনেক এলাকা জয় করে তাঁর শাসনাধীনে নিয়ে আসেন। তিনি ধার্মিকতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। অনেক মাদ্রাসা ও জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
    বীরত্ব ও ধার্মিকতার এই পরিবেশে কূকুবুরী ৫৪৯ হি: সনে (১১৫৪ খ্রি:) জন্মগ্রহণ করেণ। তাঁর বয়স যখন মাত্র ১৪ বৎসর তখন ৫৬৩ হি: সনে (১১৬৮ খ্রি:) তাঁর পিতা মারা যান। পিতার মৃত্যুর পরে কূকুবূরী ইরবিলের শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি অল্পবয়স্ক হওয়ার কারণে আতাবিক মুজাহিদ উদ্দীন কায়মায তাঁর অভিভাবক হিসাবে নিযুক্ত হন। উক্ত অভিভাবক কিছুদিনের মধ্যেই কুকুবুরীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন এবং কুকুবুরীকে শাসনকার্য পরিচালনায় অযোগ্যতার অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর ভাই ইউসুফকে ক্ষমতায় বসান। কূকুবুরী তখন ইরবিল ত্যাগ করে ইরাকের মাওসিল অঞ্চলের শাসক সাইফুদ্দীন গাযী ইবনে মাউদূদের নিকট গমন করেন। তিনি কুকুবুরীকে মাউসিলের শাসনাধীন হাররান অঞ্চলের শাসক হিসাবে নিয়োগ করেন। কিছুদিন হাররানে অবস্থান করার পরে তিনি যে যুগের প্রসিদ্ধ বীর, মিসর ও সিরিয়ার শাসক গাজী সালাহুদ্দীন আল-আইউবীর দরবারে যোগ দেন। তিনি সালাহুদ্দীনের সাথে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সালাহুদ্দীন কুকুবুরীর বীরত্বে ও কর্তব্যনিষ্ঠায় এতই মুগ্ধ হন যে, তিনি তাঁর বোন রাবীয়া খাতুনের সাথে কুকবুরীর বিবাহ দেন এবং তাকে হাররান ও রুহা অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করেন। ৫৮৩ হিজরীতে (১১৮৭খ্রি:) হিত্তীনের যুদ্ধে সালাহুদ্দীন আইউবীর মুসলিম বাহিনী সম্মিলিত খৃষ্টান ক্রুসেড বাহিনীকে শোচনীয়রূপে পরাজিত করে এবং জেরুজালেম ও সমগ্র্ প্যালেষ্টাইন থেকে ইউরোপীয় বাহিনীর চুড়ান্ত পরাজয়ের সূচনা করে। এই যুদ্ধে কুকুবুরী অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করেন। এ সময়ে তাঁর ভাই ইরবিলের শাসক ইউসুফ মারা যান। তখন সালাহুদ্দীন কুকুবুরীকে পুনরায় ইরবিলের শাসনক্ষমতা প্রদান করেন।
    কুকবুরী অত্যন্ত ধার্মীক ছিলেন। পরবতী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইমাম যাহাবী (মৃ: ৭৪৮ হি:) বলেন:
    ‘‘যদিও তিনি (কুকবুরী) একটি ছোট্ট রাজ্যের রাজা ছিলেন, তিনি ছিলেন সচেচেয়ে বেশী ধার্মিক, সবচেয়ে বেশী দানশীল, সমাজকল্যানেব্রত ও মানবসেবী বাদশাহদের অন্যতম। প্রতি বছর ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের জন্য তিনি যে পরিমান অর্থব্যয় করতেন তা সবার মুখে প্রবাদের মত উচ্চারিত হত।’’
    তিনি শাসন কার্য পরিচালনার ফাঁকে ফাঁকে আলেমদের নিকট থেকে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতেন।
    আবু সাঈদ কুকবুরীর সমসাময়িক ঐতিহাসিক আল্লামা ইয়াকুত আল-হামাবী (মৃত্যু ৬২৬হি:) কুকবুরীর বর্ণনা দিকে গিয়ে লিখেছেন:

    ‘‘আমীর মুযাফ্ফরুদ্দীন কূকুবূরী এই ইরবিল শহরের উন্নয়নমূলক প্রভুত কর্ম করেন। এই আমীরের চরিত্র বৈপরিত্যময়। একদিকে তিনি প্রজাদের উপর অনেক জুলুম অত্যাচার করেন, অবৈধভাবে প্রজাদের নিকট থেকে সম্পদ সংগ্রহ করেন। অপরদিকে তিনি কুরআন পাঠক ও ধার্মিক মানুষদের সাহায্য করেন, দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য তাঁর দানের হাত খুবই প্রশস্ত। কল্যাণকর্মে তিন মুক্তহস্তে ব্যয় করেন, অমুসলিমদের নিকট বন্দী মুসলিমদেরকে টাকার বিনিময়ে মুক্ত করেন…।’’
    কর্মময় জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে প্রায় ৮২ বৎসর বয়সে কুকবূরী ৬৩০ হিজরীর ৪ঠা রমযান (১৩/৬/১২৩৩ খ্রি:) মারা যান। তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনের অন্যতম কর্ম যা তাকে সমসাময়িক সকল শাসক থেকে পৃথক করে রেখেছে এবং ইতিহাসে তাকে বিশেষভাবে স্মরণীয় করে রেখেছে তা হলো ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনের প্রচলন। তিনি ৫৮৩ থেকে ৬৩০ পর্যন্ত দীঘ প্রায় ৪৫ বৎসরের শাসনামলের কোন বছরে প্রথম এই অনুষ্ঠান শুরু করেন তা সঠিক ভাবে জানতে পারিনি। প্রখ্যাত বাঙ্গালী আলেমে দীন, মাওলানা মোহাম্মদ বেশারতুল্লাহ মেদিনীপুরী উল্লেখ করেছেন যে, হিজরী ৬০৪ সাল থেকে কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন।ু তিনি তাঁর এই তথ্যের কোন সূত্র প্রদান করেন নি। ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে প্রতিয়মান হয় যে, ৬০৪ হিজরীর আগেই কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন। ইবনে খাল্লিকান লিখেছেন:
    ‘‘৬০৪ হিজরীতে ইবনে দেহিয়া খোরাসান যাওয়ার পথে ইরবিলে আসেন। সেখানে তিনি দেখেন যে, বাদশাহ মুযাফফরুদ্দীন কূকুবূরী অতীব আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে মীলাদ উদযাপন করেন এবং এ উপলক্ষ্যে বিশাল উৎসব করেন। তখন তিনি তাঁর জন্য এ বিষয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন…।’’
    এ থেকে স্পষ্ট যে, ইবনে দেহিয়া ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে আগমনের কিছু পূর্বেই কূকুবূরী মীলাদ উদযাপন শুরু করেন, এজন্যই ইবনে দেহিয়া ইরবিলে এসে তাকে এই অনুষ্ঠান উদযাপন করতে দেখতে পান। তবে উদযাপনটি ৬০৪ হিজরীর বেশী আগে শুরু হয়নি বলেই মনে হয়, কারণ বিষয়টি ইবনে দেহিয়া আগে জানতেন না, এতে বোঝা যায় তখনো তা পার্শবর্তী দেশগুলিতে প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এতে আমরা অনুমান করতে পারি যে, কূকুবূরী ৬ষ্ঠ হিজরী শতকের শেষ দিকে বা ৭ম হিজরী শতকের শুরুতে (৫৯৫-৬০৩ হিজরী) মীলাদ পালন শুরু করেন।
  • গ) প্রথম মীলাদ গ্রন্থ লেখক: ব্যক্তি ও জীবন:মীলাদ অনুষ্ঠান প্রচলন করার ক্ষেত্রে আরেক ব্যক্তিত্বের অবদান আলোচনা না করলে সম্ভবত: আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন ‘‘মীলাদুন্নবী’’র উপরে সর্বপ্রথম গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান, ইবনে দেহিয়া আল-কালবী (৬৩৩হি:), যার গ্রন্থ পরবর্তীতে ‘‘মীলাদ’’ কেন্দ্রীক অসংখ্য গ্রন্থ রচনার উৎস ছিল। মীলাদের উপরে লিখিত গ্রন্থের জন্য কুকবুরী তাকে একহাজার দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) পুরস্কার প্রদান করেন।ইবনে দেহিয়া ৫৪৪ হিজরীতে (১১৫০খ্রী) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬৩৩হিজরীতে (১২৩৫খ্রী) মিশরে মারা যান। প্রায় ৯০ বৎসরের জীবনে তিনি তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের প্রায় সর্বত্র ভ্রমন করেন। তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেন এবং ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানে তাঁর অবদান রাখেন। তবে লক্ষ্যনীয় যে ঈদে মীলাদুন্নবীর প্রথম পুস্তক লেখক ইবনে দেহিয়া সমসাময়িক বা পরবর্তী আলেম ও লেখকদের প্রশংসা অর্জন করতে পারেন নি। বরং সকল ঐতিহাসিক ও লেখক তাঁর কর্মময় জীবনের বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর কিছু কিছু আচরণ ও কর্মের সমালোচনা করেছেন।আল্লামা জিয়াউদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহেদ আল-মাকদেসী (৫৬৯-৬৪৩হি:) বলেছেন:
    ‘‘আমি ইস্পাহানে তাকে দেখেছি। তবে তাঁর থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করিনি। কারণ তাঁর অবস্থা আমার ভাল লাগেনি। তিনি ইমামদের খুবই নিন্দামন্দ করতেন।’’
    আল্লামা যাহাবী লিখেছেন:
    ‘‘তিনি বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্রে পান্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন, আরবী ভাষা ও হাদীস শাস্ত্রে তিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তবে তিনি হাদীস বর্ণনাকারী হিসাবে জয়ীফ বা দুর্বল ছিলেন।’’
    তাঁর এই স্বভাবের কারণে তিনি যখন মরক্বো ও তিউনিসিয়া অঞ্চলে অবস্থান করছিলেন তখন সে দেশের আলেমগণ একত্রে তার বিরুদ্ধে, তাঁকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষনা দিয়ে একটি ঘোষণাপত্র লিখেন।
    ঐতিহাসিক আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল গনী, ইবনে নুকতা (৬২৯হি:) লিখেছেন:

    ‘‘তিনি বড় জ্ঞানী ও মর্যাদার অধিকারী হিসাবে সমাজে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের বিষয়ে এমন অনেক বিষয় দাবী করতেন যা ছিল একেবারেই অবাস্তব। তিনি দাবী করতেন যে, সহীহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিযী তাঁর মুখস্ত রয়েছে। একজন ছাত্র পরীক্ষামূলক ভাবে সহীহ মুসলিমের কয়েকটি হাদীস, সুনানে তিরমিযীর কয়েকটি হাদীস ও কয়েকটি বানোয়াট বা মাওযু হাদীস একত্রে লিখে তাঁকে দেন। তিনি হাদীসগুলো পৃথক করতে বা কোনটি কোন কিতাবের হাদীস তা জানাতে পারেন নি।’’
    আল্লামা যাহাবী বলেন:
    ‘‘তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে সহীহ ও জয়ীফ বর্ণনার ক্ষেত্রে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা খুবই আপত্তিকর।’’
    আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২হি:) ঐতিহাসিক ইবনে নাজ্জার (৬৪৩হি:) থেকে বর্ণনা করেছেন:
    ‘‘আমরা দেখেছি, সকল মানুষ একমত ছিলেন যে, ইবনে দেহিয়া মিথ্যা কথা বলেন এবং বিভিন্ন অসত্য দাবী করেন।’’
    ইবনে হাজার আসকালানী অন্য এক বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন:
    ‘‘তাঁর সমসাময়িক এক আলেম বলেন: একদিন আমি সুলতানের দরবারে ছিলাম, যেখানে ইবনে দেহিয়াও ছিলেন। সুলতান আমাকে একটি হাদীস জিজ্ঞাসা করলে আমি হাদীসটি বলি। তখন তিনি আমাকে হাদীসটির সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। আমি তখন হাদীসটির সনদ মনে করতে পারি না এবং আমার অপারগতা জানাই। পরে আমি দরবার ত্যাগ করলে ইবনে দেহিয়া আমার সাথে আসেন এবং বলেন: যখন সুলতান আপনাকে সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন তখন যে কোন একটি বানোয়াট সনদ বলে দিলে আপনার কি ক্ষতি হতো? সুলতান ও তার দরবারের সবাই জাহেল, তারা কিছুই বুঝতে পারত না। তাতে আপনাকে ‘জানি না’ বলতে হতো না এবং উপস্থিত সভাসদদের কাছে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। উক্ত আলেম বলেন: ইবনে দেহিয়ার এই কথায় আমি বুঝতে পারলাম তিনি মিথ্যা বলতে পরোয়া করেন না।’’
    ইবনে হাজার আসকালানী অন্য একজন সমসাময়িক আলেমের উদ্ধিৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন: ‘‘ইবনে দেহিয়া যখন ইস্পাহানে আসলেন তখন আমার পিতার খানকায় আসতেন। আমার আববা তাকে খুবই সম্মান করতেন। একদিন তিনি আমার আববার কাছে একটি জায়নামাজ নিয়ে আসেন এবং জায়নামাজটি তার সামনে রেখে বলেন: এই জায়নামাজে আমি এত এত হাজার রাকাত নামায আদায় করেছি এবং আমি কা’বা শরীফের মধ্যে এই জায়নামাজে বসে কয়েকবার কুরআন করীম খতম করেছি। আমার আববা খুবই খুশী হয়ে জায়নামাজটি গ্রহণ করেন এবং মাথায় রাখেন ও চুমু খেতে থাকেন। তিনি এই হাদীয়া পেয়ে খুবই খুশি হন। এ দিকে কাকতালীয় ভাবে সন্ধ্যার দিকে একজন স্পাহানী স্থানীয় ব্যক্তি আমাদের কাছে আসেন। তিনি কথাপ্রসঙ্গে বলেন: আপনাদের খানকায় যে মরোক্কীয় আলেম আসেন তাকে দেখলাম বাজার থেকে অনেক দামে একটি খুব সুন্দর জায়নামাজ কিনলেন। তখন আমার আববা (একটু খটকা লাগায়) ইবনে দেহিয়ার প্রদত্ত জায়নামাজটি আনতে বলেন। জায়নামাজটি দেখে ঐ ব্যক্তি কসম করে বলে যে, সে এই জায়নামাজটিই কিনতে দেখেছে ইবনে দেহিয়াকে। এতে আমার আববা চুপ হয়ে যান এবং আমাদের মন থেকে ইবনে দেহিয়ার প্রতি সকল সম্মান চলে যায়।’’
    আল্লামা ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি:) লিখেছেন:
    ‘‘ইবনে দেহিয়া সম্পর্কে অনেকে অনেক কিছু বলেছেন। বলা হয় তিনি মাগরিবের নামায কসর করার বিষয়ে একটি মিথ্যা হাদীস বানিয়ে বলেছেন। আমার ইচ্ছা ছিল হাদীসটির সনদ দেখব, কারণ সকল মুসলিম আলেম একমত যে, মাগরীবের নামায কসর হয় না… আল্লাহ আমাদেরকে এবং তাঁকে দয়া করে ক্ষমা করে দিন।’’
    ইবনে দেহিয়ার মিথ্যাচার সম্পর্কে একটি বিবরণ প্রদান করেছেন সমসাময়িক ঐতিহাসিক ইবনে খাল্লিকান (৬৮১ হি:)। ইবনে দেহিয়ার প্রতি তাঁর অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা ছিল বলে তাঁর লেখা থেকে প্রতীয়মান হয়। তাঁর লেখা মীলাদের বইটি তিনি ৬২৫ হিজরীতে কুকবুরীর দরবারে বসে পড়তে পেরে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতেন। কিন্তু তিনি আশ্চার্য্য হন যে, উক্ত বইয়ের শেষে ইবনে দেহিয়া একটি বড় আরবী কসীদা লিখেছেন কুকবূরীর প্রশংসায়। তিনি দাবী করেছেন যে, কসীদাটি তিনি নিজে লিখেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ইবনে খাল্লিকান জানতে পারেন যে, কবিতাটি সিরিয়ার হালাবশহরের বাসিন্দা কবি আস‘আদ ইবন মামাতীর (মৃত্যু ৬০৬হি:) লেখা ও তাঁর কাব্য গ্রন্থে সংকলিত, তিনি উক্ত কসীদা দ্বার তৎকালীন অন্য একজন শাসকের প্রশংসা করেন।
    সবকিছুর মধ্য দিয়ে আমরা বলতে পারি যে, ইবনে দেহিয়া যে যগের একজন বিদ্যান ব্যক্তি ছিলেন। যে গ্রন্থটি তাকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে দিয়েছে তা হলো ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহরে জন্মবিষয়ে লেখা তার বই ‘‘আত- তানবীর ফী মাওলিদিল বাশীর আন-নাযির’’। কারণ এটিই ছিল ‘‘মীলাদুন্নবী’’ বা রাসূলুল্লাহরে জন্মবিষয়ে লেখা প্রথম বই। ইবনে খাল্লিকানের বর্ণনা অনুসারে আমরা দেখতে পাই, ইবনে দেহিয়া ৬০৪ হিজরীতে ইরবিলে প্রবেশ করেন। তিনি বছর দুয়েক সেখানে বাদশাহ কূকুবূরীর রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসাবে অবস্থান করেন। এ সময়ে তিনি এই বইটি সংকলন করেন। ৬০৬ হিজরীতে তিনি এই বইটি লেখা সমাপ্ত হলে তা কূকুবূরীকে পড়ে শোনান।
    এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ বা তৎপরবর্তী মুসলিম সমাজের আলেমগণ ৬০০ বৎসর যাবৎ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মকে কেন্দ্র করে কি একটি বইও লিখেন নি?

    এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদেরকে সেই যুগগুলির অবস্থা বুঝতে হবে। প্রথম যুগের মুসলিমগণ, সাহাবী ও তাবেয়ীগণের সাবক্ষণিক কর্ম ও ব্যস্ততা ছিল মহানবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে। তাঁদের সকল আবেগ, ভালবাসা ও ভক্তি দিয়ে তাঁরা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবন ও কর্ম জানতে, বুঝতে, শেখাতে ও লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাদের কর্মকান্ডের যে বর্ণনা হাদীস শরীফে ও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং তাদের যুগে লিখিত ও সংকলিত যে সকল বই পুস্তকের বর্ণনা আমরা পাই বা যে সকল বই পুস্তক বর্তমান যুগ পর্যন্ত টিকে আছে তার আলোকে আমরা দেখতে পাই যে, তাঁরা মূলত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কর্ম, চরিত্র, ব্যবহার, আকৃতি, প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি জানতে বুঝতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁর জীবনী সংকলনের দিকে যে যুগের মুসলিমদের মনোযোগ দেখা যায় না। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের অনুকরণীয়, অনুসরণীয় ও তাঁর প্রবর্তিত বিধানাবলীর দিকটায় তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁর জীবনের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা, বা জীবনী রচনার দিকে তারা গুরুত্ব প্রদান করেন নি। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, সাহাবীগণের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিন, জন্ম তারিখ বা জন্মমাস নিয়ে কোন আলোচনাই পাওয়া যায় না। স্বভাবত:ই তাঁর জন্ম কেন্দ্রীক কোন গ্রন্থও তখন রচিত হয়নি। প্রথম তিন শতাব্দীতে রচিত হাদীস গ্রন্থ সমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম সংক্রান্ত যৎসামান্য কয়েকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা আগে আলোচনা করেছি। এছাড়া প্রথম শতাব্দীর শেষ থেকে সীরাতুন্নাবী বা নবী জীবনী বিষয়ক গ্রন্থ লেখা হতে থাকে বলে মনে হয়। তবে এ যুগে মূলত: সীরাতুন্নাবীর মাগাযী বা যুদ্ধবিগ্রহ বিষয়ক বিষয়েই বিশেষভাবে লিখা হত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় হিজরী শতকের উল্লেখযোগ্য সীরাতুন্নবী গ্রন্থ হল মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক (মৃত্যু ১৫১হি:/৭৬৮খ্রি:), আব্দুল মালেক ইবনে হিশাম (মৃত্যু ২১৮হি:/৮৩৪খ্রি:), মুহাম্মাদ ইবনে সা’দ (২৩০হি:/৮৪৫খ্রি:) প্রমুখের লিখা ‘‘সীরাতুন্নবী গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য। এ সকল গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ৩য় হিজরী শতক থেকে মুসলিম ঐতিহাসিকগণ লিখিত সকল ইতিহাস গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মসংক্রান্ত বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন খলীফা ইবনে খাইয়াত ‘শাবাব’ আল উসফুরী (২৪০হি:/৮৫৪খ্রি:), আহমদ ইবনে ইয়হইয়া আল বালাযুরী (২৭৯হি:/৮৯২খ্রি:), আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে জরীর (৩১০হি:/৯২৩খ্রি:) ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ। ৫ম হি: শতক থেকে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতৃক সংঘটিত মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনাবলী পৃথকভাবে সংকলিত করে ‘‘দালাইলুন নুবুওয়াত’’ নামে কয়েকটি গ্রন্থ লেখা হয়, যেমন আবু নু‘আাইম আহমদ ইবনে আব্দুল্লাহ আল-আসফাহানী (৪৩০হি:/১০৩৯খ্রি:) ও আবু বকর আহমদ ইবনে হুসাইন আল- বাইহাকী (৪৫৮হি:/১০৬৬ খ্রি:) সংকলিত ‘‘দালাইলুন নুবুওয়াত’’ গ্রন্থ। এ সকল গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম কালীন অলৌকিক ঘটনাবলীর কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। সর্বাবস্থায় আমরা দেখতে পাই যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মকে নিয়ে পৃথক গ্রন্থ কেউই রচনা করেন নি। বস্ত্তত: তাঁর জন্ম উদযাপন যেমন ইসলামের প্রথম শতাব্দীগুলোতে মুসলিম উম্মাহর অজানা ছিল, তেমনি তাঁর জন্ম বা ‘‘মীলাদ’’ নিয়ে পৃথক গ্রন্থও ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আগে কেউ রচনা করেন নি। কারণ তাদের কাছে জন্ম বৃত্তান্ত বড় কোন বিষয় বলে বিবেচিত হতো না।

উপসংহার:

এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, মিশরের ইসমাঈলীয় শাসকগণ দ্বারা প্রবর্তিত হলেও ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপনকে সমস্ত মুসলিম বিশ্বে অন্যতম উৎসবে পরিণত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান ইবরিলের শাসক আবু সাঈদ কূকুবূরীর। তাঁকেই আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রকৃত প্রবর্তক বলে মনে করতে পারি। এর অন্যতম প্রমাণ হলো ৪র্থ হিজরী শতকে মিশরে এই উদযাপন শুরু হলে তার কোন প্রভাব বাইরের মুসলিম সমাজগুলোতে পড়ে নি। এমনকি পরবতী ২০০ বৎসরের মধ্যেও আমরা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোথাও এই উৎসব পালন করতে দেখতে পাই না। অথচ ৭ম হিজরী শতকের শুরুতে কুকবূরী ইরবিলে ঈদে মীলাদুন্নবী উদযাপন শুরু করলে তা তৎকালীন মুসলিম সমাজগুলিতে সাড়া জাগায়। পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার বিভিন্ন মুসলিম সমাজে অনেক মানুষ ঈদে মীলাদুন্নবী পালন করতে শুরু করে।
যে সকল কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে ধর্মীয় কর্ম, আচার বা উৎসব হিসাবে প্রচলিত, পরিচিত বা আচরিত ছিল না, পরবর্তী যুগে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় কর্ম হিসাবে প্রচলিত হয়েছে সে সকল কাজ কখনো পরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম হতে পারে না।
যেহেতু মিশরের শাসকগণ ও পরবর্তীকালে আবু সাঈদ কূকবুরী প্রবর্তিত ঈদে মীলাদুন্নবী জাতীয় কোন অনুষ্ঠান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের যুগে প্রচলিত বা পরিচিত ছিল না তাই স্বভাবত:ই তা বিদ‘আত ও পরিত্যাজ্য। সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ তাঁদের প্রচন্ডতম নবীর ভালবাসা সত্ত্বেও কখনো তাঁদের আনন্দ এভাবে উৎসব বা উদযাপনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন নি, কাজেই পরবর্তী যুগের মুসলিমদের জন্যও তা শরী‘আত সঙ্গত হবে না। পরবর্তী যুগের মুসলিমদের উচিৎ প্রথম যুগের মুসলিমদের ন্যায় সার্বক্ষণিক সুন্নাত পালন, সীরাত আলোচনা, দরুদ ও সালাম এবং আন্তরিক ভালবাসার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো। অমুসলিমদের অনুকরণে জন্মদিন পালনের মাধ্যমে রাসূলের ভালবাসা প্রকাশ পায় না। বরং এ সকল অনুষ্ঠানের প্রসার সাহাবীদের ভালবাসা, ভক্তি ও আনন্দ প্রকাশের পদ্ধতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতা সৃষ্টি করে, কারণ যারা এ সকল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভালবাসা ও আনন্দ প্রকাশ করবেন, তাঁদের মনে হতে থাকবে যে সাহাবীদের মত নীরব, অনানুষ্ঠানিক, সার্বক্ষণিক ভালবাসা ও ভক্তি প্রকাশ পদ্ধতির চেয়ে তাদের পদ্ধতিটাই উত্তম। যা নিঃসন্দেহে ভ্রষ্টতা। এ ব্যাপারে বহু আলেম সাবধান করে গেছেন। যেমন, সপ্তম-অষ্টম হিজরী শতাব্দীর অন্যতম আলেম ইমাম আল্লামা তাজুদ্দীন উমর ইবন আলী আল-ফাকেহানী (মৃত্যু: ৭৩৪ হিজরী/ ১৩৩৪খ্রি:), আল্লামা আবু আব্দুল্লাহ মুহম্মদ ইবন মুহম্মদ ইবনুল হাজ্জ (৭৩৭হি:/১৩৩৬খ্রি:), ৮ম হিজরী শতকের প্রখ্যাত আলেম আবু ইসহাক ইব্রাহীম ইবন মূসা ইবন মুহাম্মাদ আশ-শাতিবী (মৃত্যু ৭৯০ হি:) ও অন্যান্য উলামায়ে কেরাম।

আমরা আগেই বলেছি যে, জন্মদিন পালনের ন্যায় মৃত্যুদিন পালনও অনারব সংস্কৃতির অংশ, যা পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজেও প্রচলিত হয়ে যায়। রবিউল আউয়াল মাস যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম মাস, তেমনি তাঁর মৃত্যুর মাসও বটে। তাই এটি দুঃখের কারণ হতে পারে। কোন কোন বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, ৭ম হিজরী শতাব্দীর শেষে এবং ৮ম হিজরী শতকের প্রথমাংশেও মীলাদুন্নবী পালন অনেক দেশের মুসলিমদের কাছে অজানা ছিল, তারা জন্মদিন পালন না করে মৃত্যু দিবস পালন করতেন। বস্ত্তত: এ সবই গর্হিত বিদ‘আত। ইসলামে বিদ‘আতের কোন স্থান নেই। তাই জন্ম দিবস বা মৃত্যু দিবস এসব পালন থেকে আমাদেরকে দূরে থাকতে হবে।
আল্লাহই আমাদের সহায় হোন ও তৌফিক দিন। দো‘আ করি তিনি দয়া করে আমার এ ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে কবুল করেন। আল্লাহর মহান রাসূল, হাবীব ও খলীল মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর উপর অগণিত সালাত ও সালাম। আল্লাহুম্মা সাল্লি আলাইহি ওয়া সাল্লিম মা যাকারুয যাকিরুন ওয়া গাফালা আন যিকরিহিল গাফিলূন

অনুরাগ ও আত্মোৎসর্গ

হযরত আবু বকর (রা) এর ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় একবার তাঁর উপর শত্রুরা আক্রমণ করে বসে। ওৎবা ইবন রবী’আ তাঁকে নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিল। ফলে তাঁর চেহারা এমনভাবে ফুলে গিয়েছিল,তাঁকে দেখে চেনাই মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। বনু তামীম তাঁকে কাপড়ে জড়িয়ে তাঁর ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তিনি যে তাতে নির্ঘাত মারা যাবেন তাতে কারো কোন সন্দেহ ছিল না। বেলা ডোবার পর তিনি জ্ঞান ফিরে পান। তারপর তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খবর কি ? তিনি কেমন আছেন?’ লোকে তাঁর একথা শুনতেই ক্রোধান্বিত হয়, এই অবস্থাতেও তিনি তাঁরই কথা স্মরণ করছেন যাঁর কারণে আজ তাঁর এই করুণ হাল! এজন্যে তারা তাঁকে কটুকাটব্য ও ভর্ৎসনা করতে লাগল। তারা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মা উম্মুল খায়রকে ডেকে বলল, ‘দেখুন! তাঁর কিছু খানাপিনার ব্যবস্থা করুন’। মা তাকে খাবার গ্রহণের জন্যে অনেক পীড়াপীড়ি করলেন। কিন্তু তাঁর মুখে সেই একই কথা, ‘বল ! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেমন আছেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমার সাথী সম্পর্কে কিছুই জানি না’।
তখন তিনি তাঁর মাকে বললেন, আপনি খাত্তাব কন্যা উম্মু জামিলের কাছে যান এবং তাঁর কুশল জেনে এসে আমাকে জানান। তিনি উম্মু জামীলের নিকট গিয়ে বললেন, আবু বকর মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহর কুশল জানতে চাচ্ছে। উম্মু জামীল বললেন, আমি আবু বকরকেও চিনি না আর মুহাম্মদ ইবন আব্দুল্লাহকেও জানি না। আপনারা যদি চান বরং আপনার সাথে গিয়ে আপনার ছেলেকে এক নজর দেখে আসতে পারি। তিনি সম্মতি জানিয়ে বললেন, ঠিক আছে, চলুন।
এরপর উভয়ে একত্রে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকটে এসে তাঁকে ঐ অবস্থায় দেখতে পেলেন। উম্মু জামীল আবু বকর(রা) এর একেবারে কাছাকাছি গিয়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখলেন এবং বললেন, ‘আল্লাহর কসম! যে সম্প্রদায় আপনার সাথে এরূপ (নিষ্ঠুর ও নির্দয়) আচরণ করেছে তারা দুরাচার ও কাফির। আমি আশা করি আল্লাহ তাদের থেকে আপনার প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন। হযরত আবু বকর(রা) তাকে বললেন, ‘আগে বলুন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অবস্থা কেমন? তিনি কেমন আছেন’? উম্মু জামীল বললেন, ‘আপনার মা তো শুনতে পাচ্ছেন’। তিনি বললেন, ‘তাঁর পক্ষ থেকে ভয় পাবার কিছু নেই। আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন’। উম্মু জামীল তখন বললেন, ‘তিনি সুস্থ আছেন এবং ভালো আছেন’।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনি এখন কোথায়? বললেন, তিনি এখন আরকামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। আবু বকর (রা) বললেন, আল্লাহর কসম ! এখন আমি আর পানাহার করতে পারি না যতক্ষণ না আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে গিয়ে হাজির হই। এরপর তাঁরা উভয়ে কিছুটা অপেক্ষা করলেন। রাত হলো এবং মানুষের চলাফেরা এবং আনাগোনা যখন কমে গেলো তখন উম্মু জামীল আবু বকর (রা) কে নিয়ে আরকামের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে গিয়ে হাজির হলেন। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখা মাত্রই যেন জীবন ফিরে পেলেন । এরপর তিনি পানাহার করলেন। (১)
জনৈক আনসারী মহিলা, যাঁর বাপ,ভাই,স্বামী ওহুদ যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে শাহাদাত লাভ করেছিলেন, নিজ আবাস থেকে বেরিয়ে লোকদের জিজ্ঞেস করতে লাগলেন; রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খবর কি? তিনি কেমন আছেন? লোকেরা জওয়াবে বলল, আলহামদুলিল্লাহ! তিনি ভালো আছেন,সুস্থ আছেন ,যেমনটি তুমি চাও। মহিলাটি বলল, আমাকে দেখাও।আমি হুজুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে চাই। এরপর মহিলা হুজুর আকরাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখা মাত্রই আবেগাপ্লুত কন্ঠে বলে উঠলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আপনাকে দেখার পর আর সব বিপদ-আপদই তুচ্ছ।(২)

হযরত খুবায়ব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে শূলে চড়ানো হয়। শূলে চড়াবার পূর্বে কাফিররা তার ঈমানের পরীক্ষা নেবার জন্যে বলেছিল, আমরা তোমাকে মুক্তি দিতে পারি যদি তুমি এতে রাজি থাক, আমরা তোমাকে মুক্তি দেই আর তোমার স্থলে মুহাম্মদ(সা) কে ফাঁসি দেই। একথা শুনতেই তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! আমি তো এও পছন্দ করি না, তাঁর পায়ে একটা কাঁটা বিধুক আর আমি তার বিনিময়ে মুক্তি পাই। খুবায়ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর কথায় তারা সকলেই হেসে উঠে।(৩)
হযরত যায়িদ ইবন সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে সাদ ইবনুর রবী’র সন্ধানে পাঠালেন এবং বললেন, যদি তুমি তাকে পাও তবে তাকে আমার সালাম বলবে এবং বলবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতে চেয়েছেন তুমি এখন কেমন বোধ করছ। যায়দ (রা) বললেন, আমি নিহতদের মধ্যে ঘুরতে লাগলাম। এরপর তাঁকে পেতেই গিয়ে দেখলাম, তাঁর অন্তিম মুহুর্ত সমাগত। তাঁর শরীরে তীর, তলোয়ার ও বল্লমের সত্তরটির মতো আঘাত। আমি তাঁকে বললাম, সা’দ ! আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন এবং জানতে চেয়েছেন, আপনার অবস্থা এখন কেমন? আপনি কেমন বোধ করছেন? উত্তরে তিনি বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমার সালাম বলবে এবং আরও বলবে, ইয়া রাসুলুল্লাহ ! আমি জান্নাতের খোশবু পাচ্ছি। আর আমার সম্প্রদায় আনসারদের বলবে, যদি তোমাদের অনাবধানতায় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু হয়ে যায়, এমতাবস্থায় যদি তোমাদের একটি চোখও অক্ষত থাকে তাহলে আল্লাহর দরবারে তোমাদের কোন ওজর থাকবে না। এর পরক্ষণেই তাঁর প্রাণ বেরিয়ে যায়। (৪)

ওহুদ যুদ্ধের দিন সাহাবী হযরত আবু দুজানা রাদিয়াল্লাহু আনহু কাফিরদের নিক্ষিপ্ত তীর-তলোয়ারের হাত থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বাঁচাতে গিয়ে আপন পৃষ্ঠদেশকে ঢালের ন্যায় পেতে দিয়েছিলেন। নিক্ষিপ্ত তীরগুলো তাঁর পিঠে এসে লাগত আর তিনি এক চুলও নড়াচড়া করতেন না।(৫) মালিক আল-খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষতস্থান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত চুষে খেয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন। যায়দ(রা) তাঁকে থুতু ফেলতে বলেন। কিন্তু তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর কসম ! আমি কখনোই থুতু ফেলব না। (৬)
আবু সুফিয়ান যখন মদীনায় এসেছিলেন, তখন তিনি তাঁর নিজ কন্যা উম্মুল মুমীনিন হযরত উম্মু হাবীবা(রা) এর ঘরে গিয়ে উঠেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিছানায় বসতে উদ্যত হন। উম্মু হাবীবা রাদিয়াল্লাহু আনহা তৎক্ষণাৎ বিছানা উল্টিয়ে দেন। বিস্মিত আবু সুফিয়ান কন্যাকে বললেন, বেটি ! আমি জানি না, তুমি কি আমাকে এই বিছানার উপযুক্ত মনে করনি নাকি এই বিছানাই আমার উপযুক্ত নয় বলে মনে করেছ। উম্মু হাবীবা(রা) বলেন, না, তা নয়, বরং এ বিছানা স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের আর আপনি মুশরিক বিধায় অপবিত্র।(অতএব, আপনি এ বিছানায় বসার উপযুক্ত নন)।(৭)
ওরওয়া ইবন মাসউদ ছাকাফী হুদায়বিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আপন সঙ্গী-সাথীদের বলেছিলেন, লোক সকল ! আল্লাহর কসম করে বলছি, আমি রাজা-বাদশাহদের দরবারে গিয়েছি। পারস্য সম্রাট কিসরা, রোম সম্রাট কায়সার ও আবিসিনিয়ার অধিপতি সম্রাট নাজাশীর দরবারেও গিয়েছি, দেখেছি। আল্লাহর কসম ! মুহাম্মদের (সা) সাথীরা মুহাম্মদকে(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যতটা সম্মান ও সমীহ করে, ততটা সম্মান ও সমীহ কোন রাজা বাদশাহর সাথীদেরকে তাদের রাজা বাদশাহদেরকে করতে দেখিনি। আল্লাহর কসম করে বলছি, যখন তিনি থুতু ফেলেন তখন তা তাদেরই কারো হাতের উপর গিয়ে পড়ে। আর অমনি তাঁরা তা তাঁদের মুখমণ্ডল ও শরীরে মেখে নেয়। যখন তিনি কোন কাজের নির্দেশ দেন অমনি সকলে সেই নির্দেশ পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর তিনি যখন ওযু করেন তখন সেই গড়িয়ে পড়া পানি সংগ্রহের জন্যে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যায়। তিনি যখন কথা বলেন, তখন তারা নিজেদের স্বর নিচু করে দেয় এবং অতিরিক্ত শ্রদ্ধাবশত তারা কখনোই তাঁর চেহারার দিকে গভীর ও পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় না। (৮)
___________________________________________
(১) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসীর কৃত, ২য় খণ্ড, ৩০ পৃ
(২)ইবন ইসহাক ও বায়হাকী
(৩)আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৪খ, ৬৩ পৃ
(৪)যাদুল মা’আদ, ২খ, ১৩৪
(৫)যাদুল মা’আদ,১৩০ পৃ
(৬)যাদুল মা’আদ, ২য় খ, ১৩৬ পৃ
(৭) সীরাত ইবন হিশাম
(৮) যাদুল মা’আদ, ২খ, ১২৫ পৃ
মূলঃ মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কি হারালো – সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী(র)


বৃটেন যেভাবে আরববিশ্বকে বিভক্ত করেছিল

আরব বিশ্বজুড়ে উসমানী খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রক্রিয়া ছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা। একশো বছর আগেও অধিকাংশ আরব অঞ্চল উসমানী খিলাফতের অংশ ছিল। উসমানী খিলাফত ছিল একটি বিশাল বহুজাতিক রাষ্ট্র, যার কেন্দ্র বা রাজধানী ছিল ইস্তাম্বুল। বর্তমানে আরব বিশ্বের মানচিত্র খুবই জটিল একটি গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কিছু জটিল ঘটনা উসমানী খিলাফতের পতন এবং নতুন জাতিয়তাবাদী রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটায়। নবসৃষ্ট এসব রাষ্ট্রের নিজস্ব সীমানা বা বর্ডার ছিল যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে বিভক্ত এবং মুসলিমদেরকে একে অন্যের থেকে আলাদা করে ফেলে। এই ঘটনার পেছনে অনেক কারণ থাকলেও, বৃটেনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। সেই সময়ে বৃটেনের বিবাদমান ৩ পক্ষের সাথে সই করা ৩ টি আলাদা চুক্তিতে পরস্পর বিরোধী অঙ্গীকার ছিল। চুক্তিগুলোর ফলে মুসলিম বিশ্বের একটি বিশাল অংশ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে।
  • প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা:
১৯১৪ সালের গ্রীষ্মে ইউরোপজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের জটিল প্রক্রিয়া, অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, ঔপনিবেশিক বাসনা ও সরকারগুলোর উচ্চপর্যায়ে অব্যবস্থাপনা প্রভৃতি মিলিয়ে এই প্রয়লংকারী যুদ্ধের সূচনা ঘটায়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে প্রায় ১.২ কোটি লোক প্রাণ হারান। যুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে ছিল বৃটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং অক্ষশক্তিতে ছিল জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি।

প্রথমদিকে উসমানী খিলাফত নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কেননা তারা যুদ্ধরত জাতিগুলোর মত ততোটা শক্তিশালী ছিল না এবং নানা আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিল। ১৯০৮ সালে শেষ শক্তিশালী খলীফা আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় কে “৩ পাশা”(তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যুদ্ধমন্ত্রী, নৌমন্ত্রী) উৎখাত করে এবং সামরিক শাসন জারি করে। এরপর থেকে খলীফা পদটি শুধুমাত্র প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হত। এই “৩ পাশা” ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমা ধ্যান-ধারণায় বিশ্বাসী “তরুণ তুর্কী” গ্রুপের সদস্য। অন্যদিকে, উসমানীরা ইউরোপের নানা শক্তির কাছে বিরাট অঙ্কের ঋণের জালেও আবদ্ধ ছিল, যা তারা পরিশোধে অক্ষম ছিল। এই ঋণ থেকে মুক্তি পবার লক্ষ্যে শেষপর্যন্ত উসমানীয়রা এই বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উসমানীয়রা প্রথমে মিত্রশক্তিতে যোগদানে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে ১৯১৪ সালের অক্টোবরে অক্ষশক্তিতে(অর্থাৎ ব্রিটেন, ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবং জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির পক্ষে) যুদ্ধে যোগদান করে।
এর ফলশ্রুতিতে, বৃটেন তৎক্ষণাৎ উসমানী খিলাফতকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের নীলনকশা করতে শুরু করে। বৃটেন ১৮৮৮ সাল থেকে মিশর এবং ১৮৫৭ সাল থেকেই ভারতকে দখল করে নিয়েছিল। উসমানী খিলাফতের অবস্থান ছিল ব্রিটেনের এই দুই উপনিবেশ এর ঠিক মাঝখানে। ফলে বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে উসমানী খিলাফতকে উচ্ছেদ করতে বৃটেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে।
  • আরব বিদ্রোহ:
ব্রিটেনের অন্যতম বড় পরিকল্পনা ছিল উসমানী খিলাফতের আরব জনগণকে উস্কে দেয়া। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরব উপদ্বীপের পশ্চিমের এলাকা হিজাযের একজন ব্যক্তিকে তারা তৎক্ষণাৎ পেয়েও যায়। মক্কার গভর্নর শরীফ হুসেইন বিন আলী উসমানী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার শর্তে বৃটেনের সাথে চুক্তি করে। শরীফ হুসেইন নিজের মুসলিম ভাইদের সাথে যুদ্ধ করার এই ব্রিটিশ পরিকল্পনায় কেন অংশ নিয়েছিলেন তার নিশ্চিত কারণ জানা যায় নি। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে: ৩ পাশা কর্তৃক তুর্কী জাতীয়তাবাদ ( এবং সেকুলারিজম) বাস্তবায়নের চেষ্টায় তার অসন্তোষ, উসমানী সরকারের প্রতি ব্যক্তিগত আক্রোশ অথবা নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার মনোবাসনা।
যে কারণেই হোক না কেন, বৃটেনের সাহায্যপুষ্ট হয়ে শরীফ হুসেইন উসমানীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিলেন। অন্যদিকে, বৃটেন বিদ্রোহীদেরকে টাকা ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়, কেননা টাকা ও অস্ত্র ছাড়া উসমানীদের সুসংঘটিত বাহিনীর সাথে পেড়ে ওঠা কষ্টকর ছিল। ব্রিটেন তাদের এও প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যুদ্ধের পর শরীফ হুসেইনকে ইরাক ও সিরিয়া সহ গোটা আরব উপদ্বীপ মিলিয়ে একটি বিশাল আরব রাজ্য শাসন করতে দেয়া হবে। দুইপক্ষ (বৃটেন ও শরীফ) এর মধ্যকার এ সম্পর্কীয় আলাপ-আলোচনা ও দর কষাকষি বিষয়ক চিঠিগুলো ইতিহাসে McMahon-Hussein Correspondence (ম্যাকমেহন-শরীফ পত্রবিনিময়) নামে পরিচিত।
এই ম্যাকমেহন হলেন মিশরের তৎকালীন ব্রিটিশ হাই কমিশনার স্যার হেনরি ম্যাকমেহন, যার সাথে শরিফের গোপন আঁতাত চলছিল।

১৯১৬ এর জুনে, শরীফ হুসেইন তার সশস্ত্র আরব বেদুঈনদের নিয়ে যুদ্ধে বেড়িয়ে পড়েন। কয়েক মাসের মধ্যেই বৃটিশ সেনা ও নৌবাহিনীর সহায়তায় আরব বিদ্রোহীরা মক্কা ও জেদ্দা সহ হিযাজের বেশ কয়েকটি শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়। ব্রিটেন সৈন্য, টাকা, অস্ত্র, পরামর্শদাতা (যার মধ্যে অন্যতম ছিল বিখ্যাত “লরেন্স অফ এ্যারাবিয়া”), এবং একটি পতাকা দিয়ে বিদ্রোহীদের সহায়তা করে। মিশরে অবস্থানরত বৃটিশরা বিদ্রোহীদের একটি পতাকা বানিয়ে দেয় যা “আরব বিদ্রোহীদের পতাকা” নামে পরিচিত ছিল। এই পতাকা-ই পরবর্তীতে অন্যান্য আরব দেশ যেমন: জর্ডান, ফিলিস্তিন, সুদান, সিরিয়া, কুয়েতের পতাকা তৈরিতে মডেল (আদর্শ) হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
 ছবি- দেশগুলোর পতাকা
১৯১৭ থেকে ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, আরব বিদ্রোহীরা উসমানীদের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নিতে সক্ষম হয়। একদিকে বৃটেন বাগদাদ ও জেরুজালেম দখল করে ইরাক ও ফিলিস্তিনে তাদের অবস্থান জোরদার করে, অন্যদিকে আরব বিদ্রোহীরা আম্মান ও দামেস্ক দখল করে বৃটেনকে তাদের কাজে সাহায্য করতে থাকে।
এখানে জেনে রাখা জরুরি যে, অধিকাংশ আরব জনগোষ্ঠীরই এই আরব বিদ্রোহে কোন সমর্থন ছিল না। এটি ছিল (ক্ষমতালোভী) কতিপয় নেতার নেতৃত্বাধীন একটি ছোট আন্দোলন যা ঐ নেতাদের নিজস্ব ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছিল। অধিকাংশ আরব জনগোষ্ঠী এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখে এবং উসমানী বা বিদ্রোহী কোন পক্ষকেই সমর্থন দেয় নি। শরীফ হুসেইনের আরব রাজ্য বানানোর বাসনা এতদিন ঠিকভাবেই এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বৃটেনের সাথে অন্যান্য পক্ষের করা প্রতিশ্রুতিগুলো এবার বাঁধ সাধল।

  • (syches-picot)সাইকস-পিকোট চুক্তি:
আরব বিদ্রোহ শুরু হবার আগেই এবং শরীফ হুসেইন তার আরব রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে বৃটেন ও ফ্রান্সের অন্য পরিকল্পনা করা ছিল। ১৯১৫-১৬ এর শীতকালে, বৃটেনের স্যার মার্ক সাইকস ও ফ্রান্সের ফ্রান্সিস জর্জেস পিকোট উসমানী খিলাফত পরবর্তী আরব বিশ্বের ভাগ্য নির্ধারণ করতে গোপনে মিলিত হন।
বৃটেন ও ফ্রান্স পুরো আরব বিশ্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করে, যা পরবর্তীতে সাইকস-পিকোট চুক্তি নামে পরিচিতি লাভ করে। বৃটেন বর্তমানে জর্ডান, ইরাক, কুয়েত নামে পরিচিত এলাকাগুলোর দখল নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। ফ্রান্স পায় বর্তমান সিরিয়া, লেবানন ও দক্ষিন তুরস্ক। জায়োনিস্টদের (জায়োনবাদী) ইচ্ছাকে এখানে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে ফিলিস্তিনের দখল নেয়ার বিষয়টি পরবর্তীতে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৃটেন ও ফ্রান্সের দখলকৃত অঞ্চলগুলোর কিছু কিছু জায়গায় আরবের সীমিত মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন দেয়ার কথা থাকলেও, ইউরোপীয় শাসন ব্যবস্থাই তাদের উপর কর্তৃত্বশীল থাকবে। চুক্তি অনুযায়ী, অন্যান্য এলাকায় বৃটেন ও ফ্রান্স সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব করার অধিকার পায়।
যদিও এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী মধ্যপ্রাচ্যে করণীয় বিষয়ক একটি গোপন চুক্তি ছিল, কিন্তু ১৯১৭ সালে রাশিয়ান বলশেভিক সরকার একে সবার সামনে উন্মোচন করে দেয়। এই সাইকস-পিকোট চুক্তি ও শরীফ হুসেইনকে দেয়া ব্রিটেনের প্রতিশ্রুতির মধ্যে স্পষ্ট বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হয়। যার ফলে, বৃটেন ও আরব বিদ্রোহীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এটিই বৃটেনের করা সর্বশেষ পরস্পর বিরোধী চুক্তি ছিল না, নাটকের চিত্রনাট্যের এখনো কিছু অংশ বাকি ছিল।
  • বেলফোর ঘোষণা:
আরেকটি সম্প্রদায়েরও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের দিকে শ্যেনদৃষ্টি ছিল এবং তারা হল জায়নবাদীরা (ইহুদী)।
জায়োনিজম হল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন যা ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতো। এই আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯ শতকে এবং এর লক্ষ্য ছিল ইউরোপের ইহুদিদের জন্য (যারা ছিল মূলত পোল্যান্ড, জার্মানি, রাশিয়ার বাসিন্দা) ইউরোপের বাইরে একটি আবাসভূমি খুঁজে বের করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জায়োনিস্টরা বৃটেন সরকারের কাছে যুদ্ধ পরবর্তীতে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের ব্যাপারে সাহায্য চায়। অন্যদিকে, বৃটিশ সরকারের ভিতরেও এমন অনেক কর্মকর্তা ছিলেন যারা এই রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আরথার বেলফোর। ১৯১৭ সালের ২রা নভেম্বরে, বেলফোর (ইহুদিবাদি) জায়োনিস্ট সম্প্রয়দায়ের নেতা ব্যারন রসথচাইল্ডকে একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এই চিঠিতে তিনি ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের সরকারী সমর্থন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
“মহামান্য (বৃটিশ রাজার) সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় বসতি স্থাপনের ব্যাপারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে এবং এই লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্যে তার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। এটা পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে, এমন কিছুই করা হবে না যাতে ফিলিস্তিনে বিদ্যমান অ-ইহুদি (অন্যান্য ধর্মাবলম্বী) সম্প্রদায়ের নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়, অথবা অন্য কোনো দেশে বসবাসকারী ইহুদীদের উপভোগকৃত অধিকার ও রাজনৈতিক অবস্থানের ক্ষতিসাধন হয়”
  • তিনটি পরস্পরবিরোধী চুক্তি:
ফলে দেখা গেল, বৃটেন ১৯১৭ সালের মধ্যেই তিন তিনটি ভিন্ন পক্ষের সাথে তিনটি আলাদা চুক্তি করলো এবং এই তিনটি ভিন্ন চুক্তিতে আরব বিশ্বের ভবিষ্যতের ব্যাপারে তিনটি ভিন্ন সিদ্ধান্তে উপনীত হল।
(১) বৃটেন আরবদেরকে আশ্বাস দিল, তারা শরীফ হুসেইনের মাধ্যমে আরব রাজ্যের কর্তৃত্ব পাবে,
(২) অন্যদিকে ফ্রান্স এবং বৃটেন চুক্তি করলো, ঠিক ঐ এলাকাগুলোই বৃটেন এবং ফ্রান্স ভাগ করে নিবে।
(৩)আবার বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী জায়োনবাদীরা ( ব্রিটেন তথা ইউরোপিয়ানদের সাহায্যে) ফিলিস্তিন পাওয়ার আশা করলো।
১৯১৮ সালে মিত্রশক্তির বিজয়ের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে এবং ফলশ্রুতিতে উসমানী খিলাফতের ধ্বংস ঘটে। যদিও উসমানীরা ১৯২২ পর্যন্ত নামে মাত্র টিকে ছিল এবং খলীফার পদটি ১৯২৪ সাল পর্যন্ত নামমাত্র ভাবে টিকে ছিল, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে উসমানীদের অধীনে থাকা সব অঞ্চল ইউরোপিয়ানদের উপনিবেশে পরিণত হয়। যদিও যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ভাগ্য তিন পক্ষের পরস্পরবিরোধী বিতর্কের মধ্যে আটকা পড়ে যায়।
তাহলে কোন পক্ষ অবশেষে বিজয় লাভ করেছিল?
প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই তাদের পূর্ণ চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পায় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সময়ে লিগ অব নেশনস (জাতিসংঘের আদি রূপ) প্রতিষ্ঠা করা হয়। লিগ অব নেশন্সের অন্যতম দায়িত্ব ছিল, বিজিত উসমানী অঞ্চলগুলোকে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া। লিগ অব নেশন্স সম্পূর্ণ আরব বিশ্বকে অনেক ভাগে বিভক্ত করে ফেলে (যাকে মেন্ডেট বলা হয়)। এসব মেন্ডেট বৃটেন ও ফ্রান্স এর হাতে তুলে দেয়া হয় এবং মেন্ডেটগুলো ব্রিটেন ও ফ্রান্স দ্বারা শাসিত হবে যতদিন না ঐ ছোট অঞ্চলটি বা মেন্ডেটটি নিজেই নিজের দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে সামর্থ্যবান হয়। এই লিগ অব নেশন-ই সর্বপ্রথম মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে বিভিন্ন সীমানা আরোপ করে দেয়, যা আমরা বর্তমানে মানচিত্রে দেখতে পাই। এই সীমানাগুলো স্থানীয় জনগণের কোনপ্রকার মতামত ছাড়াই আরোপ করা হয়।
জাতিগত, ভৌগলিক অথবা ধর্মীয় কোন পরিচয়ই বিবেচনায় আনা হয় নি, অর্থাৎ তা ছিল সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারী একটি সিদ্ধান্ত। এটা জেনে রাখা জরুরি যে, আরব বিশ্বের এই রাজনৈতিক সীমানা কোনভাবেই বিভিন্ন জাতির উপস্থিতি নির্দেশ করে না। ইরাকি, সিরিয়, জর্ডানি ইত্যাদি পার্থক্যসমূহ সম্পূর্ণরূপে ইউরোপীয় ঔপনিবেশবাদীদের কর্তৃক তৈরি করা হয় আরবদেরকে নিজেদের মধ্যে বিভক্ত করে ফেলার পদ্ধতি হিসেবে। এই মেন্ডেট সিস্টেমের মাধ্যমে বৃটেন এবং ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্যের উপর তার কাঙ্খিত দখল বুঝে পায়। অন্যদিকে শরীফ হুসেইনের ক্ষেত্রে, তার ছেলেরা বৃটিশদের ছায়াতলে থেকে শাসনকাজ পরিচালনার সুযোগ পায়। প্রিন্স ফয়সালকে সিরিয়া ও ইরাকের রাজা করা হয় এবং প্রিন্স আব্দুল্লাহকে করা হয় জর্ডানের রাজা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বৃটেন এবং ফ্রান্স-ই এইসব এলাকার প্রকৃত কর্তৃত্বে ছিল।
অন্যদিকে, বৃটেন সরকার জায়োনবাদীদেরকে কিছু শর্তসাপেক্ষে ফিলিস্তিনে বসতি গড়ার অনুমতি দেয়। বৃটেন সেখানে আগে থেকে বসবাসকারী আরবদের রাগান্বিত করতে চায় নি, তাই তারা ফিলিস্তিনে আসা দেশান্তরিত ইহুদীদের সংখ্যাসীমা বেঁধে দেয়। এর ফলে জায়োনবাদীরা ক্ষেপে ওঠে, ১৯২০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ইহুদীরা বৃটেনের শর্ত না মেনেই ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনকারীর সংখ্যা বাড়াতে থাকে। এসব ঘটনা আরবদের ক্ষোভও বাড়িয়ে দেয়, কেননা তাদের কাছে ফিলিস্তিন ছিল এমন একটি ভুমি যা ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহুদ্দিন আইয়্যুবির বিজয়ের পর থেকে তাদের নিজেদের ছিলো এবং এখন তা বসতি স্থাপনের ফলে ইহুদীদের বলপূর্বক দখলে চলে যাচ্ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বৃটেন মধ্যপ্রাচ্যে তৈরি করেছিল তা আজও বিদ্যমান।
পরস্পরবিরোধী চুক্তিগুলো এবং এর ফলে সৃষ্ট আলাদা আলাদা দেশগুলো মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। জায়োনিজমের উত্থান ও মুসলিমদের মধ্যে অনৈক্যের ফলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে জালিম সরকারের উপস্থিতি ও অর্থনৈতিক পতন দেখা দিয়েছে। যদিও এই বিভাজনটি গত ১০০ বছরের ছোট পরিক্রমার ভেতরে তৈরি করা হয়েছে, তথাপি বৃটেন এর তৈরি করা এই বিভেদ মুসলিম বিশ্বে আজো শক্তিশালীভাবে বিরাজ করছে।
Bibliography:
Hourani, Albert Habib. A History Of The Arab Peoples. New York: Mjf Books, 1997. Print.
Ochsenwald, William, and Sydney Fisher. The Middle East: A History. 6th. New York: McGraw-Hill, 2003. Print.
মূল: Lost Islamic History হতে নেয়া এক প্রবন্ধ
বাংলা অনুবাদঃblogspot.com

আল হিন্দ (ভারতবর্ষ) যেভাবে ব্রিটিশদের মাধ্যমে লুন্ঠিত হল, রাজা হল ফকির- ফকির হল রাজা

শিল্প বিপ্লব পূর্ব পৃথিবীতে আল হিন্দ বা ভারতবর্ষ ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি ভূমি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই ভূমির কথা উল্লেখ করেছেন আল হিন্দ বলে। ৭১২ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের আগমনের মাধ্যমে এই ভারতবর্ষের সিন্ধু প্রদেশ ইসলামী খিলাফতের অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলা থেকে বেলুচিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত এই ভূমিকে একত্রিত অবস্থায় রেখে কেন্দ্রীয়ভাবে শাসন করেছে একমাত্র মুসলিম শাসকরাই।
আসুন জেনে নিই, মুসলিম শাসনাধীন অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী ভূমি আল হিন্দ কিভাবে পরিণত হল
পৃথিবীর দরিদ্রতম তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে।
মুঘল আমল
ইউরোপীয়ানদের আগমনের পূর্বে, পাক ভারত উপমহাদেশ প্রায় সাড়ে তিনশ (১৫২৬-১৮৫৮) বছর ধরে মুঘলরা শাসন করেছেন, তারা ছিলেন ক্ষমতাধর শাসক এবং যাদের ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল। এই সময়ে ভারত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল এবং নিজেদের স্বর্ণযুগ পার করেছে। ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতকে পুরোপুরি ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি, সাম্রাজ্যবাদীদের কব্জামুক্ত ছিল আল হিন্দ। এরপর তাদের লুন্ঠনের কারণে অর্থনীতিতে পতন শুরু হতে থাকে, গবেষণায় প্রমাণিত gross domestic surplus goods এর হিসাবে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ২৫% (অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ) অংশ ছিল ভারতে, যা ছিল সেই সময়েও বিশ্বের ২য় সর্বোচ্চ, গ্রেট ব্রিটেনের কোষাগার থেকেও বেশি।
তিন শতাব্দীতে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির চিত্রঃ
  • ১৫০০ – India’s economy had a 24.5% share of world income, the second largest in the world after China, which had a 25% share. (• ^ Angus Maddison (2003). The World Economy: Historical Statistics, OECD, Paris)
  • ১৬০০– India’s income of £17.5 million (population approx. 150 million people) was greater than the entire treasury of Great Britain in 1800, which totalled £16 million. (• ^ Bowen, H. V. Business of Empire: The East India Company and Imperial Britain, 1756-1833 (2006), 304pp)
  • ১৭০০- India’s economy had a 24.4% share of world income, the largest in the world. (• ^ Kumar, Dharma and Meghnad Desai, eds. The Cambridge Economic History of India: Volume 2, c.1751-c.1970 (1983).)
ইউরোপিয়ানদের আগমন ও অর্থনীতির পতন
ইউরোপীয়ানদের উন্নতির সাথে সাথে বিশ্বের পরিবর্তন ঘটতে লাগল, যার মধ্যে একটি হল ভারতের অর্থনীতির তীব্র পতন। তাদের নানাবিধ সংস্কারের মাধ্যমে এই পতনের জন্য তারাই দায়ী। দুইভাবে এই পতন ঘটানো হয়েছে, পতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ, ব্রিটিশদের বৈষ্যম্যমূলক নীতির মাধ্যমে ২০০ বছরের শাসন, তারা ভারত থেকে কম দামে কাঁচামাল কিনত এবং ভারতীয় বাজারের তুলনায় চড়া দামে বিক্রি করত। যার ফলে, changed the whole scenario of the most powerful economy of the world to decline from its position from 22.3 % in 1700 AC to a drastic dip of 3.8% in 1952. সমগ্র দৃশ্যপটের আমূল পরিবর্তন ঘটে, এবং বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশটি ২২.৩% থেকে পতন ঘটে ১৯৫২ সালে চলে আসে, ৩.৮% এ।
২০০ বছরের সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে, একটি শীর্ষ অবস্থান থেকে দেশটির অর্থনীতি সাম্রাজ্যবাদের কবলে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কলোনিয়াল যুগের প্রভাবে খাজনা, কর, সম্পত্তি কর ইত্যাদির প্রভাবে অর্থনীতিতে ধ্বস নামে, ভারতীয় শিল্প বন্ধ হয়ে যায়, এবং বাধ্য হয়ে লোকজন ইংরেজদের পণ্য কিনতে শুরু করে, ফলে উৎপাদন কমে আসে এবং লোকজনের অর্থ হ্রাস পায়।
বাংলার নবাবদের অপসারণের পর ইংরেজরা শুরু করল সম্পদ পাচার, লুটপাট আর অব্যবস্থাপনা। ফলাফলস্বরুপ- ভারতবর্ষের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ বাংলাকে উপহার দিয়েছে একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যে দুর্ভিক্ষে বাংলার প্রতি তিন জনে একজন ব্যক্তি মারা যায় বা এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তি মারা যায়, বাংলা ১১৭৬ সালে সংগঠিত এই দুর্ভিক্ষ পরিচিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে।
একইভাবে, ১৯৪৭ এ ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে চলে যাওয়ার পূর্বে আবার এল দুর্ভিক্ষ, সেটা এই বাংলাতেই, যা পরিচিত তেতাল্লিশ(১৯৪৩ সালে সংগঠিত) এর মন্বন্তর নামে। এ দুর্ভিক্ষে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ মারা যায়।
রসচাইল্ড পরিবারের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ যেভাবে শোষিত হলঃ
ভারতবর্ষ এবং সিন্ধু সভ্যতা আগে থেকেই অবকাঠামোগত এবং অর্থনৈতিকভাবে উন্নত এবং আধুনিক একটি সভ্যতা ছিল প্রায় ৪০০০ বছর ধরে, যখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের সমুদ্র উপকূলে জাহাজ ভিড়ালো, তখনো এবং এরপর থেকেই এই ব্রিটিশদের নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান কলোনিয়দের কারণে আমরা হয়ে গেলাম দরিদ্র, অনগ্রসর এবং অনুন্নত এক দেশ।
কিভাবে তারা এটা করেছিল?
সহজ, তারা আমাদের সম্পদ চুরি করেছে প্রকাশ্যে, নির্লজ্জভাবে, যা আজ পর্যন্ত চলছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাধ্যমে নানাবিধ উপায়ে। এখানে, আমরা সেটাই দেখাব কিভাবে ভারতবর্ষ এবং এই জনপদের জনগণের কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানির নেতৃত্বে সম্পদ লুট শুরু হয়েছিল যা আজ পর্যন্ত চলে আসছে, কিন্তু এমনভাবে বর্তমানে চলছে যা আমরা দেখতে পাই না কিংবা দেখলেও আমরা বুঝতে পারি নাঃ
১৬০০ সালে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতের সাথে বাণিজ্যের চার্টার (অনুমোদনপত্র) প্রদান করা হল



 ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানি কোম্পানিটি একদল সমুদ্রের দস্যুদের জাহাজে করে পাঠানো শুরু করল ‘ব্যবসায়ী’ নাম প্রদান করে।


এই সামুদ্রিক দস্যুরা ভারতবর্ষের সমুদ্র তীরে অবতরণ করতে লাগল এবং সুকৌশলে দুর্গ গড়ে তুলতে শুরু করল বিভিন্ন স্থানে, যেমন একটি স্থান হচ্ছে চেন্নাই।
রসচাইল্ড পরিবার ছিল বাণিজ্য কোম্পানি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক। ১৮৫৭ সালে, তারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাথে একত্রীত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতবর্ষে বাংলা প্রদেশ দখল করার পর, রসচাইল্ডেরা একটি নৈরাজ্যমূলক দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন চালু করল, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল নির্লজ্জভাবে বাংলার অগণিত ধন সম্পদ লুন্ঠন করা, যা ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রদেশ।




নবাব সিরাজউদ্দৌলার পদাতিক বাহিনী, বহনযোগ্য পাটাতনের উপর ১৭৫৭ সাল

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে, ক্লাইভ এবং ব্রিটিশ বাহিনীর বাংলা দখল করে ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে, এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসন। ছবি-( A print from “The Illustrated London News”, (23 September 1893). Heritage-Images 2008 – All Rights Reserved )
নবাব, রাজা এবং জমিদারদের বহু মূল্যবান সম্পদ ডাকাতি লুট করা হল। নিচের ছবিটি তেমনি একটি মূল্যবান সম্পদ যা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লুট করেছিল।


 রসচাইল্ড পরিবার বাংলা থেকে লুট করা এই বিশাল স্বর্ণ লণ্ডনে পাচার করে দেয়। এটা ছিল বাংলা থেকে লুট করা সম্পদ স্বর্ণ যার মাধ্যমে রসচাইল্ড পরিবার ইংল্যাণ্ডে ব্যক্তি মালিকানাধীণ ব্যাংক ‘ব্যাংক অফ ইংল্যাণ্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল।




ব্যাংক অব ইংল্যাণ্ডের ভূ-গর্ভস্থ ভল্টের চিত্র। সোনার বার ছবিতে দেখা যাচ্ছে।
 

পরবর্তী দশকে, রসচাইল্ড পরিবার আমেরিকাতে ফেডারেল রিসার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে, যা আজ পর্যন্ত আমেরিকান জনগণের সম্পদ লুট করে টিকে আছে। রসচাইল্ড পরিবার এরপর বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে।



রসচাইল্ড পরিবার বিশ্ব ব্যাংক, আই এম এফ, দ্য ব্যাংক ফর ইন্টারনেশনাল সেটেলমেন্টকে ব্যবহার করেছে তাদের তৃতীয় বিশ্ব থেকে লুট করা সম্পদকে একটি বৈধ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের জন্য। সিটি ব্যাংক, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ইত্যাদি ব্যাংকগুলো রসচাইলন্ড পরিবারের গোপন সমর্থন এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা একযোগে তৃতীয় বিশ্ব এবং ভারতে সম্পদ লুট করতে থাকে।
১৮৫৭ সালের আজাদী আন্দোলনঃ
যখন ভারতীয়রা ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহ করে, তাদেরকে জানানো হল ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানি বিলুপ্ত হয়েছে, এবং ভারতকে সরাসরি ক্রাঊন’ শাসন করবে।
পরিহাসের বিষয়, অনেক ভারতীয় আজকে পর্যন্ত জানে না, ব্রিটিশরা ক্রাঊন’ বলে যা রাজা বা রাণীকে বুঝায় নি, বরং লন্ডনের একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন কর্পোরেশনকে বুঝিয়েছিল যাদেরকে সেই একই রসচাইল্ড পরিবার নিয়ন্ত্রন করছে, যারা এর আগে ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানির মালিকানা করত।
ভারতীয়দেরকে অতি সহজে নাম নকশা বদলের খেলায় ধোঁকা দেয়া হল !
ভারতে বৈষ্যম্য এবং শোষণ, সম্পদের অপব্যবহার ইত্যাদি এই ক্রাঊনের অধীনে একটানা চলল ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৭ এ ভারতের জনগণ আরও একবার প্রতারিত হল এই ভেবে যে, তারা স্বাধীনতা অর্জন করেছে পন্ডিত নেহরু জিন্নাহ, গান্ধী প্রমুখের আন্দোলনের মাধ্যমে।

লুটেরা শাসক চলে গেল, রয়ে গেল তাদের দালাল শ্রেনীঃ
আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, বর্তমান দেশটিতে সবচেয়ে ধনী লোকেরা হল রাজনীতিবিদেরা, যারা এখনো চুরি ডাকাতি লুন্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে ইস্ট ইন্ডীয়া কোম্পানি রসচাইল্ড পরিবারের অলিখিত কর্মী হিসেবে।
প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ভারতীয় বর্তমানে দৈনিক ৫০ রুপির নিচে আয় করে অথচ দেশটির পার্লামেন্টারিয়ানরা কোটিপতি।
রসচাইল্ড পরিবার আত্মীয়তার মাধ্যমে ব্রিটিশ রাজ পরিবারে মিশে আছে এবং ইউরোপের বিভিন্ন অভিজাত পরিবারেও আছে।

কোহিনূর হীরাঃ সম্পদ চুরির নির্লজ্জ উদাহরণ-ভারত থেকে যে কোহিনূর হিরাটি রবার্ট ক্লাইভের মাধ্যমে চুরি করা হয়েছিল সেটা উপহার দেয়া হল ব্রিটিশ রানীকে।




ছবিতে রাণী এলিজাবেথের মুকুটে পায়রার ডিমের আকৃতির কোহিনূর হীরাটি দেখা যাচ্ছে।

ইংরেজদের লুটপাট সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মন্তব্যঃ
“সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য উমিচাঁদ-মীর জাফরের সাথে কোম্পানীর যে ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার অর্থনৈতিক দাবী পূরণ করতে গিয়ে বাংলার রাজকোষ শূণ্য হয়ে পড়ে। পূর্বে বলা হয়েছে যে, এ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কোম্পানীকে ভুয়া ক্ষতিপূরণ বাবদ দিতে হয় একশ লক্ষ টাকা। ইউরোপীয়দেরকে পঞ্চাশ লক্ষ, হিন্দু প্রধানকে বিশ লক্ষ এবং আরমেনীয়দেরকে সাত লক্ষ টাকা। বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পূর্বেই ক্লাইভকে দিতে হয় বায়ান্ন লক্ষ টাকা” (Fall of Sirajuddowla- Dr. Mohar Ali)
“১৭৭৬ সালের দুর্ভিক্ষে বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক প্রাণত্যাগ করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের বেলায় কোন প্রকার অনুকম্পা প্রদর্শিত হয়নি। দুর্ভিক্ষ যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন পূর্বের বৎসরের তুলনায় ছয় লক্ষ টাকা অধিক রাজস্ব আদায় করা হয়, বাংলা ও বিহার থেকে পরবর্তী বছর অতিরিক্ত চৌদ্দ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।
মানব সন্তানেরা যখন ক্ষুধা তৃষ্ণা ও মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছিল, তখন তাদের রক্ত শোষণ করে পৈশাচিক উল্লাসে নৃত্য করছিল ইংরেজ ও তাদের রাজস্ব আদায়কারীগণ। এসব রাজস্ব আদায়কারী ছিল কোলকাতার হিন্দু বেনিয়াগণ, সুদী মহাজন ও ব্যবসায়ীগণ। মানবতার প্রতি এর চেয়ে অধিক নির্মমতা ও পৈশাচিকতা আর কি হতে পারে ?” (Badel powel-Land system etc._British policy & the Muslims in Bengal-A.R Mallick)
“ব্রিটিশ আমলে বাংলার অর্থনীতি মানেই হলো-সুপরিকল্পিত শোষণের মর্মভেদী ইতিহাস। ঐতিহাসিকরা মোটামুটি হিসাব করে বলেছেন, ১৭৫৭ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মাত্র তেইশ বছরে বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চালান গেছে প্রায় তিন কোটি আশি লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ সমকালীন মূল্যের ষাট কোটি টাকা। কিন্তু ১৯০০ সালের মূল্যমানের তিনশো কোটি টাকা”। (I.O. Miller, quoted by Misra, p 15)
এডমান্ড বার্ক এর উক্তিঃ “আমাদের আজ যদি ভারত ছাড়তে হয়, তাহলে ওরাং ওটাং বা বাঘের চেয়ে কোন ভালো জানোয়ারের অধিকারে যে এদেশ ছিল তার প্রমাণ করবার কিছুই থাকবে না” (আবদুল মওদুদ-মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ, পৃ ৬৪)
কোম্পানীর শাসন আমল সমাপ্তির পূর্বক্ষণে জন ব্রাইট বলেছিলেন, “ ভারতের নিরীহ জনগণের উপর একশ বছরের ইতিহাস হল অকথ্য অপরাধসমূহের ইতিহাস” (Oxford History of India: p 680)

সংকলন- ঈমানী পথ